রোমাঞ্চ ছড়িয়ে ইংল্যান্ডের বিশ্বজয়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০১৯
আহবাব মোস্তফা খান ::
টেমসের পারে শেকসপিয়ার তার শেষ জীবনে কত ট্রাজিক কমেডি রচনা করেছিলেন। এই রচনাগুলি রোমান্স নামেও পরিচিত। ১৪ জুলাই লর্ডস ফাইনালে যা হলো তা যেন শেকসপিয়ারের সেই সব রোমান্সে ভরা রচনাগুলোকেও ছাড়িয়ে গেলো। কি এক ফাইনাল! পরতে পরতে উত্তেজনা, সেকেন্ডে সেকেন্ডে রোমাঞ্চ, বলে বলে ক্রিকেটের সুরভি। এমন সুরভিতে মখমলের চাদরের মতো মাঠ আর নীল নীলাকাশও যেন ভাসলো ইংলিশদের বিশ¡জয়ের উৎসবে।
দ্য হোম অব ক্রিকেটে শেষের হাসি কার। শিরোপার তাজ পরবে কে? এ নিয়ে গত ৪৬ দিন ধরে কত শত কোটি মানুষের চোখ লন্ডনে। ক্রিকেট যে পাবে এবার নতুন চ্যাম্পিয়ন। সেই অপেক্ষার হলো সমাপ্তি। শেষ ক্ষনে নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড রানের বন্যা না বইয়ে দিলেও উপহার দিলো ক্রিকেট রুপকথা। উপহার দিলো ক্রিকেট রোমান্টিকতা। আর এমন রোমান্টিকতা ও রুপকথায় ক্রিকেট পেলো তার নতুন রাজা। সেই রাজার নাম ইংল্যান্ড।
ক্রিকেটের ফাইনাল বলে কথা। এজন্যই খেলা শুরুর আগে কিছু ছোট ঘটনা আর ছোট ছোট দৃশ্যপট রোমাঞ্চ ছড়িয়ে যাবেনা তা কি হয়। মিষ্টি আলোয় ভরা পড়ন্ত বিকেলে আসন ছেড়ে সবাই দাড়ানো। ভিআইপি বক্স, প্রেস বক্স, গ্যালারী সবার দৃষ্টির বৃষ্টি ২২ গজে। ক্রিকেটের স্বপ্নপুরুষ শচিন, সাঙ্গকারা থেকে শুরু করে সাবেক তারারাও অবাক বিস্ময়ে ইতিহাসের সেরা মুহুর্তের অপেক্ষায়। কি হয়। শিরাপা তাসমান সাগরের পাড়ে না টেমসের তীরে। শেষ দুই বলে চাই ৩। একটু আগে ঠিক এই পরিস্থিতি থেকেই ইংল্যান্ড ম্যাচ জিততে পারেনি। টাই হয়েছে। আর্চারের সুপার ওভারের পঞ্চম বলে হল ১ রান। এরপর শেষ বলে নিউজিল্যান্ডের চাই ২ রান। মার্টিন গাপ্টিল মেরেই ছুটলেন দু’রানের জন্য। এবং এ বারও টাই! স্তব্ধ জনারন্য গ্যালারী। এ কোন উপন্যাসের চিত্র মঞ্চায়ন। এক রান নিয়ে রান আউট হয়ে গেলেন গাপ্টিল। সুপার ওভারেও দু’দলই ১৫। অথচ মুহুর্তেই টাই হওয়া মাচেও উড়ন্ত ভাসলেন স্টোকস। প্রথমে কেউ বুঝতেই পারেনি টাই হওয়া ম্যাচেও কেন তার সেলিব্রেশন! চোখে ধাধা মনে লাগলেও স্টোকসের এমন নির্ভয়ে সেলিব্রেশন একটু পরেই বলে দেয় ইংল্যান্ড সত্যিই জিতেছে। ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সুপার ওভারে টাই হলে কোন দল বেশি বাউন্ডারি মেরেছে, সেই হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড! যখনই ঘোষনা এলো আপন ঘরে ইংল্যান্ডেরই বিশ¡জয়। তখনই যেন নিরব স্তব্ধ গ্যালারী জেগে উঠলো, শুরু হলো ইংলিশ উল্লাস। গুধোলী বেলার রোদের আলোয়ও শুন্য আকাশে দেখা গেলো রঙ্গিন আতশবাজির ঝললাকানি।
আর তাতে নতুন রূপকথার সূচনা হল বিশ্বক্রিকেটে। যে দেশের মাটিতে ক্রিকেটের পথচলা শুরু সে দেশেই অধরা ছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব। ইংল্যান্ডবাসীর অধরা স্বপ্ন পূরণ করল ভিনদেশী মর্গ্যানরা। স্নায়ূর চাপ সামলে, নিখুঁত রণকৌশল অনুযায়ী খেলে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব পকেটে পুরল রানী ভিকটোরিয়ার দেশ। বোথাম, গ্যাটিং, গাওয়ার, স্ট্রসরা যা দিতে পারেননি, ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে সেই অধরা অলঙ্কার পরিয়ে দিলেন স্টোকস। শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। এই লর্ডসেই। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলে ইংল্যান্ড। ভিভ রিচার্ডস আর জোয়েল গার্নারের ক্যারিশমার কাছে সেবার হার মানতে হয়েছিল ইংরেজদের। এরপর বিশ্ব ক্রিকেটের আরও দুই বিখ্যাত স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলেছে তারা। একটি ১৯৮৭-র ইডেনে অপরটি ১৯৯২-এ মেলবোর্নে। কোনওটিতেই রোমান্স হয়নি, নাটকিয়তায় ভরিয়ে জয়ও আসেনি। ক্রিকেটে বিশ্বকাপ শিরোপার স্বপ্ন অধরাই ছিল ইংরেজদের। অবশেষে হল সেই স্বপ্নপূরণ। আর ফাইনালে সেই স্বপ্ন পূরণের কারিগর বেন স্টোকস এবং হোফ্রা আর্চার। স্টোকস দলকে হারের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। আর আর্চার সুপার ওভারে দলকে জেতালেন। এনে দিলেন স্বপ্নের শিরোপা।
এবারের ফইনালকে কি উপমা দেয়া যায় তাই নিয়েই এখন আলোচনা। গত ৪৪ বছরে যা হয়নি। এবার তাই হলো বিশ্বকাপ ফাইনালে। নির্ধারিত ওভার শেষে দুদলই করলো ২৪১। ফলে ইতিহাসে প্রথমবার হল সুপার ওভার। তাতেও ফয়সালা হল না। দু’দলই সুপার ওভারে তুলল ১৫ রান করে। কিন্তু, নির্ধারিত ওভারে বেশি বাউন্ডারি মারায় চ্যাম্পিয়ন হল ব্রিটিশরা। আর তাতে স্বপ্নের ফাইনালে স্বপ্নপূরণ। এমন শিরোপা জয়ে টুইটার ফেসবুক জুড়ে ঝড়। এ কেমন নিয়ম! ৪৬ দিনের ক্রিকেট যুদ্ধ কি বাউন্ডারিতেই সমাধান? ফাইনালে গ্যালারীজুড়ে ইন্ডিয়ান সমর্থকদের চোখে পড়েছে বেশী। খেলা শেষে যা বুঝা গেলো তাদের সবাই প্রায়ঞ্জ চেয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের হাতে যাক শিরোপা। এই তাদের অনেককে চিতকার করে বলতে শুনা গেলো কিউয়িদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। ম্যাচ টাই করেও জিতে গেল ইংল্যান্ড! কিন্তু কে বোঝাবে তাদের। নিয়মের বেড়াজালে যে আবেগের কোনও স্থান নেই। তাই তো মাত্র আটটা বাউন্ডারি বেশি মারার সৌজন্যে প্রথমবার বিশ্বকাপ ঘরে তুলল ইংল্যান্ড। তবে এমন নিয়মের বেড়াজাল আর হৃদয়ভাঙ্গা হারেও সেই স্ভাবসুলভ বিনয় কিউই অধিনায়কের। ম্যাচের শেষে পাঁচ আঙুলের নিচে হতাশা লুকিয়ে হাসলেন সৌজন্যের হাসি। বুঝিয়ে দিলেন নিয়মের কাছে আবেগের কোন স্থান নেই।
আসলে কাল দিনটা যে ছিলোনা নিউজিল্যান্ডের। ২০১৫ সালের তাসমান সাগরের পাড়ের হতাশা যেন সঙি হয়েই এসছিলো লর্ডসে। নইলে টানা দুইবার ফাইনালে গিয়েও কেন রানার্সআপ।ঞ্জ ইংরেজদের ২৪২ রানের টার্গেট খাতায় কলমে বিরাট কিছু না হলেও, বিশ্বকাপের মতো চাপের ম্যাচে তা যে যথেষ্ট কঠিন সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কঠিন টার্গেটের মোকাবিলা করতে গিয়েই ল্যাজে-গোবরে হতে হল ইংল্যান্ডকে। প্রথমে টপ অর্ডারের ব্যর্থতা। এরপর সেই নিভৃরতার প্রতীক জস বাটলার এবং বেন স্টোকস চোভ জুড়ানো এক ইনিংস খেলে ম্যাচে ফেরান ইংল্যান্ডকে।একটা সময় কার্যত অসম্ভব মনে হওয়া ম্যাচ শেষপর্যন্ত নাটকীয়ভাবেই বাঁচিয়ে আনলেন স্টোকস। তবে, এক্ষেত্রে ভাগ্যও যেন সহায়ক তাঁর। শেষ ওভারের চতুর্থ বলে গাপ্টিলের ওভার থ্রো স্টোকসের গায়ে লেগে যায় বাউন্ডারির বাইরে। ভাগ্যের জোরে ইংল্যান্ড উপহার পেয়ে যায় অতিরিক্ত ৪টি রান। শেষ দু’বলে দরকার ছিল ৩ রান। কিন্তু, বোলটের শেষ দু’বলে দুটো রান আউট আবার বদলে দেয় অঙ্ক। তখনও শুরু হয় নাটকীয়তা। শেষ পর্যন্ত বড় কিছু হয়নি। ইংল্যান্ডের ইনিংসও থামে ২৪১ রানেই।
ওদিকে, হৃদয়ভাঙ্গার দিনে উইলিয়াসন বিনয়ের হাসি হাসলেও জয়ের পর ক্ষমা চাইলেন স্টোকস। কেন ক্ষমা চাইলেন তাতে অবাক হতেই পারেন যে কেউ। মনে হতে পারে এই সৌজন্যতা জন্মমাটির প্রেমে। আসলে তা নয়। শেষ ওভারে তার গাযে লেগে একটি বাউন্ডারীর জন্যই তার এই ক্ষমা চাওয়া। জন্মামটির জন্য ভালোবাসার শেষটুকু ঢেলে দিয়ে স্টোকস বললেন, এটা আমি ইচ্ছাকৃত করিনি। এমনিতেই এটা লেগে চার হয়ে গেছে। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ১৯৯১ সালের ৪ জুন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্মেছিলেন স্টোকস। তবে বড় হয়ে ওঠা থেকে ক্রিকেট কেরিয়ার, পুরোটাই ইংল্যান্ডে। আর ভিনদেশে এসেই একটি স্বপ্ন শিরোপা উপহার দিলেন। দিলেন ক্রিকেট রুপকথার জন্ম। এটাকেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। নয়তো জন্মভুমিকে কি কেউ পরাজয় উপহার দেয়?
এদিকে, এমন এক ফাইনালের পর ক্রিকেটের জীবন্ত তারারাও আবেগের শেষটুকু ঢেলে দিচ্ছেন। ব্রায়ান লারা এক কথায় বললেন, ‘আহ এমন ফাইনাল’! ফাইনালের শেষ মুহূর্তগুলোর উত্তেজনা ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে যার কণ্ঠে হয়ে উঠেছিল আরও প্রানবন্ত, সেই ইয়ান স্মিথ পরে বলছিলেন, “শত শত বছরের ক্রিকেট ইতিহাস, নাটকীয়তায় এই ম্যাচের তুলনীয় আর কি আছে?” এই পশ্ন, এই কৌতূহল থাকার কথা বিশ্বজুড়ে আরও শত কোটি ক্রিকেট অনুসারীর। উত্তরগুলো শেষ পর্যন্ত গিয়ে হয়তো মিলবে একটি উপসংহারে, ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচ এটিই! হয়তো আরো ম্যাচ হবে। আরো রুপকথার জন্ম হবে। কিন্তু লর্ডসের এই ফাইনাল তারা ভরা রাতের মতো ঝলমল করবে ইতিহাসের সোনালী পাতায়..।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: নিউ জিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৪১/৮ (গাপটিল ১৯, নিকোলস ৫৫, উইলিয়ামসন ৩০, টেইলর ১৫, ল্যাথাম ৪৭, নিশাম ১৯, ডি গ্র্যান্ডহোম ১৬, স্যান্টনার ৫*, হেনরি ৪, বোলট ১*; ওকস ৯-০-৩৭-৩, আর্চার ১০-০-৪২-১, প্লাঙ্কেট ১০-০-৪২-৩, উড ১০-১-৪৯-১, রশিদ ৮-০-৩৯-০, স্টোকস ৩-০-২০-০)। ইংল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৪১ (রয় ১৭, বেয়ারস্টো ৩৬, রুট ৭, মর্গ্যান ৯, স্টোকস ৮৪*, বাটলার ৫৯, ওকস ২, প্লাঙ্কেট , আর্চার ০, রশিদ ০, উড ০; বোলট ১০-০-৬৭-০, হেনরি ১০-২-৪০-১, ডি গ্র্যান্ডহোম ১০-২-২৫-১, ফার্গুসন ১০-০-৫০-৩, নিশাম ৭-০-৪৩-৩, স্যান্টনার ৩-০-১১-০)। ফল: ম্যাচ ও সুপার ওভার টাই; বাউন্ডারিতে এগিয়ে থেকে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। ম্যান অব দা ম্যাচ: বেন স্টোকস। ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: কেন উইলিয়ামসন।