হাম রোগ রাশ কিংবা ফুসকুড়ি চেয়েও আরো ভয়াবহ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ এপ্রিল ২০২৪
বছরের পরিক্রমায় ইউকেতে আবারো বসন্তকাল শুরু হয়েছে। ইউকে এবং ইউরোপজুড়ে হামে (ফুসকুড়ি) আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর প্রাপ্তবয়স্ক ও অভিভাবকদের হামের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে।
লন্ডনের জিপি ডা. নাগভি ব্যাখ্যা করেন, গত ১০ বছর ধরে এমএমআর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নিয়ম করে মানুষ গ্রহণ করায় হামে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে । তবে এ বছর আমরা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, ‘আমার বহু রোগীরই এমন কোনো বয়স্ক স্বজন নেই, যারা হামে আক্রান্ত হয়েছিলেন । সুখের বিষয় হচ্ছে, হাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে সে ব্যাপারে এদের প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ইউকেতে টিকা প্রকল্প কতটা সফল হয়েছে তা হাইলাইট দেখলেই বোঝা যায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দেয়, মানুষ টিকা দেয়ার গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। যে কারণে অনেকেই হয়তো এমএমআর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ গ্রহণ করেননি।‘
তিনি আরো বলেন, ‘হাম, মাম্পস ও রুবেলা থেকে আজীবন সুরক্ষার জন্য মাত্র দুটি ডোজই যথেষ্ট। এটা শুধু টিকাগ্রহণকারীর জন্যই নয়, তার আশপাশে যারা থাকবে তাদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
হাম কী?
হাম অত্যন্ত সংক্রমক একটি ব্যাধি। যা সাধারণতা ঠান্ডা-কাশির মতো লক্ষণ দিয়ে শুরু হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই শরীরে রাশ বা ফুসকুরি দেখা যায়। এগুলো মসৃন বা কিছুটা উঁচু হতে পারে। সাধারণত রাশ মুখমন্ডল থেকে শুরু হয়। তারপর পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই স্পটগুলো একসঙ্গে হয়ে দাগের মতো দৃশ্যমান হয়। ফ্যাকাশে ত্বকে এই রাশ লাল বা লালচে-বাদামি রঙের হতে পারে। কালো বা বাদামি রঙের ত্বকে রাশ দেখতে বাদামি লাগে। অনেক সময় এদের দেখাও যায় না। এগুলো হাইপার পিগমেন্টেড হতে পারে এবং স্পর্শ করলে কিছুটা উঁচু বা ফুলে আছে- বলে মনে হবে।
ডা. নাগভি পরমর্শ দেন, যে কেউ চাইলেই বিভিন্ন ত্বকে হাম দেখতে কেমন লাগে তা এই ওয়েবসাইটে www.swLondon-healthiertogether.nhs.uk. গিয়ে দেখে নিতে পারে। তিনি বলেন, “আপনার জানা উচিত রাশগুলো আপনার, আপনার সন্তান এবং আপনার প্রিয়জনদের ত্বকে কেমন দেখাবে । ত্বকে রঙ পাল্টালে রাশ দেখতেও ভিন্ন হবে।”
হামের যত্ন ও জটিলতা
লেইলানি প্রিম্যাচিউর শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করে । জন্মের সময় তার ওজন খুব কম ছিল। জন্মের পর থেকে তার প্রথম ১০ সপ্তাহ কাটে বেবি ইউনিটের স্পেশাল কেয়ারে। এর মধ্যে কিছু দিন সে ইনটেনসিভ কেয়ারেও ছিল। ২০০৪ সালে তার হাম ধরা পড়ে। তার মা নিকোল জানান, ওই সময় লেইলানি সদ্যজাত শিশু।
নিকোল বলেন, ‘ও আমাদের প্রথম সন্তান। ও হাসপাতাল ছাড়ার আগ পর্যন্ত আমাদের জীবন অনেকটা রোলারকোস্টারের মতো ছিল। অভিভাবক হিসেবে আমরা অত্যন্ত সতর্ক ছিলাম, কোন ভুল যেন হয়ে না যায়। কোনভাবেই যেন ওকে কোন সংক্রামক রোগ আক্রমণ করতে না পারে। ওকে নিরাপদে রাখার জন্য আমরা সম্ভব সব কিছু করেছি। শিশুদের জন্য উপযুক্ত সব টিকা ওকে দেয়া হয়েছে। তবে ওর এমএমআর অ্যাপয়েন্টমেন্টের আগেই আমি দেখি ওর শরীরে রাশ উঠছে। তাৎক্ষণিকভাবেই আমার মনে হয়, এটা হাম । আমি আমার মাকে ফোন করি। বিষয়টি জানানোর পর তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যদিও আমি বার বার তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলাম যে, লেইলাইনি ভালো আছে।‘
তিনি আরো বলেন, ‘জিপিতে জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আমরা লেইলাইনিকে নিয়ে যাই। চিকিৎসক হাম শনাক্ত করেন। তিনিও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমার মনে হচ্ছিল, লেইলাইনি ওর মতো করে ভালো আছে। ঘুমটা বেড়েছে আর শিশু বয়সের কারণেই ওর শরীরের টেম্পারেচারও স্বাভাবিক ছিল।‘
তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার মা কেন এত ভয় পাচ্ছিলেন। মা আমাকে জানান, আমার ফুফু ছোটবেলায় হামে আক্রান্ত হওয়ার পর এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যগত জটিলতায় মারা যান । আমি জানতাম, আমার বাবার এক বোন ছোটবেলায় মারা গেছে। তবে তার অসুস্থতার ব্যাপারে কখনো কিছু শুনিনি। হাম মানে যে রাশ ছাড়া আরো কিছু তাও আমার জানা ছিল না। তখন আমি বুঝতে পারলাম , আমার মা কেন ভয় পাচ্ছিলেন। ওখানকার স্বাস্থ্যকর্মী আর চিকিৎসকও উদ্বিগ্ন ছিলেন।‘
ডা. নাগভি এ ধরনের উদ্বেগের সঙ্গে পরিচিত । তিনি বলেন, ‘হাম থেকে ১০ ধরনের গুরুতর স্বাস্থ্যগত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে, নিউমোনিয়া, মস্তিস্কে সংক্রমণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যু পর্যন্ত। এবং হাম, মাম্পস বা রুবেলার সুর্নিদিষ্ট চিকিৎসা নেই।‘
তিনি আরো বলেন, ‘এই জটিলতাগুলো অবশ্য বেশ বিরল। দু:খজনকভাবে প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটি হামে আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। আপনি বা আপনার শিশু যদি হামে আক্রান্ত হন এবং অসুস্থতা বাড়তে থাকে তাহলে অনুগ্রহ করে জরুরি পরামর্শ নিন।‘
আপনি যদি মনে করেন আপনার বা আপনার শিশুর হাম হয়েছে তাহলে জিপি সার্জারিকে বিষয়টি জানান। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়ার আগেই তাকে অবহিত করুন। শ্বাসকষ্ট, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে যা প্যারাসিটামলের মতো ওষুধেও না কমে, কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা গেলে, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, বিভ্রান্তি, জ্ঞান হারানো বা খিঁচুনির মতো লক্ষন দেখা গেলে হাসপাতালেল. এঅ্যান্ডই-তথা জরুরী বিভাগে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
মাম্পস ও রুবেলা কী?
ডা. নাগভি বলেন, ‘মুখের কোনো এক পাশে কানের নিচে ফুলে যাওয়াকে মাম্পস বলা হয়। এতে ব্যথা থাকে। একে হ্যামসটার ফেইস অ্যাপিয়ারেন্সও বলা হয়। মাম্পসের কারণে ম্যানিনজাইটিস বা টেসটিক্যালস বা ওভারির ফুলে যাওয়ার মতো ঘটনার কথা অবশ্য খুব একটা শোনা যায় না।‘
রুবেলার (একে অনেকেই জার্মান মিসেলস বলে থাকে) প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, রাশ ওঠা। এটা চেহারা থেকে শুরু হতে পারে বা কানের পেছন থেকে। এরপর ঘাড় ও পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
ডা. নাগভি বলেন, ‘ভ্যাকসিনেশনের কারণে গর্ভাবস্থান রুবেলার হানা এখন খুবই বিরল ঘটনা। তবে এমন কিছু যদি ঘটে যায় তা গর্ভের শিশুদের জন্য গুরুতর হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এমনকি গর্ভপাতও ঘটতে পারে।|”
হাম অত্যন্ত সংক্রামক
আপনি বা আপনার শিশু যদি টিকা না দিয়ে থাকেন তাহলে হামে আক্রান্ত হওয়ার বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছেন আপনারা। এটা অত্যন্ত সংক্রামক। ক্লাসে কোনো শিশুর যদি হাম হয় তাহলে প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে ৯টিরই আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থেকে যায়।
ডা. নাকভি পরামর্শ দেন, ‘আপনার শিশুর যদি হাম হয়ে থাকে তাহলে তাকে স্কুলে পাঠাবেন না। রাশ ওঠার পর থেকে অন্তত চারদিন তাকে স্কুল থেকে দূরে রাখুন । আর আপনার যদি হাম হয়ে থাকে তাহলে কাজে যাবেন না এবং অন্যদের সঙ্গে মিশবেন না। একইভাবে রাশ ওঠার পর থেকে অন্তত চারদিন কাজে যাবেন না। ‘
যাদের হাম হয়েছে তাদের বার বার হাত ও মুখ সাবান পানি দিয়ে ধোয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এতে হাম অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কমবে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ, সংক্রমণের আশঙ্কা আছে বা টিকা দেননি এমন গর্ভবতী মা বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
কারা হাম, মাম্পস ও রুবেলার টিকা পাবেন?
হাম, মাম্পস ও রুবেলার জন্য এমএমআর টিকার দুই ধাপে নিলে তা নিরাপদ কার্যকর এবং আজীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এমএমআর ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া হয় শিশুদের এক বছর বয়সে। দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর বয়স যখন তিন বছর চার মাস। প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে যারা এক বা দুই ডোজ ভ্যাকসিনই পায়নি তারা যে কোন সময় এই টিকা নিতে পারবে বলে জানান ডা. নাগভি।
তিনি বলেন, ‘আপনি আপনার শিশুর হেলথ রেকর্ড চেক করুন। একে রেড বুকও বলা হয়। এতে দেখুন এমএমআর ভ্যাকসিনের একটি বা দুটি ডোজ আপনার শিশুকে দেয়া হয়েছে কিনা। অথবা আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে কথা বলুন।”
শিশুদের তিন বছর চার মাস বয়সের আগে যারা এমএমআরের প্রথম ডোজ মিস করেছে তারা জিপি প্র্যাকটিসের কাছ থেকে এই টিকা নিতে পারবে। যে সব শিশুর বয়স তিন বছর চার মাসের বেশি এবং এমএমআর ভ্যাকসিনের একটি বা দুটি ডোজ মিস করেছে তারাও তাদের জিপি প্র্যাকটিসের কাছে গিয়ে এই টিকা নিতে পারবে।
ডা. নাগভি বলেন, ‘আপনার শিশুর সুরক্ষায় তাদের জিপিকে ফোন করুন। এমএমআর ভ্যাকসিনের জন্য তাদের কাছ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন। আপনার হাম বা কোভিড ভ্যাকসিন নেয়ার সময় যদি রোজা চলতে থাকে তাহলে টিকার কারণে রোজা নষ্ট হবে না। বেশিরভাগ মুসলিম স্কলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়ার সময় আপনি নিশ্চিত করতে পারেন যে এর মধ্যে পোরসিন জেলাটিন থাকবে না।”
নিকোল বলেন, ‘মা হিসেবে আমি বিষয়টি নিয়ে পড়াশুন করেছি। তারপরও লেইলানির হাম হয়েছে । সেরে ওঠার পর তাকে এমএমআর ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া হয়। যেন সে ভবিষ্যতে মাম্পস ও রুবেলা থেকে সুরক্ষা পায়।”
আরো পরামর্শ ও টিকা দেয়ার জন্য একজন স্বাস্থ্য কর্মীর সঙ্গে কথা বলুন। অথবা ভিজিট করুন NHS.UK –এই ওয়েবসাইটে। সাউথ ওয়েস্ট লন্ডন হেলদিয়ার টুগেদার ওয়েবসাইটে আপনি শিশু ও গর্ভবতীদের ব্যাপারে স্পষ্ট ও সমন্বিত আরো পরামর্শ পাবেন। এছাড়াও আপনি হাম, মাম্পস ও রুবেলা সংক্রান্ত এবং টিকার বিষয়ে তথ্য জানতে www.swLondon-healthiertogether.nhs.uk.–এবং NHS.UK -এই ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন।
সন্তান অসুস্থ হলে আরো অনেক কিছুই করতে পারেন। অসুস্থতার জন্য NHS.UK ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন। হালকা অসুস্থতায় স্থানীয় ফার্মাসির পরামর্শ নিতে পারেন।
ওষুধ নেয়া যেতে পারে : লক্ষণ দেখে যদি মনে হয়, বিষয়টি গুরুতর বা আপনি উদ্বিগ্ন তাহলে NHS 111 –এ ফোন করুন বা অনলাইনে যোগাযোগ করুন। জরুরিভিত্তিতে অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিতে পারেন।
আপনি স্থানীয় জিপি প্র্যাকটিসের সহায়তাও নিতে পারেন। আমরা আপনাকে সুরক্ষা, গর্ভাবস্থায় সহায়তা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থসেবা দিতে পারি।
এছাড়াও কাটাছেড়া, পোড়া, পা মচকানোর মতো সমস্যার ক্ষেত্রে ইঞ্জুরি ডিপার্টমেন্টের সহায়তা নিতে পারেন আপনি। গুরুতর জীবনসংহারি পরিস্থিতিতে পড়লে ফোন করুন ৯৯৯ নম্বরে বা স্থানীয় অ্যাক্সিডেন্ট অ্যান্ড ইমার্জেন্সিতে (এ অ্যান্ড ই)।