১৫ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য : দুর্নীতির বরপুত্র ওয়াসার তাকসিমের বিদায়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ আগস্ট ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: দীর্ঘ ১৫ বছর পর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে তাকসিম এ খানকে গতকাল বৃহস্পতিবার বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, ‘তাকসিম এ খানের তিন বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বাকি মেয়াদ বাতিল করেছে সরকার।’
তাকসিমকে বরখাস্তের পরপরই জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি, অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) এ কে এম শহিদ উদ্দিনকে এমডির দায়িত্ব দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড।
এদিকে তাকসিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বেশুমার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও প্রতিবার দায়মুক্তি সনদ (ক্লিন সার্টিফিকেট) দিয়ে গেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এবার তাঁকে আর ছাড় নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইন না মেনে দু’জন পরিচালক নিয়োগ দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাকসিমসহ ১০ জনের নামে শিগগির মামলার করবে দুদক। নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক এরই মধ্যে তথ্য-প্রমাণ হাতে পেয়েছে।
জানা গেছে, দুদক উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিশেষ একটি দল ওই অভিযোগ অনুসন্ধান করে। তারা ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। দুদক প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মামলার অনুমোদন দেবে।
যোগ্যতা না থাকলেও এমডি
ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না তাকসিম এ খানের। তবু ২০০৯ সালে তৎকালীন ওয়াসা বোর্ড তাঁকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে এমডি পদে বসায়। সেই থেকে ঢাকা ওয়াসায় তাকসিমের দৌরাত্ম্যের শুরু। এরপর ওয়াসায় শুরু হয় তাকসিম আমল। গেল ১৫ বছরে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
যখন তিনি যা মনে করেছেন, তা-ই করেছেন। ঢাকা ওয়াসা বোর্ড এমডি নিয়োগের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী হলেও তিনি সব সময় বোর্ডকে রেখেছেন নিজের কবজায়। এ জন্য দু’জন বোর্ড চেয়ারম্যানকে পদত্যাগে বাধ্যও করেন। একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করেন। আদালতের আদেশ নিয়ে চাকরি ফিরে পেলেও ওই ডিএমডিকে ওয়াসায় যোগ দিতে দেননি তিনি। বেশ কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা তাঁর মতের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাদের অন্যায়ভাবে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করেন। অনুগত না হলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর নেমে এসেছে খড়গ। নিজস্ব একটি বাহিনী তৈরি করে ঢাকা ওয়াসায় তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যান বেপরোয়া গতিতে। তাঁর দাপটে ওয়াসার নিয়ন্ত্রণকারী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও থেকেছেন ভয়ে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাকসিম যাতে নিয়োগ পান, সে ব্যবস্থা করার জন্য বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময় ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান থাকা তাকসিমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা এ জন্য বোর্ড সদস্যদের বলে তাকসিমকে সর্বোচ্চ নম্বর দেন। অথচ সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পর তাকসিমই সেই গোলাম মোস্তফাকে বোর্ড চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণ করেন। গোলাম মোস্তফা বলেন, ওয়াসার এমডি পদে আবেদন করার কোনো যোগ্যতাই ছিল না তাকসিমের। আমিই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করে ওয়াসায় এমডি বানিয়েছিলাম। তাঁকে সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম।
প্রথমবার এমডি হওয়ার পর থেকেই নানা কূটকৌশলে তাকসিম নিজের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। এসব নিয়ে সমালোচনা হলে তিনি বোর্ডকে দিয়ে এমন বিস্ময়কর শর্তজুড়ে এমডি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন, যাতে তিনিই আবার এমডি হতে পারেন। তাঁর প্রভাবে ওয়াসার তদারককারী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামও তটস্থ খাকতেন। বছরের ছয় মাসই তিনি থাকতেন দেশের বাইরে। বিদেশে গেলে কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে ‘অনলাইন এমডি’ হিসেবে নজির স্থাপন করেন তিনি।
নিয়োগে দুর্নীতি
দুদক সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার ২৫২তম বোর্ড সভায় প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেমকে পরিচালক (উন্নয়ন) ও আরেক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম সহিদ উদ্দিনকে পরিচালক (কারিগরি) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মাসিক বেতন দেড় লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর পর আরও দু’বার তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা সাড়ে চার বছরে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের তহবিল থেকে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা তুলেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ ২৫২তম বোর্ড সভায় আট সদস্য উপস্থিত থেকে তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামবহির্ভূত ও বৈধভাবে কোনো পদ সৃষ্টি না করে দু’জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন।
তাকসিম ছাড়া অভিযুক্ত অন্যরা হলেন– ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান, বোর্ড সদস্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (বাজেট-২) সুধাংশু শেখর বিশ্বাস, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মু. মাহমুদ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী এ কে এম এ হামিদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হাসিবুর রহমান মানিক, কাউন্সিলর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলেয়া সারোয়ার ডেইজী, সাবেক পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেম ও সাবেক পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন।
তাকসিমের যত অনিয়ম
তাকসিম এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিদেশি ঋণে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এসব প্রকল্প থেকে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছেন। এসব টাকার লেনদেন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অস্বাভাবিক লেনদেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর তালিকাতেও সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁর নাম ওঠে।
ওয়াসার প্রকৌশলীরা জানান, পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্পে ৫০০ কোটা টাকার সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে তাকসিমের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় দুদকেও হাজিরা দিয়েছেন তিনি। ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করায় কোনো প্রকল্পই টেকসই হয়নি। দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার দিয়ে কোনো বর্জ্য শোধন না হলেও প্রতিবছর এটার ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০ কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানির বদলে মিলছে ২০ কোটি লিটার। ভাকুর্তা প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ২০ কোটি লিটারের বদলে পাওয়া যাচ্ছে ৫ কোটি লিটার।
দুর্নীতি ও অদূরদর্শী প্রকল্পের কারণে একদিকে যেমন কোনো সুফল মেলেনি, তেমনি বিদেশি চড়া সুদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে প্রতিবছরই পানির দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়েছেন তাকসিম। গত ১৫ বছরে ১৬ বার বাড়ানো হয়েছে পানির দাম। সর্বশেষ ওয়াসায় ১৭ বছর ধরে অস্থায়ী থাকা কর্মচারীদের স্থায়ী না করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য করে কামিয়ে গেছেন শতকোটি টাকা। খবর-সমকাল