মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী- এক রূপান্তরিত জননেতা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মার্চ ২০২১
তাহমীম সৈয়দ হক :: তাঁর সাথে পরিচয়টা মনে হয় ১৯৯১ সালে। এরশাদ ক্ষমতা থেকে পড়ে গেছেন দেশে একটা ইলেকশন হবে সেই সময়টায়। লন্ডন থেকে তিনি দেশে চলে এসেছেন সেটেলড হবেন বলে। দলে টিকিট চান দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায়। দলে জায়গা পাচ্ছেন না। সেই সময়টা। দলের নমিনেশন বোর্ডে তখন আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, আমীর হোসেন আমুসহ সব জাদরেল নেতারা। নমিনেশন বোর্ডে সামাদ আজাদ তাঁকে প্রশ্ন করেন (শুনা কথা) সিলেটে তো জানি আমি এক সামাদ।
ফেঞ্চুগঞ্জে আবার আপনি নতুন কোন সামাদ! সে নির্বাচনে তিনি আর নমিনেশন পান নি। নৌকার প্রতীক পান গোলকাপ আতিক। মাহমুদ উস সামাদ স্বতন্ত্র দাঁড়ান। ৯১ সালের নির্বাচনে দল আর নৌকা হেরে যায় জাতীয়ভাবে। আর তাঁর আসনে জিতেন জাতীয় পার্টির নেতা মুকিত খান। তবে তিনি হাল ছাড়েন নি। ইচ্ছা করলেই জার্সি বদল করতে পারতেন। করেন নি। বলেছেন ছাত্রলীগ করে এসেছি। দল করলে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবো। তখন সামাদ আজাদ সাহেবের সাথে আমাদের পারিবারিক সখ্যতা। সামাদ আজাদ বিরোধী দলীয় উপনেতা হওয়ার দিন আমরা সবাই তখন ঢাকায়। ক্যাপিটাল হোটেলে উঠেছি। সকালে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি প্রয়াত আ.ন.ম শফিকুল হক, বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাশুক উদ্দিন আহমেদ এবং মাহমুদুস সাহেবের ভায়রা প্রয়াত সুয়েব আহমেদ চৌধুরী (বীর মুক্তিযোদ্ধা) আমার রুমে এসে বললেন, আমরা মাহমুদ উস সামাদ সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি। দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত। তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। মতিঝিল বলাকার পাশে গ্রাউন্ড ফ্লোরে তিনি তখন ফ্রাগ্নেস (পারফিউম) আমদানী ব্যবসা করেন। সেখানে তিনি আমাদের হাজির কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ান। আমার পড়াশুনার খবর নিলেন। নিজে বিজনেস এর ওপর অনার্স করেছেন, পরে ফেলোশীপ নিয়েছেন সেটি বললেন। যুক্তরাজ্যে লেখাপড়া শেষ করে দেশে তিনি রাজনীতি করতে এসেছেন শুনে একটু আশ্চর্য ও কৌতুহল অনুভব করছিলাম। এর পরে রাজনীতিতে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। জেলা কমিটি তাঁরে নেয় না। বলে থানা কমিটি হয়ে আসো। থানা কমিটি বলে ইউনিয়ন কমিটি হয়ে আসো। তারপরও তিনি হাল ছাড়েন না। যেখানে যে এলাকায় তিনি নির্বাচন করতে চান সেটা এক কঠিন জায়গা। শহরের মানুষ সিলেটি ভাষায় বলে ‘ওটা হপার’।
দলে জায়গা না পেয়ে এরপর ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে গড়ে তুলেন শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ। ঢাকায় রমনা ভবনের সামনে পার্টি অফিসে নিয়মিত যাওয়া আসা করতেন। তাঁর সঙ্গে থাকা বিশাল নিসান পেট্রোল গাড়ীটি বিখ্যাত হয়ে উঠে। চিন্তা করুন ৯১, ৯৬, ২০০১ তিনটি নির্বাচনেই তিনি স্বল্প ভোটে পরাজিত হয়েছেন। হাল ছাড়েননি, দল ছাড়েননি। প্রতিটা মিছিল মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। দলের বিভিন্ন প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে দিতেন। দলের বিভিন্ন দুঃসময়ে কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন। আমাদের প্রয়াত প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আনম শফিক ভাই অনেক দিন অসুস্থ ছিলেন বিছানায়। ঢাকায় নেত্রীর সাথে দেখা করতে গেলে নেত্রী শফিক ভাইকে বলেন, আপনার ব্যাপারে কয়েসকে বলে দিয়েছি। চেন্নাই যাওয়ার জন্য রেডি হন। আর এটাই আমাদের এমপি কয়েস। আমি তাঁর এই রূপান্তরটা কাছে থেকে দেখেছি। মাঝে মাঝে আশ্চর্য হই। এরই মধ্যে তিনি এমপি হয়েছেন কয়েকবার। দূর প্রবাস থেকে দেখি। এলাকায় ব্যাপক কাজ করিয়েছেন। আবার বিভিন্ন বিতর্কে তিনি পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন- এটাও সত্য।
এমনই একটা বিতর্ক হলো জাফর ইকবাল স্যারকে তিনি পেটাতে চেয়েছেন। বিশেষ করে সে সময় ফেসবুক কয়দিন গরম থাকে এই ইস্যুতে। তবে সিলেটে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নাকি সে সময় রেজুলেশন পাশ করে জাফর ইকবাল স্যার এর বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকাণ্ড নিয়ে ঝাড়ু মিছিল দেয়। আমি খুব জোরালো ভাষায় এর প্রতিবাদে ফেসবুকে কলম ধরি। মাহমুদ উস সামাদ সাহেব ছাড়াও যারা সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন তারা আমার বক্তব্যে সে সময় আহত হয়েছেন বুঝতে পারি। এই লেখার পরবর্তীতে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেন। বলেন, তাঁর এই কথা তিনি ওইভাবে বলেননি যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।
আরেকটা কথা এখানে বলে নেয়া ভাল যে, তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার ছিলেন। এমপি হিসেবে তিনি সিলেটকে রিপ্রেজেন্ট করছিলেন। সিলেটী ছাত্রছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে তাঁর একটা কঠোর অবস্থান ছিল। দ্বন্দ্বটা আসলে সেখান থেকেই। যে কোনো এমপি বা সিলেট অঞ্চলের কেউ দায়িত্বশীল থাকলে তাঁর অঞ্চলের ছাত্রছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে ভূমিকা রাখতেই পারেন। সিলেট বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে নয়। আর সিলেটে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে সিলেটিদের আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসও আমাদের ভুললে চলবে না । যাই হোক। করোনা মহামারির দুর্যোগময় সময়ে তিনি সবসময় জনগনের পাশে ছিলে। তাঁর বিশাল পুকুরের মাছ তুলে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন শুরু হওয়ার পর অন্য এমপিরা যখন ভয়ে ঘর থেকে বের হননি, তখন তিনি বাড়ি বাড়ি গেছেন বিরামহীনভাবে। আজ একজন বললেন, করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত তাঁর এলাকার অনেকের চাকরি চলে যায়। তাই বাড়ি বাড়ি হাহাকার পড়ে। এই হাহাকার যাতে তাঁর এলাকায় না হয় তাই একটি লিস্ট করে নিয়মিত ভাতা পাঠিয়ে দিতেন মানুষের ঘরে ঘরে। আমার কাছে তাঁর এই রূপান্তর গুলি স্টোরি টেলারের মতো বলতে ইচ্ছে করে।
হজ বিষয় সংসদীয় কমিটির প্রধান হিসেবে ধর্মমন্ত্রীর পাশে বসে স্বপ্রণোদিত হয়ে মক্কায় সিলেটি মানুষের খোঁজ খবর নিতেন বলে জানিয়েছেন আমার বন্ধু মাওলানা সোয়েব। তিনি যে গণমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন- তাঁর জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি তারই উজ্জল দৃষ্টান্ত। মানুষকে ভালবাসলে মানুষের ভালবাসা মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়।
লেখক: সৈয়দ হক তাহমীম,
বৃটিশ-বাংলাদেশী আইনজীবী,
লেস্টারশায়ার, যুক্তরাজ্য।