মন্ত্রী ইমরানের টাকার খনি পাথর কোয়ারি, নিয়ন্ত্রক ছিলেন ৪ ’উজিরে আজম’
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: সিলেটের জাফলং, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে সেখানে প্রভাব-প্রতিপত্তি, টাকা কামাই আর নানা অপকর্মের অঘোষিত সম্রাটে পরিণত হয়েছিলেন সাতবারের এমপি সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার সুযোগকে শতভাগ কাজে লাগিয়ে এলাকায় ‘নিজস্ব রাজত্ব’ কায়েম করেছিলেন। পাথরকোয়ারির বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম ছিল না, যা তিনি করেননি।
স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করছে, এসব অপকর্ম থেকে তিনি বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
শুধু পাথরকোয়ারি থেকেই কামিয়েছেন অন্তত ৬০০ কোটি টাকা। কৌশলী ইমরান আহমদ নিজে আড়ালে থেকে এই কাজে ব্যবহার করেছেন বিশ্বস্ত সহযোগীদের।
জানা যায়, চোরাচালানে ছিল তাঁর প্রচ্ছন্ন মদদ। নির্বাচনী এলাকায় বিষয়টি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’।
পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে গেলে লাখের অধিক মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়। এই সুযোগে তাঁরই মদদে তখন চোরাচালানকে বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ করে দেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২৪ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলার তিনি আসামি হন। তবে অবস্থা বুঝে তিনি শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান।
তিন উপজেলার চার ‘উজিরে আজম’ : ইমরান আহমদ বেশির ভাগ সময় ঢাকায়ই থাকতেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তিন উপজেলার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন তাঁর চার প্রতিনিধি। তাঁদের স্থানীয় লোকজন ‘উজিরে আজম’ নামে ডাকত। জৈন্তাপুর উপজেলায় লিয়াকত আলী, গোয়াইনঘাটে স্থানীয় সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ (পদত্যাগী) ফজলুল হক এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় তামান্না আক্তার হেনা ও শামীম আহমদ মন্ত্রীর অলিখিত ‘উজিরে আজম’ হিসেবে পরিচিত। শামীমের সঙ্গে দূরত্ব বাড়লে সে জায়গা নেন আপ্তাব আলী কালা মিয়া।
তবে হেনার প্রভাব ছিল বেশি। ‘মন্ত্রীর লোক’ পরিচয়ে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি প্রশাসন, পুলিশসহ সর্বত্র ছিল তাঁদের দাপট। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন ‘মিস্টার ফাইভ পার্সেন্ট’ খ্যাত ইমরানের ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম।
‘উজিরে আজম’দের দৌরাত্ম্য : অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহমদকে নিয়ে জৈন্তাপুরের লিয়াকত আলী শ্রীপুর পাথরকোয়ারির পাশাপাশি তামাবিল স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতেন। লিয়াকতের বিরুদ্ধে জৈন্তাপুর ও তামাবিলে ক্যাডার বাহিনী গড়ে পাথরকোয়ারি, সরকারি জমি দখল, তামাবিল স্থলবন্দরে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকার পতনের পর তিনি লাপাত্তা।
পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষিত গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে পাথর ও বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন গোয়াইনঘাট ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফজলুল হক। সহযোগী ছিলেন তাঁর ভাই শামছুল হক, তাঁদের জামাতা ইমরান হোসেন সুমন ওরফে জামাই সুমন এবং সিলেট জেলা পরিষদ সদস্য সুবাস দাস।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কোম্পানীগঞ্জে ইমরান আহমদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এমপির হয়ে শামীমই এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন সব। এরপর দূরত্ব দেখা দিলে কিছুদিন আধিপত্য ছিল চেয়ারম্যান আপ্তাব আলী কালা মিয়ার। তবে জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে এমপির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন জেলা পরিষদ সদস্য তামান্না আক্তার হেনা। এলাকায় পরিচিতি পান লেডি মাফিয়া হিসেবে। প্রশাসনে তাঁর ছিল একচ্ছত্র প্রভাব। চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিজেও জড়ান চোরাচালান ব্যবসায়। ‘মন্ত্রী’র লোক হওয়ায় তাঁর চোরাই পণ্যের ট্রাক কোথাও আটকাত না। প্রশাসন বা পুলিশের কেউ নাক গলালে দিতেন বদলির হুমকি। একাধিক ওসি ও এসআই বদলি করে তিনি সেই সক্ষমতাও দেখান। তাঁর দৌরাত্ম্য কোম্পানীগঞ্জ থানার পাশাপাশি গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর থানা পর্যন্ত ছিল। গত ৬ জুন সিলেটে আটক আলোচিত ১৪ ট্রাক ভারতীয় চিনির চালানের নেপথ্যে ছিলেন এই হেনা। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ১৪ ট্রাক ভর্তি চোরাই চিনির মালিক ছিলেন তিনি। এ ঘটনায় বেকায়দায় পড়লেও ইমরান আহমদ সক্রিয় হয়ে তাঁকে রক্ষা করেন।
ছয় কোয়ারি থেকে ইমরানের পকেটে ৬০০ কোটি টাকা : স্থানীয় লোকজন জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৭ সালে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের আগে পর্যন্ত ৯ বছরে সংসদীয় আসনের ছয়টি পাথরকোয়ারি থেকে ৬০০ কোটি টাকার বেশি গেছে এমপি ইমরান আহমদের পকেটে। কোয়ারিগুলো হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, উত্মা ও শাহ আরফিন টিলা, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, জাফলং, শ্রীপুর। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জে শামীমের একক নেতৃত্বে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা, উত্মা ছড়ায় তামান্না আক্তার হেনা, শাহ আরফিন টিলায় মোহাম্মদ আলী, করিম ও শামীম নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি করতেন। এ সময় প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন। বিছনাকান্দি ও জাফলং নিয়ন্ত্রণ করতেন লিয়াকত আলী। তাঁর পাশাপাশি ছিলেন জামাই সুমন ও আলাউদ্দিন। শ্রীপুর পাথরকোয়ারি নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজা মিয়া। সব মিলিয়ে ছয়টি কোয়ারি থেকে প্রতিদিন ৬০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হতো। এর বেশির ভাগই পেতেন ইমরান আহমদ।
স্থানীয় অধিবাসী, সাংবাদিক ও সামাজিক সংগঠক আবুল হোসেন বলেন, ‘পাথরকোয়ারি থেকে তিনি ৬০০ কোটিরও বেশি টাকার মালিক হয়েছেন।’
হলফনামায়ও ইমরানের সম্পদের পাহাড় : উত্তরাধিকার সূত্রে ইমরান আহমদ বিত্তশালী। বাবার আমলের চা-বাগানের পাশাপাশি পাকিস্তানেও তাঁদের পারিবারিক সম্পদ ছিল। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের হলফনামায় তাঁর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। ১৪ বছর পরে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৯ টাকা, যা ২০০৮ সালের তুলনায় ৬৮ গুণের বেশি।
বেড়েছে স্থাবর সম্পদও। সেখানে আছে শুভংকরের ফাঁকি। ২০০৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী তাঁর স্থাবর সম্পদ সাড়ে চার একর জমি, যার অর্জনকালীন আর্থিক মূল্য ৫৫ হাজার টাকা। পাশাপাশি উত্তরাধিকার সূত্রে শ্রীপুর চা-বাগানের ২/১৩ অংশের মালিকানা। ১৪ বছরে বেড়েছে স্থাবর সম্পত্তি। আগের উল্লেখের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২৪.২৭ একর জমি। এটি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত বলা হলেও ২০০৯ সালের হলফনামায় এর উল্লেখ ছিল না। সর্বশেষ ২০২৩ সালের তথ্য মতে, ১৪ বছরে স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সাড়ে ১৬ গুণের বেশি। যদিও তাঁর নির্বাচনী এলাকার মানুষের ধারণা, প্রকৃত সম্পদের অল্পই হলফনামায় উল্লেখ করেছেন এই দম্পতি।
২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ : সিন্ডিকেট করে অর্থ আত্মসাৎ ও মানবপাচারের অভিযোগে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ, একই মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে ১০৩ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
আফিয়া ওভারসিজ নামের প্রতিষ্ঠানের প্রপ্রাইটার আলতাফ খান নামের এক ভুক্তভোগী মামলাটি করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন পল্টন থানার ওসি মোল্লা মো. খালেদ হোসেন।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক সংসদ সদস্য ইমরান আহমদের মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে জৈন্তাপুরের লিয়াকত আলীর মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। কামাল আহমদ কারাগারে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য তামান্না আক্তার হেনা এবং গোয়াইনঘাটের ফজলুল হকের মুঠোফোন খোলা পাওয়া গেলেও তাঁরা কেউ কল রিসিভ করেননি।