পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু: চার বছরেও বিচার পায়নি রায়হানের পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: চার বছরেও শেষ হয়নি সিলেটে পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ (৩২) হত্যার বিচার। গতকাল শুক্রবার আলোচিত সেই হত্যাকাণ্ডের ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর কারও সাক্ষী গ্রহণের প্রয়োজন নেই এবং আসামি পক্ষ কৌশলে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করছে বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আবুল ফজল চৌধুরী।
এর আগে ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্যাতন করা হয়। পরদিন সকালে সিলেট এম এজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
রায়হান আহমদ সিলেট নগরের আখালিয়া নেহারিপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনেই তার মৃত্যু হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলায় অভিযুক্ত এক পুলিশ সদস্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে রয়েছেন। আর আবদুল্লাহ আল নোমান এখনো পলাতক। বাকি চার আসামি জেলহাজতে রয়েছেন। আবদুল্লাহ আল নোমানের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও মালামাল ক্রোকের আদেশ তামিল করেছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একাধিক সাক্ষীকে আসামিপক্ষ পুনরায় জেরার মধ্য দিয়েই চলছে একের পর এক ধার্য তারিখ। সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে আদালত যখন আসামি পরীক্ষা করবেন; ঠিক তখন প্রধান আসামি দারোগা আকবর হোসেন ভূইয়ার পক্ষ থেকে আরেক আসামিকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হয়। ওই সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। দেশব্যাপী আলোচিত রায়হান হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির বদলে উল্টো আসামিপক্ষ বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, রায়হান আহমদকে হত্যার আগে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদ হোসেনের মোবাইল ফোন দিয়ে রায়হানের মায়ের কাছে কল দিয়ে টাকা দাবি করা হয়। মামলার সাক্ষী ওই কনস্টেবল তৌহিদকে এখন আবারও জেরা করতে চান আকবরের আইনজীবীরা। যদিও সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কনস্টেবল তৌহিদকে জেরা করা হয়েছিল। মামলার ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালত ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। গত বুধবার সিলেট মহানগর দায়রা জজ হাবিবুর রহমান চাঞ্চল্যকর এই মামলার আসামি পরীক্ষার দিন ধার্য ছিল। প্রধান আসামি দারোগা আকবরের পক্ষে কনস্টেবল তৌহিদকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হলে আদালত এটি মঞ্জুর করেন।
এদিকে জামিনে বেরিয়ে এসে আসামি এসআই হাসান উদ্দিন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। গেল চারটি ধার্য তারিখ ধরে তিনি আদালতে হাজির না হওয়ায় তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
আসামিদের মধ্যে আকবর হোসেন ভূঁইয়া, আশেকে এলাহী, টিটু চন্দ্র ও হারুনুর রশিদ সরাসরি রায়হান হত্যাকান্ডে অংশ নেন। হাসান উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ আল নোমান হত্যাকাণ্ডের আলামত নষ্ট করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আবুল ফজল চৌধুরী বলেন, ‘মামলায় ৬৯ জন সাক্ষী ছিল। এর মধ্যে ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আর কারও সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন নেই আমাদের। তবে হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আসামিরা মামলা দুর্বল করতে চেষ্টা করে। সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ যখন শেষ করা হয়ে আদালত যে ধার্য তারিখে আসামি পরীক্ষা করবেন তখনো আসামিপক্ষ এক সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। আদালত আসামিপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তারা আর কোনো সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করতে চান কিনা। আসামি পক্ষ জানিয়েছেন, শুধুমাত্র বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদ হোসেনকে তারা পুনরায় জেরা করবেন আর কোনো সাক্ষীকে পুনরায় জেরার আবেদন করবেন না। ইতিমধ্যে আসামিপক্ষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী সাক্ষীদের পুনরায় জেরা করেছেন। এ কারণেই মূলত দেরি হচ্ছে। পরে আসামিপক্ষের কোনো কাগজপত্র আর দেওয়ার থাকলে সেটা দেবেন। তারপর আরগুমেন্ট হবে, এরপরে রায় শোনানো হবে।’
এসআই হাসানের দেশ ছাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাসানতো গত তারিখে আদালতে হাজির হননি। দেশ ছাড়ার বিষয়ে বলতে পারছি না।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্যাতন করা হয়। ১১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রীর করা মামলার পর মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে। তাঁরা ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর পুলিশি হেফাজত থেকে কনস্টেবল হারুনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আকবরকে ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০২১ সালের ৫ মে আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পিবিআই। অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে (৩২) প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। অন্যরা হলেন—সহকারী উপপরিদর্শক আশেক এলাহী (৪৩), কনস্টেবল মো. হারুন অর রশিদ (৩২), টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), সাময়িক বরখাস্ত এসআই মো. হাসান উদ্দিন (৩২) ও এসআই আকবরের ঘনিষ্ঠজন ও সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমান (৩২)। ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়।