হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র রিপোর্ট : বাংলাদেশে ২০১৬ সালে গুম হয়েছেন অন্তত ৯০জন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ আগস্ট ২০১৭
লন্ডন, ৪ আগস্ট : গত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচারে গ্রেফতার, গুম, দীর্ঘসময় অন্তরীণ রাখা এবং বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশ। এছাড়াও সাংবাদিক ও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) কর্মীদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর সরকারের আরোপিত নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। অধিকন্তু, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও কিছু পশ্চিমা দেশের চোখে বাংলাদেশ সরকার ‘সামাজিক সহিংসতা’ থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই ধরনের হতাশাজনক ঘটনাগুলি তুলে ধরা হয়েছে ২০১৭ সালের ৬ জুলাই নিউইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) প্রকাশিত এক রিপোর্টে। এইচআরডব্লিউর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মধ্যে অন্তত ৯০ জন গুমের শিকার হয়েছে। দীর্ঘ সময় আটক রাখার পর তাদের অধিকাংশকে আদালতে হাজির করা হয়, আটক বন্দীদের মধ্যে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে ২১টি আর ৯ জনের কোন হদিসই পাওয়া যায়নি। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৮ জনের নিখোঁজ হবার তথ্য পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি, নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় তীব্র নির্যাতন ও বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তো রয়েছেই।
মানবাধিকার গ্রুপটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ২০১৬ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকারের কঠোর জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমের ফলে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, টাকার জন্য আটক রাখা, গুম, অত্যাচার, নির্যাতন এবং মানবাধিকারের অন্যান্য অপব্যবহার বেড়ে গেছে। এই প্রতিবেদনটিতে প্রান্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা এবং চরমপন্থী মত অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া, বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ে, বিশেষভাবে নারী ও শিশুদের উপর লিঙ্গ-সহিংসতা, কর্ম পরিবেশ এবং শ্রম অধিকারের অপব্যবহারের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনলাইন বক্তৃতা ও সংবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আর নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার অব্যাহতভাবে লঙ্ঘন করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে যে, বাংলাদেশ সরকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হবার পরও এসব ‘ঘৃণ্য কার্যক্রম’ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মত অনুযায়ী, ‘মানুষকে আটকে রাখার ক্ষেত্রে, তাদের অপরাধ বা নির্দোষতা এবং তাদের শাস্তি নির্ধারণ এমনকি তাদের জীবিত থাকার অধিকার রয়েছে কিনা সে সম্পর্কেও একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।’
গুম, অপহরণ, নির্বিচার আটক এবং বিচার বহির্ভুত মৃত্যুর জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে প্রধানত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যদেরকে দায়ী করা হয়। বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিরুদ্ধেও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। রিপোর্টে এছাড়াও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী কর্মীদের আটক করে ইচ্ছাকৃতভাবে পায়ে গুলি করে পংগু করে দিচ্ছে। ভিক্টিমসরা দাবি করেছে যে, পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তারপর তারা বলে যে তারা সশস্ত্র অপরাধীদের সাথে ক্রসফায়ারে আত্মরক্ষা করতে অথবা সহিংস বিক্ষোভের সময় গুলি চালিয়েছে। এর শিকারদের মধ্যে সন্দেহভাজন অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িতরা যেমন রয়েছে তেমনিভাবে রয়েছে বিরোধী দলগুলোর সদস্যরাও।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলন, রাস্তায় ভাঙচুর ও অব্যাহত হরতাল ও অবরোধের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপে ‘উচ্চমাত্রার’ বাড়াবাড়ির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পক্ষ সমূহ থেকে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এর বাইরে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হত্যাকান্ড এবং সুপরিচিত সাংবাদিক ও বিরোধীদলীয় নেতাদের গুমের রিপোর্টও রয়েছে।
(ডঃ রূপক ভট্টাচার্য নয়াদিল্লী ভিত্তিক স্বাধীন রাজনৈতিক বিশ্লেষক)