আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস : শ্রমিকদের দাবী আদায় আন্দোলনের পূর্বাপর ইতিহাস এবং প্রসঙ্গ কথা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মে ২০২২
ডক্টর আনিছুর রহমান আনিছ:: ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমিকের অধিকার রক্ষা এবং শ্রমিকের প্রতি মর্যাদা এবং সম্মান প্রদান করার জন্য মে দিবস পালন করা হয়। তৎকালীন সময়ে শ্রমিকের উপর অত্যাচার এবং বর্বর আচরণ করা হতো। ঠিকমতো তাদের বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হতো না, তাই শ্রমিকরা এক সময় রাজপথে নেমে আসে এবং আন্দোলন করে। তাদের এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী সকল শ্রমিকরা গর্জে ওঠে এবং তাদের দাবি আদায় করে নেয়।
১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছিল শ্রমিকেরা। শাসক মালিকগোষ্ঠীর হিংস আক্রমণে সভ্যতার নির্মাতা শ্রমিকের তাজা রক্ত ঝরেছিল সেদিন। অধিকার আদায়ের স্বার্থে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তারা। ১ মে থেকে চারদিনের বেদনাবহ ও গৌরবময় ঘটনাবলি স্মরণে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর শ্রমিকদের মিছিল-সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিনটি অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে।
এই দিনটিকে বা বিশ্ব শ্রমিক দিবস বা শ্রমিক দিবস যে নামেই ডাকা হোক না কেন এই দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকেরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে যেসকল শ্রমিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন বা করছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান সংহতি জানানোর উদ্যেশ্যে পালন করা হয়ে থাকে। ১৯০৪ এ দিবসটি বর্তমান পর্যন্ত পালন হয়ে আসছে।
১৮৮৬ সালে ১লা মে আমেরিকার শ্রমিকেরা দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজের স্থলে ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে শিকাগো শহরে ধর্মঘটের ডাক দেন। ৪ঠা মে শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য পুলিশের উপস্থিতিতে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় ওই সমাবেশে অজ্ঞাত এক বোমা বিস্ফোরণের ফলে একজন পুলিশের মৃত্যু হয়। আর সেই পুলিশের মৃত্যু কে কেন্দ্র করে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় এবং সেই সময় অনেক শ্রমিক নিহত হন। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি এবং হয়ে থাকে এবং তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অটল থাকেন। তাই তাদের দাবি দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ, শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং তাদের কে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক বছর ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
বিশ্বের ইতিহাসে শ্রমিকদের উপর অত্যাচার নির্যাতনসহ নানাধরনের অমানবিক আচরণ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ১৮০৬ সাল। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মামলা চলছে ফিলাডেলফিয়ার ধর্মঘটী জুতা শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে। এই মামলায় ফাঁস হয়ে গেলো যে, কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের ঊনিশ থেকে বিশ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটিয়ে মারে। তখনকার প্রচলিত অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী দিনের কাজের ঘণ্টা হচ্ছে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এর প্রতিবাদে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকেই প্রতিবাদ জানায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা। ১৮২০ সাল। আমেরিকায় বিভিন্ন শহরে ছোট-ছোট স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো একত্র করে একটা ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করা হয়। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ধরে কাজের ঘণ্টা কমাবার দাবিতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট চলতে থাকে। অনেক শিল্পকেন্দ্রে দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজের নিয়ম চালু করার সুনির্দিষ্ট দাবি তোলা হয়। ১৮২৭ সালে বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম হয় ফিলাডেলফিয়ার গৃহনির্মাণ শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের উদ্যোগে। ওই শ্রমিকরা তখন দৈনিক দশ ঘণ্টার দাবিতে ধর্মঘটে ছিলেন। ১৮৩৪ সালে নিউইয়র্কে রুটি শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। এ ব্যাপারে ‘ওয়ার্কিং মেনস অ্যাডভোকেট’ এ লেখা হয়, ‘মিসরে যে ক্রীতদাস ব্যবস্থা চালু আছে তার চাইতেও দুঃসহ অবস্থার মধ্যে রুটি কারখানার কারিগররা বছরের পর বছর শ্রমিকদের খাটাচ্ছেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে আঠারো থেকে বিশ ঘণ্টা ওদের খাটতে হয়।’
দৈনিক দশ ঘণ্টার দাবি খুব দ্রুত আন্দোলনের আকার ধারণ করে। ফলে ১৮৩৭ সালের মন্দার সময়েও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সরকারি কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের জন্য দশ ঘণ্টা রোজ বেঁধে দেয়। পরবর্তী বছরগুলোতে বেসরকারি শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এই আইন কার্যকর করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চলতে থাকে। দৈনিক দশ ঘণ্টা কাজের সময়, শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা, দেনা শোধ করতে না পারলে শ্রমিকদের জেলে পাঠানোর আইনের বিলুপ্তি, অপ্রাপ্ত বয়সী ও মহিলা শ্রমিকদের কাজের ও মজুরির সুযোগ-সুবিধা প্রদান প্রভৃতি দাবিতে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। কিন্তু সংগঠনের দুর্বলতা, নেতাদের মধ্যে মতভেদ এবং ১৮৩৭ সালের মন্দার কারণে ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৫০ সালের দিকে অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা উন্নতি দেখা দেয় এবং শ্রমিকরাও তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে। সর্বত্র শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ায় প্রবল উদ্যোগ দেখা দেয়। এই সময় থেকে শ্রমিকরা দশ ঘণ্টার জায়গায় আট ঘণ্টা রোজের দাবি তোলেন এবং আমেরিকাসহ সকল উদীয়মান পুঁজিবাদী দেশে আট ঘণ্টা রোজের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১৮৬১ সাল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ প্রায় সকল সক্ষম পুরুষই যুদ্ধক্ষেত্রে। কল-কারখানার শ্রমিকের অভাব। অর্থ কষ্টের কবলে শ্রমজীবী পরিবারগুলো। যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে কল-কারখানা চালু রাখা চাই। মেয়েরা, শিশুরা জীবিকার তাগিদে দলে-দলে কল-কারখানায় কাজ নিতে থাকল। এই সুযোগে মালিকেরা তাদের শোষণ ও অত্যাচার বাড়িয়ে যেতে থাকল। যুদ্ধের অজুহাতে শ্রমিকদের অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার অজুহাতে এই নারী ও শিশু শ্রমিকদের অত্যন্ত কম মজুরি দিয়ে যথাসম্ভব বেশি খাটিয়ে নিয়ে মালিকেরা লাভবান হতে থাকে। ফলে ১৮৬২ সালের শেষের দিকে বিভিন্ন কল-কারখানায় শুরু হয় ধর্মঘট এবং উৎপাদনে অসহযোগ। এই বিছিন্ন ধর্মঘটগুলোর মাধ্যমেই আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত প্রতিরোধের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৮৬৬ সাল। ১ মে দিনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরের ২০ আগস্ট আমেরিকায় ৬০টি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা বাল্টিমোরে মিলিত হলেন। প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন। তখন থেকেই লন্ডনে ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ এর সাধারণ পরিষদের সাথে ইউনিয়নের গভীর সখ্যতা ও নৈকট্য গড়ে ওঠে। এই সময়েই সর্বপ্রথম আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি ওঠে।
১৮৭০-এর দিকে সারা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, বাণিজ্যিক মন্দা। মন্দার অজুহাতে মালিকরা মজুরি কমানো, শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রম ঘণ্টা বাড়ানো প্রভৃতি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকল। শ্রমিকরাও এইসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন শুরু করেন। কাজের ঘণ্টা কমাবার আন্দোলন এই সময়কার বেকারত্ব ও দুঃসহ-দুরবস্থার কারণে আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ওদিকে মিল মালিক শিল্পপতিরা শ্রমিক সংগঠনগুলো ধ্বংস করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে প্রচণ্ডভাবে। লেন্সের জানিয়ায় কয়লাখনি মালিকরা ১৮৭৫ সালে খনি অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের সংগঠন উচ্ছেদ করার ইচ্ছায় দশজন সংগ্রামী খনি শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝোলায়। এর পরিণতিতে ১৮৭৭ সালের রেল ও ইস্পাত ধর্মঘট অভ‚তপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ১৮৮০ সাল থেকে ১৮৯০। এই দশ বছরে মার্কিন শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাজারের অভ‚তপূর্ব বিকাশ ঘটে। তবে এরই মধ্যে ১৮৮৪-৮৫ সালে আবারও মন্দার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন সংক্ষেপে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ এর জন্ম হয়। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর এই সংগঠনের চতুর্থ সম্মেলনের একটি প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৮৮৬ সালের ১-মে থেকে দৈনিক আট ঘণ্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে।
১৮৮৫ সালে ফেডারেশন-এর সম্মেলন থেকে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো, পরবর্তী বছর প্রথম ধর্মঘট করে বেরিয়ে আসা হবে। কয়েকটি জাতীয় ইউনিয়ন আসন্ন সংগ্রামের জন্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আট ঘণ্টা কাজের জন্য আন্দোলনের সূচনা করেছিল ফেডারেশন। ধর্মঘটের তারিখও ঠিক করেছিল এই সংগঠন। ফলে এর সদস্য সংখ্যাও দ্রুত বাড়তে থাকে। ধর্মঘটের দিনটি দ্রæত ঘনিয়ে আসছে। এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছে আট ঘণ্টা শ্রম সমিতি। অসংগঠিত শ্রমিকরাও দ্রæত সংগঠনভুক্ত হচ্ছে।
রক্তে রাঙানো দিনগুলো ১-মে ১৮৮৬। শনিবার। সমগ্র শিকাগো শহর নিস্তব্ধ। চালু নেই কোনো কল-কারখানা। মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্মঘটী শ্রমিকরা। মিছিল যাবে মিশিগান এভিনিউ দিয়ে লেক ফ্রন্টের দিকে। ছয় লাখ শ্রমিক জড়ো হয়েছে। তালা ঝুলছে ১৫৭২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে। ১১ হাজার ৫শ’ ৬২টি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। সরকার ও মিল মালিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করল মিছিল বন্ধ করবার জন্য। কাগজগুলোর মাধ্যমে আগেই গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, শ্রমিকরা ধর্মঘট ও মিছিলের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও লুটতরাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সশস্ত্র পুলিশ ও গুণ্ডা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে শ্রমিক ও জনসাধারণের মিছিলে অংশগ্রহণ রোধ করার জন্য। কিন্তু সরকার, মালিকগণ এবং কাগজওয়ালাদের সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল এগিয়ে চলেছে মিশিগান এভিনিউর দিকে। শ্রমিক নেতা পারসনস ও স্পাইজের নেতৃত্বে। লেক ফ্রন্টে প্রায় এক লাখ শ্রমিকের সমাবেশে সাফল্যের জন্য শ্রমিকদের অভিনন্দন জানালেন। মিল মালিক ও কাগজওয়ালাদের গুজব সত্তে¡ও কোথাও কোনো অশান্তি ঘটল না। শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো শ্রমিকদের মিছিল ও সমাবেশ। পরের দিন রবিবার। ছুটির দিন। কোনো ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে কেটে গেল দিনটি। কিন্তু ৩-মে সোমবার আবার কারখানায়-কারখানায় শুরু হলো ধর্মঘট। উসকানি ও সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ দ্বারা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার ও মালিক পক্ষ। ম্যাক কর্মিক হারভেস্টার নামক লকআউট কারখানার সামনে
সমবেত শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ গুণ্ডারা। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ছয়জন শ্রমিক। পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণে আহত হলো অগণিত শ্রমিক। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শিকাগোর হে মার্কেটে প্রতিবাদ সভা ডাকা হলো ৪ মে। গত দিনের শ্রমিক হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ঘটল। ঘাবড়ে গেল মালিক পক্ষ। যে-কোনো মূল্যে প্রতিবাদ সভা বানচাল এবং ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংহতি ও সংগ্রামী চেতনাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত করল প্রশাসন যন্ত্রকে, ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীকে। শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে প্রতিবাদ সভা। শেষ বক্তা ফিল্ডেন উঠেছেন বক্ততা করতে। তখন রাত প্রায় ১০টা। শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে জনসভা তখনই ভেঙে দেয়ার নির্দেশ নিয়ে উপস্থিত হলেন শিকাগো পুলিশের বড় কর্তা। প্রতিবাদ করলেন শ্রমিক নেতারা। পুলিশের সাথে শ্রমিক নেতাদের কথা কাটাকাটির সুযোগ গুণ্ডারা সভার বিভিন্ন অংশে বোমা ফাটাতে শুরু করে। শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি। ভিড়ের মধ্যে একটি বোমা এসে পড়ে এবং তার আঘাতে নিহত হন একজন সার্জেন্ট। সাথে সাথেই বেধে যায় লড়াই। রক্তের বন্যা বয়ে যায় হে মার্কেটে। এই দিনে নিহত হয় সাতজন পুলিশ, চার জন শ্রমিক। স্পাইচ এবং ফিল্ডেনকে সভাস্থলেই গ্রেফতার করা হয়, দাঙ্গা-হাঙ্গামার দায়ে। আরো গ্রেফতার হলেন মাইকেল মোয়া, জর্জ এঞ্জল, এডলফ ফিশার, লই কিং ও অস্কার নীবে। ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে শিকাগোর সেই শ্রম বিপ্লবে নিহতদের প্রতি আজও সংহতি প্রকাশ করে চলেছেন সারা বিশ্বের শ্রমজীবী, পেশাজীবি ও কর্মজীবী মানুষেরা।
১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কে উদ্দেশ্য করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় আর সে প্রস্তাবটি হচ্ছে শ্রমিকের দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণ এবং শ্রমিকদের যথাযথ সম্মান এবং পারিশ্রমিক দেয়া। আর এই প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী মে দিবস পালিত হয়ে আসছে বর্তমান পর্যন্ত। আর যখন মে দিবস চলে আসে তখন বিভিন্ন দেশের শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠনগুলো বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে থাকে এবং যে সকল শ্রমিকদের প্রাণহানির কারণে বর্তমানে শ্রমিকরা সম্মান পাচ্ছে সে সকল শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সম্মান জানিয়ে এ দিবস পালন করা হয়।
বাংলাদেশে মে দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার ফলে এ দিবসকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেইসাথে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাগুলো এই দিনটি পালন করার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয় এবং সেইসাথে শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সংস্কৃতি অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে।
ডক্টর আনিছুর রহমান আনিছ
সাবেক লেকচারার, আইন গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
বিশেষ প্রতিনিধিঃ সাপ্তাহিক বাংলা সংলাপ, লন্ডন
E:anisphd@yahoo.com