সিলেটের রাজনীতি সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকুক যুগযুগ ধরে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ আগস্ট ২০১৮
তাইসির মাহমুদ:
দল মত, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সিলেটের মানুষের মধ্যকার পারস্পারিক সর্ম্পক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে। যতই মতপার্থক্য বা হানাহানি হোক সামনা-সামনি একে অপরকে সম্মান করেন, শ্রদ্ধা করেন।
সিলেট সিটি নির্বাচন এর একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ও বদর উদ্দিন কামরান কেউ কাউকে নির্বাচনী মাঠে সামনা-সামনি বিষোদগার করতে দেখিনি। বরং একে অপরকে দেখলে জড়িয়ে ধরেছেন। হাসি মুখে কথা বলেছেন।
নির্বাচনের পরেও একই পরিবেশ দেখা গেলো। বিজয়ের পর নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সরাসরি চলে গেলেন বিজিত প্রার্থী বদর উদ্দিন কামরানের বাসায়। আপন করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও মিসেস কামরান দুজনেই আরিফুল হক চৌধুরীকে স্বাগত জানালেন। জ্ঞাপন করলেন অভিনন্দন ও অভিবাদন। আরিফুল হক চৌধুরীর আগমনী বার্তা শুনে বদর উদ্দিন কামরান ঘরের পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাননি।
আজকের এই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সম্পর্কের দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দিলো ২০০৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটির প্রথম নির্বাচন পরবর্তী এমনই একটি ঘটনা। ওই নির্বাচনের সময় আমি সিলেটে ছিলাম। মিডিয়ালাইন নামে একটি সংবাদ সংস্থার কর্ণধার থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও বিএনপির প্রার্থী এম এ হক এর পুরো নির্বাচনী সংবাদ কাভারেরর দায়িত্ব ছিলো আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর। তাই নির্বাচনে দুই প্রার্থীরই কাছাকাছি ছিলাম। একটু বেশি ঘনিষ্ট ছিলাম মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের সঙ্গে।
বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। তখন এম সাইফুর রহমান ছিলেন অর্থমন্ত্রী। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ হককে জেতাতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন। অনেক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। জিতেছেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।
গত ৩০ জুলাই যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী বিজয়ী হলেন, ঠিক ওই সময় বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বিজয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনের পরে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সাথে ভালো সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বদর উদ্দিন কামরান অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে সম্মান করতেন। অর্থমন্ত্রীও বদর উদ্দিন কামরানকে স্নেহ করতেন। তবে বদর উদ্দিন কামরানকে এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে তীর্যক মন্তব্য শুনতে দেখেছি। দলের মধ্যে একটি বলয় ছিলো কামরান বিরোধী। তারা তাঁর এগিয়ে যাওয়ায় ইর্ষাকাতর ছিলো। ওই বলয়টি এখনও আছে। যারা নির্বাচনী মাঠে লাভের চেয়ে ক্ষতিই করে থাকে বেশি। কীভাবে করে সেটা খুব কাছে থেকেই দেখেছি।
সে যাক। আমি বলছিলাম, সম্প্রীতির সম্পর্কের কথা। ২০০৩ সালের মেয়র নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পরদিন সন্ধ্যায় মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য গিয়েছিলেন অপর দুই প্রার্থীর বাসায়। প্রথমে গিয়েছিলেন ধোপাদীঘির পারে সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আফম কামাল এর বাসায়। তিনিও ওই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। আফম কামাল বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে জড়িয়ে ধরেন। চা-নাস্তায় আপ্যায়ন করেন। তাকে অভিবাদন ও অভিনন্দন জানান।
এরপর তিনি চলে যান শহরের যতরপুরে জেলা বিএনপির সভাপতি বিএনপির মেয়র প্রার্থী এম এ হক এর বাসায়। তবে এম এ হক কিছুটা অসুস্থ হয়ে শোয়ে পড়ায় কিছুক্ষন সিটিংরুমে বসে স্বজনদের সাথে কথা বলে চা-নাশতা খেয়ে চলে আসেন বদর উদ্দিন কামরান। আমি সঙ্গেই ছিলাম। তাই সম্প্রীতির এই দৃষ্টানের স্বাক্ষী থেকে যাই।
আজ ১৫ বছর পর লন্ডনে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই দৃশ্য দেখে প্রাণটি ভরে গেলো। সিলেটের রাজনীতিতে সম্প্রীতির বাঁধন যেনো যুগযুগ ধরে এভাবে অটুক থাকে। সিলেট বিশ্বে একটি সম্প্রীতির শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করুক- এই শুভ প্রত্যাশা। অভিনন্দন দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। ধন্যবাদ বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে- নির্বাচনে পরাজয়ের কষ্ট চেপে বিজয়ী প্রার্থীকে বুকে জড়িয়ে ধরে মহান হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য। সিলেটের মানুষের মধ্যকার সম্প্রীতি অমর হোক।
তাইসির মাহমুদ
সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
৩১ জুলাই ২০১৮