ফেলে আসা সোনালী দিনের গল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
* গোলাম আহমেদ সাবেরী *
আমার জীবনের দীর্ঘদিন কেটেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে । তবে আজ এক যুগের অধিক সময় হতে চললো আমি এই জগতের সাথে তেমন জড়িত নই। তাই সেই জীবনকে মাঝেমাঝে বেশ মিস করি। ছোটবেলার অনেক কথা আজ মনে পড়ছে । তখন আমরা বগুড়াতে থাকতাম। আমি ছাড়া আমার বড় তিন ভাইবোনই তখন স্কুলে পড়তেন । সন্ধ্যায় যখন তাঁরা যার যার রুমে পড়তে বসতেন আমি তখন আব্বা-আম্মার সাথে সময় কাটাতাম। আব্বা (সিলেট এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম গোলাম রসুল ) তখন আমাকে ছড়া, কবিতা শেখাতেন। ছোট ছোট ছড়া মুখস্থ করার পর তা কীভাবে অঙ্গভঙ্গি করে আবৃত্তি করতে হয় তাও শেখাতেন। একটা ছড়া শেখার পর কোথাও বেড়াতে গেলে বা কেউ বাসায় বেড়াতে এলে আমাকে বলা হতো আবৃত্তি করার জন্য। আবৃত্তি করা শেষ হলে সকলের প্রশংসা আমাকে আরও উৎসাহিত করত। শুরুটা এভাবেই।
তবে একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমি নাকি অনেক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। গল্প শুনেছি যে, আমি যখন অনেক ছোট তখন আমার দাদার বাড়িতে ঈদের দিন সন্ধ্যায় ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো । তখন এখনকার মতো ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। ঈদের সন্ধ্যায় টিভির বিশেষ অনুষ্ঠানমালাও ছিল না । তাই আমার চাচারা ঈদের সন্ধ্যায় বাড়িতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন । ঈদের সন্ধ্যায় আমার সব চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই বোনেরা দাদা-দাদির রুমে জড়ো হয়ে নিজের প্রতিভা অনুযায়ী গান, কবিতা, অভিনয়, কৌতুক যে যা পারতেন তা পরিবেশন করতেন। অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলতো । আর মজার ব্যাপার হলো, পুরো অনুষ্ঠানটি অডিও টেপে রেকর্ড করা হতো । অনুষ্ঠান শেষে আবার সবার উপস্থিতিতে পুরো রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনা হতো । আমি নাকি এসব অনুষ্ঠানে দুই-এক লাইন ছড়া/ছড়াগান বলতাম । তবে তখন এতই ছোট ছিলাম যে সেসব কথা এখন আর মনে নেই।
বগুড়াতে থাকাকালীন সময়ে কোনো বড় অনুষ্ঠানে বা কোনো প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করেছি কিনা ঠিক মনে পড়ে না । যেটুকু মনে পড়ে আমরা চট্টগ্রামে আসার পর পরই আমি একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম । দিনটির কথা এখনও পরিষ্কার মনে আছে। তখনও আমার স্কুল জীবন শুরু হয়নি । আমার মেঝ ভাই একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন। তাই বাসায় অনুশীলন করছিলেন । কবিতাটি ছিল কবি গোলাম মোস্তফার ‘নবীর শিক্ষা’। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে থেকে আমার বড় ভাই-বোন তাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছিলেন । আর আমি পুরো বিষয়টিতে খুব আনন্দ পাচ্ছিলাম । তাই প্রতিযোগিতার দিন বায়না ধরি যে, আমি ওর সাথে যাবো । অবশেষে গেলামও। যাওয়ার পর জানতে পারলাম যে সেখানে আরেকটি গ্রুপে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য একটি আবৃত্তি প্রতিযাগিতার আয়োজন রয়েছে । আমার ভাই কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই সেই গ্রুপে আমার নামটা দিয়ে দিল। এটাই ছিল সম্ভবত আমার জীবনে প্রথম আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ।
প্রতিযোগিতা শেষে জানলাম যে আমি প্রথম হয়েছি। আমার মেঝ ভাই সম্ভবত তাঁর গ্রুপে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়েছিলেন । যখন পুরষ্কার নিয়ে বাসায় ফিরলাম তখন বাইরে থেকে চিৎকার করে বলছিলাম যে আমি ‘ফার্স্ট প্রাইজ’ পেয়েছি।
কিছুদিনের মধ্যেই আমার স্কুল জীবন শুরু হলো । চট্টগ্রাম মডেল কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হলাম । স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কোনো একটা ক্লাসে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম । তারপর শিক্ষকদের নজরে পড়ে গেলাম। সেই থেকে স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানেই আমাকে দিয়ে আবৃত্তি করানো হতো । এছাড়া প্রতিবছর স্কুলে বেশ বড় করে পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো । যা কিনা অনুষ্ঠিত হতো চট্টগ্রাম কলেজের অডিটোরিয়ামে। আর প্রতি বছরই কবিতা আবৃত্তিতে আমি একটি পুরস্কার পেতামই।
আব্বা ছিলেন তখন চট্টগ্রাম আই.আই কলেজের অধ্যক্ষ (বতর্মানে সম্ভবত এই কলেজের নাম চট্টগ্রাম মহসিন কলেজ)। ওই কলেজের যেকোনো অনুষ্ঠানেই আমাকে আবৃত্তি করতে হতো। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন থেকে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও পুরস্কৃত হতাম। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ার সময় আব্বা ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে বদলি হলেন।
ফরিদপুর আসার কিছুদিন পরে ভর্তি হলাম ফরিদপুর জিলা স্কুলে। সেখানে কিছু বন্ধু পেলাম যাদের সাথে যুক্ত হয়ে এই সাংস্কৃতি চর্চা আরো বেড়ে গেল। আবৃত্তির সাথে যুক্ত হল বিতর্ক, বক্তৃতা, উপস্থিত বক্তৃতা, অভিনয় ইত্যাদি। বন্ধুদের সাথে কিছুটা লেখালেখিও শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেই সময় এক্ষেত্রে তেমন একটা প্রশংসা কুড়াতে পারিনি। তবে আবৃত্তি, বিতর্ক, বক্তৃতা, উপস্থিত বক্তৃতা, অভিনয় এসবের সাথে রচনা, স্বরচিত কবিতা, স্বরচিত গল্প এসব প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করতাম এবং মাঝেমাঝে বিজয়ী হয়ে পুরস্কৃত হতাম। তাছাড়া তখন দেয়াল পত্রিকার খুব প্রচলন ছিলো । কোনো বিশেষ দিবসে কোনো সংগঠন বা স্কুল থেকে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হতো । এসব দেয়াল পত্রিকায় প্রায়ই আমার লেখা ছড়া, কবিতা প্রকাশিত হতো । মাঝেমধ্যে আবার কিছু পত্রিকার ছোটদের কলামে ছড়া/কবিতা পাঠাতাম। প্রকাশিত হলে খুব আনন্দ পেতাম। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতাম যখন কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার পর কোনো পত্রিকায় নাম বা ছবি ছাপা হতো।
সেই সময় স্কুলে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হতো । যেমন: বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি। এছাড়াও তখন বছরে কয়েকবার শিশু একাডেমী থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। অপেক্ষায় থাকতাম কখন প্রতিযোগিতা আসবে আর কখন অংশগ্রহণ করবো । থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়ে ঢাকায় যেতাম জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার জন্য । আর জাতীয় পর্যায়ে যখন বিজয়ী হয়ে ফিরতাম তখন কী যে আনন্দ লাগতো । জাতীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেিশ সাফল্য পেয়েছি বিতর্কে।
এছাড়া তখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করার আমন্ত্রণও পেতাম। আব্বা, আম্মা ও আমার বড় তিন ভাই-বোন আমাকে খুবই সহযোগিতা করতেন । এখানে উল্লেখ করতেই হয় যে, আমার বড় ভাই একজন বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় আর আমার মেঝ ভাই টেবিল টেনিস খেলোয়াড় । তাঁরা দুজনেই চেষ্টা করেছেন আমাকে খেলোয়াড় বানাতে এবং যথেষ্ট সময় দিয়ে খেলাও শিখিয়েছিলেন। টেনিস ও টেবিল টেনিস দুটো খেলাতেই তাদের উৎসাহে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি, কিন্তু তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারিনি । তাদের চেষ্টাটা ব্যর্থই হয়েছে বলতে হয় ।
তবে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে আমার একমাত্র বোনের চেষ্টা । আপাও ছোটবেলা থেকে এথল্যাটিক্স ও ব্যাডমিন্টনে খুব ভাল ছিলেন । তবে অনার্স-এ ওঠার পর তিনি আউটডোর স্পোর্ট ছেড়ে দেন । ইনডোর গেইমেও তিনি খুব ভালো ছিলেন। তিনি অনার্স পড়ার সময় রাজেন্দ্র কলেজে টেবিল টেনিস ও ক্যারামে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন । আমার আম্মাও ফরিদপুর জেলা মহিলা ক্যারামে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এমন একটি পরিবারে থেকেও আমি খেলাধুলায় কোনো সাফল্য দেখাতে পারিনি । স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় একটি বিষয়ে আমি সবসময় পুরস্কার পেতাম, তা হলো ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’। কিছু একটা সেজে অভিনয় করে একটি পুরস্কার ঠিকই নিয়ে আসতাম।
এবার আপার কথায় ফিরে আসি। আপা খুবই ভাল গান গাইতেন । যদিও ঘরোয়া পরিবেশের বাইরে তিনি তেমন কোনো গান করেননি। কিন্তু আমাকে গান শেখানোর জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাঁর এই চেষ্টাটা পুরাপুরি ব্যর্থ হয় । আমার গলায় একেবারেই সুর আসে না। গান গাওয়ার স্বাদ মেটানোর জন্য বেশ কিছু অনুষ্ঠানে আমি কোরাস গানে অংশগ্রহণ করি । তাছাড়া আপার প্রচন্ড চেষ্টায় দু-এক বার হামদ ও নাতে পুরস্কার পেয়েছিলাম। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই ক্ষেত্রে আমি একেবারেই ব্যর্থ।
সেই সময় প্রতি বছরই জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ উদযাপন হতো। আর প্রতি বছরই আব্বা ও আমার বড় ভাইয়ের উৎসাহে আমি একটি বিজ্ঞান প্রজেক্ট প্রদশর্নীতে উপস্থাপনা করতাম। আমি প্রজেক্টে পুরস্কার পাই বা না পাই বিজ্ঞান সপ্তাহে বিতর্ক, বক্তৃতা এসবে ঠিকই পুরস্কার পেতাম।
সেই সময় শিশু একাডেমি বছরে একবার ‘শিশু আনন্দ মেলা’ নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো । এই অনুষ্ঠানে ছোটদের বিভিন্ন স্টল সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো । প্রতি বছরই আমি এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। আর এ অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের মধ্য থেকে কাউকে সভাপতি বানানো হতো। একবার আমাকেও সভাপতি বানানো হলো। সেবার আমি সভাপতির বক্তব্য রেখে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করি । তখন সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তাম।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আব্বা বদলি হলেন সিলেট এম সি কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে। সিলেট আসার পরও ঠিক একইভাবে আমার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ চলছিলো । যেমন: শিশু একাডেমি, স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান সপ্তাহ, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। তবে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার মাত্রাটা সিলেট আসার পর আরও বেড়ে গেল। এছাড়াও আমার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন যুক্ত হলো রেডিও প্রোগ্রাম । সিলেটে আসার পরের দিনই আমার এক চাচাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রেডিও স্টেশনে যাই । তখন বলা হত রেডিও বাংলাদেশ সিলেট ।সেখানে প্রযোজকগণ আমার সাথে কথা বলে খুব খুশি হন। আমাকে জানানো হলো কিছুদিনের মধ্যেই অডিশনের চিঠি পাবো । দু’সপ্তাহের মধ্যেই বাসায় অডিশনের চিঠি এলো। যথারীতি অডিশন দিয়ে শিশুশিল্পী হিসাবে নির্বাচিত হলাম । তখন রেডিও বাংলাদেশ সিলেটে ‘কিশলয়’ নামে সপ্তাহে একদিন ছোটদের অনুষ্ঠান হতো । সেই অনুষ্ঠানে আমি ছোটদের খবর পাঠ, ছোটদের নাটক, আবৃত্তি এসবে অংশগ্রহণ করতাম । ভালই প্রশংসা পাচ্ছিলাম।
এদিকে দেখতে দেখতে আমার স্কুল জীবন শেষ হয়ে কলেজ জীবন শুরু হলো। কিন্তু ১৬ বছর বয়সের পর আর ছোটদের অনুষ্ঠানে প্রোগ্রাম করা যায় না। ঠিক তখনই আমার ডাক এলো আরেকটি অনুষ্ঠানে । রেডিও বাংলাদেশ সিলেটে তখন তরুণদের জন্য ‘নবকল্লোল’ নামে সপ্তাহে একটি অনুষ্ঠান হতো । আমাকে বলা হলো এই অনুষ্ঠানে প্রোগ্রাম করার জন্য। উপস্থাপনা, আবৃত্তি, বিভিন্ন লেখা থেকে পাঠ, কখনো আবার নিজের লেখা কথিকা পাঠ। এভাবে চলছিলো নবকল্লোল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ।
এদিকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও পুরস্কার বিজয়ের মাত্রা কলেজে ওঠার পর আরও বেড়ে গেলো। কলেজের সংস্কৃতি সপ্তাহ, আন্ত কলেজ প্রতিযোগিতা, জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিয়মিত চলছিল। কলেজের সংস্কৃতি সপ্তাহে একবার রানার্সআপ ও দুবার চ্যাপিয়ান হয়েছিলাম। কলেজ থেকে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করেছি। তখন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিতর্ক প্রতিযোগিতা খুবই জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন সংগঠন থেকে আয়োজিত এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছি। তখন লেখালেখিতে আবারও বেশ উৎসাহ পাই। আমার লেখা কিছু ছোটগল্প ও কবিতা তখন কলেজ ম্যাগাজিনসহ কিছু পত্রপত্রিকা ও ম্যগাজিনে ছাপা হয় । রেডিও ও বেশ কিছু নাট্য সংগঠন থেকে তখন অভিনয়ের জন্য ডাক আসে । কিন্তু আব্বা আম্মা অভিনয়ের ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ দেখান নি। যেকারণে আমিও আর অভিনয়ের দিকে অগ্রসর হতে চাইনি। যেটুকু মঞ্চে ও রেডিও নাটকে অভিনয় করেছি তা স্কুল জীবনেই করেছি। এছাড়া গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে নেপথ্যে থেকে আবৃত্তিও করেছি। বছর চারেক রেডিওতে নবকল্লোল অনুষ্ঠানে প্রোগ্রাম করার পর সুযোগ এলো রেডিওতে অনুষ্ঠান ঘোষকের জন্য অডিশন দেয়ার । অডিশনে পাশ করে রেডিও বাংলাদেশ সিলেট কেন্দ্রে তালিকাভুক্ত অনুষ্ঠান ঘোষক হলাম । তখন রেডিও বাংলাদেশ সিলেট কেন্দ্রে ছিল সকালে ৬:৩০ থেকে ১০টা, আর বিকালে ৪:৩০ থেকে রাত ১১.৩০ দুটি অধিবেশন। সপ্তাহে একদিন বা দুদিন যেকোনো একটি অধিবেশনে ডিউটি করতে হতো । তাই এই কাজের জন্য আমার পড়ালেখা বা ক্লাসের খুব একটা অসুবিধা হয়নি । ডিউটিতে থাকাকালীন সময় অনুষ্ঠান ঘোষণা ছাড়াও সেই সময় চলাকালীন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হতো । পড়ালেখার সাথে চার বছর অনুষ্ঠান ঘোষক হিসাবে কাজ করলাম।
ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল সংবাদ পাঠ করব। অবশেষে সুযোগ এলো। অডিশন দিলাম সংবাদ পাঠকের জন্য। বাংলাদেশ বেতার সিলেটে সংবাদ পাঠক হিসেবে নির্বাচিত হলাম। আমি অনুষ্ঠান ঘোষনায় থাকাকালীন সময়ই রেডিও বাংলাদেশ সিলেটের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় ‘বাংলাদেশ বেতার সিলেট’। বছরখানেক সিলেট বেতারে সংবাদ পাঠের পর ঢাকায় চলে গেলাম সিটিসেল টেলিকমে চাকরি নিয়ে । ঢাকায় যাওয়ার পর কর্ম ব্যস্ততার কারণে সংস্কৃতি চর্চা অনেক কমে যায়। তাছাড়া ছাত্রজীবন শেষ হওয়া মাত্রই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণেরও সমাপ্তি ঘটল । তবুও মাঝেমধ্যে ঢাকায় কিছু অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করি । আর ছুটিতে সিলেট গেলে মাঝেমাঝে রেডিওতে খবর পড়তাম । তখন চেষ্টা করছিলাম বাংলাদেশ বেতার ঢাকা ও বিটিভিতে খবর পড়ার। বিটিভি ছাড়া তখন বাংলাদেশে আর কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না। এখনকার মত প্রাইভেট রেডিও চ্যানেলও ছিল না। তবে ঢাকা বেতারে অডিশন দিয়ে নির্বাচিতও হয়েছিলাম। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে যুক্তরাজ্যে চলে আসতে হয়। এখানে আসার পর কিছু বাংলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেও কর্মব্যস্ত জীবনে তা আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি। তবুও প্রবাসে এই কর্মব্যস্তার মাঝে সাংস্কৃতিক জগতটাকে ঠিকই খুঁজে নিয়েছিলাম। বার্মিংহামে একটি স্থানীয় রেডিওতে কিছুদিন অনুষ্ঠান করেছিলাম আরো কিছু রেডিওতে অনুষ্ঠান করার জন্য ডাক এসেছিল। কিন্তু সময়-সুযোগটা ঠিকমত হয়ে ওঠেনি। তবে আমাদের বার্মিংহামেই কিছু সিনিয়র বাঙালী ভাইবোনেরা মিলে অনেক দিন থেকে ওয়েস্ট মিডল্যাণ্ড কালচারাল সোসাইটি নামে একটি সংস্থা চালিয়ে যাচ্ছিলেন । আমাকে পেয়ে তাঁরা খুব আনন্দের সাথেই তাঁদের দলে ভিড়িয়ে নিলেন। এই সংস্থার মাধ্যমে প্রবাস জীবনে যথেষ্ট বাংলা সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ পেয়েছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম। বেশীর ভাগ অনুষ্ঠানই আমি পরিচালনা ও উপস্থাপনা করতাম। সকলে মিলে যখন সুন্দর একটি অনুষ্ঠান দাঁড় করাতাম তখন এক অন্যরকম অনুভুতি জাগত। প্রবাসে আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছি এই অনুভুতিটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় ।
প্রতি বছরই বার্মিংহামে আরও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি । যেমন বাংলা মেলা, বিভিন্ন বাংলাদেশি সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ইত্যাদি। এছাড়াও স্বাস্থ্য সেমিনারে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের বক্তব্য তাৎক্ষনিক অনুবাদ করে বাংলায় উপস্থাপন করেছি । ৯০এর দশকের শেষের দিকে বার্মিংহামে একটি সংস্থা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন ভাষায় অডিও আকারে খবরের কাগজ বের করতো । তাতেও আমি খবর অনুবাদ সহ কন্ঠ দিয়েছি । বিশ্ব নারী দিবসে ‘বাংলাদেশ ওয়েম্যানস এমপ্লয়মেন্ট রিসোর্স সেন্টার বার্মিংহ্যাম-আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমার লেখা নাটক মঞ্চায়ন হয় ।
এদিকে আমার শিক্ষকতা জীবনেও আমি বাংলা সংস্কৃতিকে পরিচিত করে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাই। আমার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতাম। কোনো অনুষ্ঠানে আবার তাদেরকে অনুশীলন করিয়ে অংশগ্রহণও করাতাম। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শহিদ মিনারে গিয়েছি । আবার কোনো বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও বাঙালী ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে বিভিন্ন রকম পারফর্মমেন্স- যেমন বাংলা নাটিকা, বাংলাদেশি পোশাকের ফ্যাশন শো এসব করিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানিনা তবে আত্মতৃপ্তি পেয়েছি।
২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বৃটেনের প্রথম বাংলা চ্যানেল বাংলা টিভিতে নিয়মিত ভাবে প্রতি সপ্তাহ প্রচারিত ‘এসো বাংলা শিখি’ নামে ছোটদের বাংলা শেখার একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি । অনুষ্ঠানটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। এছাড়াও টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রমো, রেডিও এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন সহ আরো অনেক কিছুতেই কন্ঠ দিয়েছি। ২০০৭ সালে বাংলা টিভিতে আমার রচিত ও পরিচালিত এক ঘণ্টার একটি নাটক প্রচারিত হয়। ইংরেজি ভাষায় লেখা আমার কিছু ইসলামিক নাশিদ বৃটেনের কয়েকটি টিভিতে প্রচারিত হয় । ক্রমে কর্ম ব্যস্ততার কারণেই নিজেকে এই জগত থেকে অনেকটা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হই।
ছোটবেলা থেকে এপর্যন্ত যেটুকু মনে পড়েছে সেটুকুই লিখলাম । আরো অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে তবে এর সবই করেছি নিজের সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা থেকে।
লেখক : শিক্ষক, ই.এ.এল কো-অর্ডিনেটর, ব্রডওয়ে একাডেমী (সিক্সথ ফর্ম কলেজ), বার্মিংহ্যাম, যুক্তরাজ্য।