বৃটিশ আইএস সমর্থক ইমরান এখন বাংলাদেশে?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০১৭
দেশ ডেস্ক: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ যুবক ইমরান মিয়া (২৭)। তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী আইসিসের (আইএস) সমর্থক। ইমরান এখন বাংলাদেশে বলে জানিয়েছেন তার মা আনোয়ারা বেগম। পূর্ব লন্ডনের ম্যানোর পার্কে তাদের বসবাস। পেশায় ইমরান মিয়া একজন শিক্ষক। বৃটেনে মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশ কিছু স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। তবে এ সময়েই ছদ্মনাম ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দিতে থাকে। নিজের নাম ইমরান মিয়া হলেও তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিলেন ইমরান ইবনে ফরিদ। বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে লন্ডনের অনলাইন ডেইলি মেইলের এক অনুসন্ধানে। এ নিয়ে গতকাল তারা ইমরান মিয়া ও তার কর্মকাণ্ডের ছবি সংবলিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে পুলিশকে। কিভাবে তিনি শিক্ষকতার মাঝে আইসিসের সমর্থক হয়ে উঠলেন তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। তিনি ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সমকামীদের বর্বরভাবে হত্যা সমর্থন করেছেন। যারা ধর্মীয় ভিন্নমত পোষণ করেন তাদের ধারালো ছুরি দিয়ে হামলা করার হুমকি দিয়েছেন। ফেসবুকে আইএসের জঙ্গিদের বিজয় উদযাপন করেছেন ইমরান। ওই গ্রুপের একটি কালো পতাকার ছবি পোস্ট করেছেন। আইএসের হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের সম্মানে আয়োজিত নীরবতা পালন নিয়ে মস্করা করেছেন। গত বছর প্যারিসের নিস শহরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ৮৬ জন। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি অন্য এক পোস্টে মস্করা করেছেন। নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করে একটি পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ হয়। তার নিচে ইমরান মিয়া লিখেছেন, আমাদের মৃতরা জান্নাতে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে তোমাদের মৃতরা নরকে।
ডেইলি মেইলের সাংবাদিক ওমর ওয়াহিদ ও কলিন কোর্টবাস শনিবার রাতে ইমরান মিয়ার বিষয়ে তার মার কাছে জানতে চান। জবাবে তার মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তার ছেলে তিন বা চার মাসের জন্য বিদেশে গেছে। প্রথমে তিনি বলেন, সে মিশরে আছে। আর কিছুক্ষণ পরেই বলেন, সে ফিরে গেছে তার নিজের দেশ বাংলাদেশে। ডেইলি মেইল লিখেছে, ইমরান মিয়া একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে বৃটেনের বিভিন্ন স্কুলে পড়িয়েছেন। শনিবারে রাতে তার মতো একজন যুবকের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন রাজনীতিকরা। তারা এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করতে অনুরোধ করেছেন পুলিশকে। অন্য সব শিক্ষকের বেলায় যা হয় ইমরান মিয়ার বেলায়ও তাই হয়েছে। অন্যদের ক্রিমিনাল রেকর্ড যেমন যাচাই করা হয়েছে ইমরানেরও তাই। কিন্তু অনলাইনে সে নিজেকে ছদ্মনামে উপস্থাপন করেছে। ফলে তাকে শনাক্ত করা যায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃটিশ সরকার স্কুলগুলোতে উগ্রবাদের উত্থান নিয়ে সচেতন। গত বছর কয়েক হাজার শিক্ষককে সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইমরান মিয়া ফেসবুকে তার ক্ষোভ ঝেড়েছে। কিভাবে শিশুদের সমকামী করে গড়ে তোলা হচ্ছে তা নিয়ে তার এই ক্ষোভ। সে লিখেছে, নার্সারি থেকে মাধ্যমিকে কোনো শিশুই নিরাপদ নয়। এসব স্কুল ভবিষ্যতের সমকামী অধিকার কর্মী তৈরির কারখানা হয়ে উঠছে। আরেক পোস্টে সে লিখেছেন, প্রথমে সমকামীদের আলাদা করা উচিত। এরপর তার দিকে পাথর মারা উচিত। এমন সব পোস্টের মাঝেও তিনি তার নিজের হোমওয়ার্কের একটি ছবি পোস্ট করেছেন। তাতে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে সহায়তা চাইছেন যাতে একজন পূর্ণাঙ্গ যোগ্য শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন। তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন পূরণ হয়। অন্য এক পোস্টে তিনি ফিলিস্তিনে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলেছেন।
এতে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের শিকল থেকে মুক্ত করতে হবে। তিনি লিখেছেন, যুদ্ধের আগুন ইসরাইলজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। তার সব রকম কর্মকাণ্ডের তথ্য, তার মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। তিনি যখন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন তখন তার ফেসবুক পেজ ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি ছিলেন এমরান ইবনে ফরিদ। ডেইলি মেইল তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। বিষয়টি টের পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়া থেকে তিনি ইমরান ইবনে ফরিদ নামটি মুছে দেন। পাশাপাশি এ নামের পেজগুলোও মুছে দেন। এ বিষয়ে কথা বলেছেন সন্ত্রাসী আইন বা বিধিবিধানের সাবেক স্বতন্ত্র পর্যালোচনাকারী লর্ড কারলিলে। তিনি বলেছেন, ইমরান মিয়া অনলাইনে যেসব বিবৃতি দিয়েছেন তা পুলিশি তদন্তের দাবি রাখে। তিনি বলেন, এসব বিবৃতি ২০০৬ সালের ‘টেরোরিজম অ্যাক্ট’ লঙ্ঘন করে থাকতে পারে। এই আইনে সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করতে পরোক্ষ চেষ্টাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি ঘৃণা প্রসূত অপরাধ বিষয়ক আইনও লঙ্ঘন করে থাকতে পারেন। লর্ড কারলিলে বলেন, এমন একজন ব্যক্তি একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এটা উদ্বেগজনক। তিনি ইন্টারনেটে যে কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন তা একজন শিক্ষকের গুণ হতে পারে না। সাবেক নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী লর্ড ওয়েস্ট অব স্পিটহেড বলেছেন, যদি এমন লোক এসব কথা লিখে থাকেন তাহলে চাকরিদাতাদের তাকে বলা উচিত এমন লোক তাদের প্রয়োজন নেই। তিনি যা লিখেছেন তা যদি একটি বইয়ে আপনি প্রকাশ করেন তাহলে আপনাকে জরিমানা করা হবে। তাই আমি মনে করি ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোকে প্রকাশনা সংস্থার মতো দেখা উচিত।
ডেইলি মেইল লিখেছে, ইমরান মিয়া এনলাইটেন সাপ্লাই পুল লিমিটেডে একজন সাপ্লাই টিচার হিসেবে রেজিস্ট্রারড। গত সপ্তাহে ছদ্মবেশে ওই কোম্পানিতে হাজির হন সাংবাদিকরা। এ সময় তারা বলেছেন, ইমরান মিয়া সেখানে ‘টিচিং এসিসট্যান্ড’। তিনি এর আগে ক্লাস নিয়েছেন। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই কোম্পানিতে গিয়ে হাজির হন সাংবাদিকরা। এ সময় কোম্পানির একজন মুখপাত্র বলেছেন, তাদের তালিকায় রয়েছেন ইমরান মিয়া। তবে তাকে কোনো এসাইনমেন্ট দেয়া হয়নি। এরপর ইমরান মিয়ার মায়ের বাড়িতে এক ঘণ্টা অবস্থান করেন সাংবাদিকরা। তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে একজন যোগাযোগ করেন। তিনি নিজেকে ইমরান মিয়ার কাজিন পরিচয় দেন। বলেন, আমি আমার কাজিনকে যতটা জানি তাতে সে যা বলেছে তা সমর্থন করে না। এ সময় সাংবাদিকরা জানতে চান, তাহলে কেন তিনি সামাজিক মিডিয়ায় এমন জ্বালাময়ী পোস্ট দিয়েছেন। জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, সে এটা করেছে আমরা নিশ্চিত নই। এটা হতে পারে অন্য কেউ। এর দু’ঘণ্টা পরেই ইমরান মিয়ার ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামের অ্যাকাউন্ট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। শনিবার রাতেই ডেইলি মেইল ইমরান মিয়া সম্পর্কে এসব তথ্যপ্রমাণ পৌঁছে দেয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।