বিদায় দিনে শোক-শ্রদ্ধা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০২১
সারওয়ার কবির :: জননেতা জমির উদ্দীন প্রধান বিদায় নিলেন স্রষ্টার এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। ৮০ বছর বয়সে তাঁর এই প্রয়াণ। কানাইঘাট পৌরসভার নিজ চাউরা দক্ষিণ কান্দেবপুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে সমাহিত করা হয় মসজিদ সংলগ্ন গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে। যে গ্রামই ছিলো তাঁর ঠিকানা সেই গ্রামেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। জমির উদ্দিন প্রধানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি।
জমির উদ্দীন প্রধান-এর বিখ্যাত উক্তি ছিলো “জীবন আওয়ামী লীগ, মরণ আওয়ামী লীগ।” এরকম আজন্ম আওয়ামীপ্রাণ মানুষ আজ সত্যিই পাওয়া দুষ্কর। জীবন দিয়ে ভালোবেসেছেন আওয়ামী লীগকে, ভালোবেসেছেন এলাকার মানুষকে, ভালোবেসেছেন রাজনীতিকে। সত্যিকারের একজন রাজনীতিবিদ বলতে যা বুঝায় তার সবটুকুই ছিলেন জমির উদ্দীন প্রধান। কর্মীদের প্রতি দিলখোলা ভালোবাসা, রাজনৈতিক সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা আর মানুষে-মানুষে যে প্রেম, সেই প্রেমের সংজ্ঞা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে, তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনোয়ন নিয়ে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। নির্বাচনে তাঁর প্রতীক ছিলো নৌকা। জমির উদ্দীন প্রধান প্রায় ১৪ হাজার ভোট পেয়েছিলেন সেই নির্বাচনে। তাঁর ভাষায়, ‘সামরিক স্বৈরাচারী সরকার সে নির্বাচনে তাঁকে জিততে দেয়নি’। তিনি সেবারে জাতীয় নির্বাচনে জিতলে, তাঁর জীবন হয়তো অন্যভাবে মোড় নিতো। আমরা তাঁকে সংসদ সদস্য হিশেবে দেখতাম। হয়তোবা তাঁকে আমরা শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রীসভায়ও দেখতে পারতাম। ৮৬ সালের নির্বাচনে তাঁর জেতা হয়ে উঠেনি। আমরাও তাঁকে সাংসদ হিসেবে দেখতে পাইনি। এরপর অবশ্য “প্রধান”- এর আর কোনও নির্বাচন করা হয়নি।
১৯৭৬ সাল থেকে টানা ১৬ বছর কানাইঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর প্রায় ১২ বছর ছিলেন দলের কানাইঘাট উপজেলা শাখার সভাপতি। গত প্রায় ৩০ বছর ধরে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০২১ সালে জমির উদ্দিন প্রধান, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি- জামাতের দুঃশাসন, স্বৈরাচারী সেনাশাসক, কোনোকিছুই কানাইঘাটের “প্রধান”কে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি। দুঃসময়ে, দুর্দিনে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ঝান্ডা উড়িয়েছেন কাড়াবাল্লা থেকে ফতেহগঞ্জ পর্যন্ত।
রাজনীতি তাঁর কাছে এসেছে বারবার। কানাইঘাটের মানুষকে সাথে নিয়েই রাজনীতি করেছেন তিনি। যে কোনও সাধারণ মানুষের সমস্যা? জনতার নেতার কাছে হাজির সমস্যাগ্রস্ত লোক। নেতাই কোনো না কোনো উপায় বের করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাঁর রাজনীতি ছিলো গণমানুষের জন্য। গণমানুষের ভালোবাসা নিয়েই রাজনীতি করেছেন। রাজনীতি যদি হয় সমাজসেবা, পরোপকার করা, তাহলে জমির উদ্দীন প্রধান শ’ তে শতভাগ পাস করেছেন। তিনি মানুষের মন জয় করেছেন, মানুষকে ভালোবেসেছেন, পরের উপকার করেছেন।
সফেদ পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা, গায়ে মুজিব কোট অথবা সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, আর চোখে চশমা, কানাইঘাট বাজারে বসে আছেন কোনও চায়ের স্টলে জমির উদ্দীন প্রধান। আড্ডার বেশরিভাগ সঙ্গী গ্রামের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী কিংবা উঠতি বয়সী কোনও ছাত্রনেতা। কি রাত-কি দিন, আড্ডা চলছে। রাজনীতি চলছে। রাত ১২টা বাজলেই তবে খবর হতো বাড়ি ফেরার। এর আগে বাড়ি-ঘরের কোনও খবরই নেই। এর মধ্যেই যার যে সমস্যা ‘প্রধান’ আছেন সাথে।
১৯৬৯ সালে ছাত্রাবস্থায় বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ছাত্রলীগের খাতায় নাম লেখান তিনি। ১৯৬৯ সালে কুমিল্লা শহরে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে জাতির পিতার সান্নিধ্য লাভ করেন তখনকার ছাত্রনেতা জমির উদ্দীন । ১৯৭০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় নির্বাচনের প্রচারাভিযানে কানাইঘাটে গেলে সেই মিটিং আয়োজকদের অন্যতম ছিলেন জমির উদ্দীন। বঙ্গবন্ধু ওই মিটিংয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতা জমির উদ্দীনের কর্মতৎপরতা দেখে কয়েকবার “প্রধান” বলে ডাক দেন। সেই থেকে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয় জমির উদ্দীন প্রধান। ১৯৭২ সালে কানাইঘাট উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠণ করা হলে জমির উদ্দীন প্রধান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
১৯৭২ সালের পর পড়ালেখা শেষ করে যোগ দেন শিক্ষকতায়। কয়েক বছর রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ফুলটাইম রাজনীতির কারণে চাকরিও হারাতে হয় তাঁকে। জীবনে শুধু দিয়েই গেছেন বিনিময় ছাড়া। রাজনীতি তাঁর কাছে ছিলো কতনা আপন। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এ অঞ্চলের আওয়ামী লীগ তাঁর কাছে ঝণী, সাধারণ মানুষ তাঁর কাছে ঝণী। কানাইঘাট উপজেলাসহ এর আশপাশে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করতে কতো না সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে, কত ঘাম ঝরাতে হয়েছে। সে খবর দুর্দিনের কর্মী ছাড়া আর কয়জনই বা জানে। জমির উদ্দিন প্রধান, জনতার পাশে থেকে জনতারই সেবা করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিলো বর্ণাঢ্য। রাজনীতিতে তিনি মানুষের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা পেয়েছেন। দীর্ঘ ৬৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তাঁর সম্বল ছিলো মানুষের ভালোবাসা। মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করতো, সম্মান করতো, ভালোবাসতো। কানাইঘাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কর্মীদের সাথে ছিলো তাঁর সখ্যতা। গ্রামে, গ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন দুঃসাহসী জমির উদ্দীন প্রধান।
২০১৪ সালে তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। গত ৬/৭বছর ধরে তিনি অসুস্থবস্থায় বাড়িতেই ছিলেন। ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা জমির উদ্দীন প্রধানের চিকিৎসা সহায়তায় ২০ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন নিজ কার্যালয়ে জমির উদ্দীন প্রধানের হাতে ২০ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিয়ে যে সম্মান দেখিয়েছেন, তা ছিলো স্মরনীয়। তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতার প্রতি, একজন কর্মীর প্রতি এ সম্মান ছিলো অনন্য। এই সম্মান ছিলো কানাইঘাটের আওয়ামী লীগের ‘প্রধান’ এর প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
জমির উদ্দীন প্রধান, তাঁর কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা- তিনি যেন পরোপকারী, দিলখোলা গণমানুষের ভালোবাসার এই মানুষকে জান্নাত দান করেন। ‘জীবন আওয়ামী লীগ, মরণ আওয়ামী লীগ” জমির উদ্দীন প্রধানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী।
৮ জুলাই, ২০২১।