কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা: ‘মায়ের মাথা পাচ্ছি না, কেউ আমার মায়েরে তোলো’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০১৯
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার এক ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন কামরুল ইসলাম মামুন নামের এক তরুণ। তিনিও দুর্ঘটনার শিকার। তবে ভাগ্যগুণে তিনি বেঁচে যান।
ট্রেনটি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর কামরুল ইসলাম মামুন তার ফেসবুক ওয়ালে তিনটি স্ট্যাটাস দেন। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনার পরপরই। দ্বিতীয়টি দেন সোমবার (২৪ জুন) সকালে এবং তৃতীয়টি বিকেলে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, রোববার (২৩ জুন) রাতের এ দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে কামরুল ইসলাম মামুন তার ফেসবুকের তৃতীয় স্ট্যাটাসে প্রশ্ন তুলেছেন। তার দাবি, নিহতের সংখ্যা আরও বেশি।
‘একটা ট্রেন দুর্ঘটনার আর্তনাদ এবং আমার নতুন জীবন’ শিরোনামের দ্বিতীয় স্ট্যাটাসে তিনি দিয়েছেন দুর্ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-
“সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার বাসপথে ব্রিজভাঙা সেই সাথে অতিরিক্ত জ্যাম থাকায় বাধ্য হয়ে ২৫০ টাকার টিকিট ৫০০ টাকা দিয়ে কেন ট্রেনপথে রওনা দিলাম। রাত ১০টায় সিলেট থেকে ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলো। তখন আমার টিকিটের গায়ে ‘এক্সট্রা-৫’ লেখা দেখে আমার পাশের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম এই লেখার মানে কী? এক্সট্রা বগি অ্যাড করা হয়েছে কি না? এই ভদ্রলোক বলল, অতিরিক্ত লাভের আশায় ৫-৬টা বগি লাগানো হয়েছে। বাসপথে জ্যাম থাকায় ট্রেনে ভিড় প্রচুর। এখন একটু অবাক হলাম! ২৫০ টাকার টিকিট ৫০০ করে বিক্রি করছে তাও আবার অতিরিক্ত মানুষ নেয়ার জন্য ৫-৬টা বগি এক্সট্রা লাগাইছে বিষয়টা বেশি হয়ে গেল না?? প্রশাসন তাদের কোনো খোঁজ-খবর নেয় না?
যাক! ট্রেন চলছে। আমার পাশের সিটে একজন সিলেটের বড় ভাই ছিল। আমি ছিলাম জানালার পাশে। আমার বাম পাশের জানালার পাশে একজন ভদ্র মহিলা এবং উনার মেয়ে, উনার পাশে একজন বয়স্ক লোক এবং অনেকগুলো মানুষ দাঁড়ানো, আমার ঠিক পেছনেও অনেকগুলো মানুষ দুই বগির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এক্সট্রা-৫ বগির ৬০ নম্বর অর্থাৎ সর্বশেষ সিটে। বরমচাল, কুলাউড়া এসে একটা কালভার্ট পড়ে ওইখানে আসতেই এক্সট্রা-৪ থেকে অর্থাৎ আমার সামনের বগি, আমার বগি এবং পেছনের বগি ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ট্রেনের নিচে ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট হওয়া আগুন দেখে আমরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই, বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে!! কী করব! সব তিন-চার সেকেন্ড এর মাঝে হয়ে গেল। এই সময় ট্রেনের ওভার গতি ছিল। ১৪০-১৫০ কিমির (আনুমানিক) মতো হবে। আমাদের বগিটা এপাশ-ওপাশ হয়ে বড় একটা ধাক্কা খেল। ঠিক তখনই আমি বুঝলাম, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না একদম। ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে।
আল্লাহ সহায় ছিল। আমি যে পাশে ছিলাম এই পাশটা মাটিতে লেগে যাবে লেগে যাবে মনে হচ্ছে। যদি আমার পাশটা মাটিতে লাগতো তাহলে আমি সবার নিচে পড়ে যেতাম, তখন হয়তো খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারত। তখন একটা বড় ধাক্কা খেয়ে আমার বামপাশটা উল্টে যায়। যেহেতু আমি বিপরীত দিকের জানালায় তাই আমি সবার উপরে এসে পড়লাম। একপাশে আগুন জ্বলছিল। আমি সাথে সাথে লাফ দিয়ে ট্রেনের একটা অংশে ধরলাম কিন্তু আবার পড়ে গেলাম। ভাগ্য ভালো ছিল আমার একজনের মাথায় পড়ি। তখন হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। আমি একজনের মাথায় পা থেকে আবার লাফ দিলাম এবং জানালাটা ধরতে সক্ষম হই। জানালা দিয়ে বের হয়ে দেখি আমার পেছনের বগিটা পানিতে পড়ে আছে। আমি যেটাতে ছিলাম এইটা আর আমার সামনের বগিটা উল্টে আছে। মাটিতে নেমে আসলাম। আমার হাত-পা কাঁপছিল, মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। ব্যাগটা ট্রেনেই ছিল, আমি কোনো রকম নিজের জীবন নিয়ে বের হয়ে আসি। ব্যাগে কিছু দরকারি কাগজ আর অনেকগুলো টাকা ছিল তাই ভাবলাম ব্যাগটা আনা যায় কি না। আর সবচেয়ে বাজে সময়টা তখনই।
আমি ট্রেনের পাশে এসে দেখি আমার পেছনে যে ছেলেগুলো ছিল তার মাঝে একজন দুই বগির নিচে পড়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ লোকটার হাত কেটে পড়ে গেছে, বাম পাশের মহিলার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। উনার মেয়ে বডিটা নিয়ে চিৎকার করছে, আমার মায়ের মাথা পাচ্ছি না, কেউ আমার মায়েরে তোলো; মেয়েটা তার মায়ের মাথা খুঁজছে, সামনের একজনও বগির নিচে পড়ে গেছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আজ যদি আমার পাশটা নিচে পড়তো তাহলে হয়তো ওই মহিলার জায়গায় আমার বডিটা থাকত। আল্লাহ সহায় ছিল। আমি একটা খালি জায়গায় গেলাম। তারপর ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, গ্রামের লোকজন সবাই আসল। একের পর একজন বের করছিল। কারও হাত নাই, পা নাই, কেউ মৃত, আবার কেউবা মারাত্মক আহত। কয়েকটা লাশ বস্তায় করে বের করতে দেখলাম। এই লাশগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ২০ মিনিটের ভেতরে ২১টা লাশ (এলাকার কয়জন বলল) বের করল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কী করব! কী করা উচিত আমার। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই পাঁচটা মিনিট আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়। তিন বগিতে ৩০০ জনের উপরে ছিল। তার মাঝে হাতেগোনা কয়জন সুস্থ অবস্থায় বের হয়ে আসছে। আল্লাহ সহায়, তার মাঝে আমি একজন।
হয়তো অতিরিক্ত বগি লাগানোর কারণেই এই দুর্ঘটনার জন্ম। তাদের কয়টা টাকার জন্যই হয়তো আজ এতগুলো প্রাণ গেল, এতগুলো মানুষ আহত হলো। আর ট্রেনের ওভারলোড তার একটা কারণ হয়তে পারে। আল্লাহর রহমতে আমি সুস্থ অবস্থায় রাত ৩টা ৩০ মিনিটের দিকে সিলেট আসছি। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন। আমার কানে যেন এখন আর্তনাদের চিৎকারগুলো শুনছি, আমার চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে। যেন এখনও আমি মেয়েটার চিৎকার শুনতে পাই, আমার মায়েরে তুলো, আমি মায়ের মাথা পাচ্ছি না।”