৫ দিন ধরে দু’ভাইয়ের কাঁধে বোন ছেনুয়ারা
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০১৭
দেশ, ১ অক্টোবর: প্রতিবন্ধী ছেনুয়ারা বেগম (২৫)। বোনকে বাঁচাতে রাখাইনের বুছিডং থানার চৌপ্রাং থেকে কাঁধে নিয়ে দুইভাই জোনাইদ (২১) ও আমির হাকিম (২৪) ২৪শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে ব্রিজঢালা নামক বড় পাহাড়। অতিক্রম করতে হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এত কষ্টেও প্রতিবন্ধী বোনকে তাদের বোঝা মনে হয়নি। সঙ্গে নিয়ে আসেনি কোনো প্রয়োজনীয় মালামাল। রক্তের বাঁধন তাদের পৃথক করতে পারেনি। ভাই বোনের এ বন্ধন দৃশ্য সীমান্ত নগরী টেকনাফের মানুষের ক্ষণিকের জন্য হলেও হৃদয় ছুঁয়েছে।
গতকাল হয় টেকনাফ স্টেশনে ভাই আমির হাকিমের সঙ্গে কথা হয়। বলেন, বোনকে কাঁধে করে ৫ দিন ধরে পাহাড়ি পথ ও গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছি। নাফ নদ হয়ে নাইট্যংপাড়া সীমান্ত দিয়ে এপারে আসতে সক্ষম হয়েছি। ঘাটের মাঝিকে প্রতিবন্ধী বোনের জন্য ৪০ হাজার কিয়াত দিতে হয়েছে।
তিনি জানান, জন্ম থেকে তার বোন ছেনুয়ারা প্রতিবন্ধী ছিল না। বয়স ১৬ এর কাছাকাছি অবস্থায় ধীরে ধীরে অচল হয়ে যায়। প্রায় ৬ বছর ধরে একদম হাঁটতে পারে না। ছেনুয়ারা তাদের একমাত্র আদরের বোন। তাকে কাঁধে করে হাঁটতে হলেও এতটুকু কষ্ট লাগেনি বলেও জানায়।
সূত্র জানায়, হঠাৎ করে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের হার বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে অনুপ্রবেশের সংখ্যা কমলেও শুক্রবার থেকে অনুপ্রবেশের ঢল চোখে পড়ার মতো। টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গা রাতের বেলায় নাফ নদ পেরিয়ে এদেশে পালিয়ে আসছে। বিশেষ করে শাহপরীরদ্বীপ, টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়া, হ্নীলার জাদিমুরা সীমান্ত পয়েন্ট ও বাহারছড়ার শামলাপুর সৈকত এলাকা দিয়ে দলে দলে ঢুকছে এসব রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫শে আগস্টে রাখাইনে সহিংসতা শুরু হলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন, হত্যা, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করত বর্মী সেনারা। এখন নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ হলেও বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ থেমে নেই। হঠাৎ করে সেনারা এসে হ্যান্ড মাইকিং করে মানুষদের ঘর থেকে বের হতে বলে এবং পরে অগ্নিসংযোগ করে চলে যায়। এসময় আতংকে মানুষ এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে ছুটতে থাকে।
আবার অনেক গ্রাম কোটি কিয়াতের (মিয়ানমারের মুদ্রার নাম) বিনিময়ে অগ্নিসংযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে। মংডুর রাম্যবিলের মোহাম্মদ আলম জানিয়েছেন, তাদের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। কিন্তু তারা ১২টি পরিবার রয়ে যায়। এক মিলিটারি অফিসার ওই ১২ পরিবারকে ডেকে ঘর ছেড়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করতে একদিনের সময় দেয়। পরেরদিন তাদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে। তারাও বাধ্য হয়ে এদেশে পালিয়ে আসে।
মো. সলিম জানায়, ফেরাংপ্রু পৌঁছলে সেনাবাহিনী তাদের ৫ দিন আটক করে রাখে। এসময় তাদের কোনো খাদ্য দেয়নি। পাশের এক মুসলিম বিত্তবান ব্যক্তি শুকনো খাবার ও ভাত দিয়েছে। ৫ দিন পর সেনারা তাদের কিছু না বলে অন্যত্র চলে গেলে তারা দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে রাতের বেলায় নাফ নদ পেরিয়ে এক নৌকায় ৮০ জন পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তিনি জানান, ১৩ দিন আগে প্রায় দেড় হাজারের মতো মহিলাদের ধরে নিয়ে নেম্রে স্কুলে বন্দি করে রাখে। এর মধ্যে তার আপন খালা দিলমাস বেগম (৩৫) রয়েছে। কোনো পুরুষ এর আশপাশে দেখলে গুলি ছুড়ে এবং আটক করে নিয়ে যায়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বন্দি রাখার পর এক সেনা অফিসার এসে ছেড়ে দেয়। একই থানার চৌপ্রাং গ্রামের জোনাইদ জানান, রাখাইনে কোনো কাজ কর্ম নেই। সবদিকে হাহাকার। অনেক গ্রাম ভস্মীভূত হয়ে আঙ্গারে পরিণত হয়েছে। আবার অনেক গ্রামে বাড়িঘর থাকলেও জনমানব শূন্য। যেন ভুতুড়ে নগরী। বাড়িতে জমানো যা ছিল তা দিয়ে এতদিন পর্যন্ত খেতে পেরেছি। সেনাদের সামনে পড়লে শরীর কাঁপতে শুরু করে। মনে হয় যেন এই মুহূর্ত শেষ দিন। ভয় আর আতংক ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা যায় না। সব সহ্য করেও জন্মভূমি ছেড়ে আসতে চাইনি। কিন্তু পেট ক্ষুধার জ্বালা মানে না। তাই বাধ্য হয়ে প্রথমধাপে প্রতিবন্ধী বোন ছেনুয়ারা (২৫) কে কাঁধে নিয়ে এপারে আশ্রয়ের জন্য চলে আসি। মা-স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা পথে রয়েছে।

