মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের গল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
তাইসির মাহমুদ :: মুক্তিযুদ্ধ কী জানতাম না। শুধু জানতাম সংগ্রামের এক বছর পরে আমার জন্ম। মায়ের মুখে সংগ্রাম শব্দটি খুব বেশি শুনতাম। ভাই-বোনদের কার বয়স কত-এমন প্রশ্নে মা স্বাধীনতা সংগ্রামকে মাইলফলক হিশেবে ব্যবহার করতেন। বলতেন সংগ্রামের ৫ বছর আগে কিংবা ১ বছর পরে। আমার জন্ম সংগ্রামের ১ বছর পরে এ কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। সংগ্রামের সময় আমি মায়ের গর্ভে ছিলাম। মা পাক-সেনাদের ধাওয়া খেয়ে আমাকে পেটে নিয়ে অনেক দৌঁড়িয়েছেন। পাক সেনাদেরকে তিনি পঞ্জাবী বলতেন।
মুক্তিযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। হাঁটিহাঁটি পা পা করে আমিও বড় হচ্ছি। তাই ঘরে আত্মীয়-স্বজন এলে শুধু মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম। পাক সেনাদের অত্যাচার থেকে বেঁচে যাওয়ার নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ চলতো। মা যখন যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতেন তখন মাঝে মাঝে তাঁর গা শিউরে উঠতে দেখতাম। একটি গল্প মা প্রায়শই বলতেন। বলতেন, আমার তো বেঁচে থাকার কথা ছিলো না। কীভাবে বেঁচে গেলাম জানি না। সেদিন বাড়িতে আসে পাকসেনাদের একটি দল। আমি তাঁদের দেখে দৌঁড় দিই। ওরা আমাকে দাঁড়াতে বলে। আমি দৌঁড়াতে থাকি। ওরা বলে, না-দাঁড়ালে গুলি করবে। আমি থামি না। দৌঁড়াতেই থাকি। ওরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। আমি কালেমা পড়তে থাকি। বুঝতে পারি গুলিটি আমার মাথার চুল দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে গেছে। ততক্ষণে আমি বাড়ির পাশে উঁচু আমন ধানে পৌঁছে যাই। আমাকে আর তারা খুঁজে পায় না।
মা গল্প বলতেই থাকেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ হয়েছিলো আষাঢ় মাসে। তখন বাড়ির চারদিকে ছিলো লম্বা-লম্বা আমন ধান। দিনের বেলা গ্রামের সব মহিলারা মিলে সেখানেই আড্ডা দিতাম। নিচে পানি। পানির মধ্যে অসংখ্য জোঁক। আগে থেকেই সেখানে নৌকার ব্যবস্থা করে রাখা হতো। যাদের নৌকা নেই তারা কলা গাছ কেটে ভেলা বানিয়ে রাখতেন। সেগুলোতে বসে বসে সারাদিন সময় কাটতো। তবে জোঁকের যন্ত্রণায় আমরা অস্থির থাকতাম। সংগ্রামের বছর যেমন আমন ধান খুব বেশি ছিলো তেমনী জোঁকেরও প্রাদুর্ভাব ছিলো। রক্তচোষা জোঁক কত রক্ত খেয়েছে তার হিসাব নেই। মা গল্প বলতেই থাকেন। আমরা ধান ক্ষেতে যাওয়ার আগে হাতে-পায়ে তেল লাগিয়ে যেতাম। খেলনা নৌকা বানিয়ে তাতে কিছু চুন দিয়ে লবণ মিশিয়ে নিতাম। জোঁকগুলোকে পা থেকে ছাড়িয়ে এই খেলনা নৌকায় রাখতাম। তাহলে ওগুলো মরে যেতো। জোঁকগুলো এভাবে না মারলে তাদের অত্যাচার দিনদিন বেড়ে যেতো।
দিনের বেলা ঘরে কোনো রান্না-বান্না হতো না। কারণ পাক সেনাদের ভয়। ওরা যখন-তখন হানা দিতো। তাই রাতেই রান্নাবান্না করে নিতাম। সকালে খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে আশ্রয় নিতাম ধানক্ষেতে। দুপুরে নৌকা ও ভেলায় বসে বসে খাবার খেতাম। প্রত্যেকেই পান-সুপারি নিয়ে যেতেন। সারাদিন পান-সুপারি চিবাতাম আর চুটিয়ে গল্প করতাম। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। হঠাৎ একদিন আব্দুল মুকিত (আমাদের এক চাচা) বাড়িতে এসে হাজির। ওর হাতে রাইফেল। আনন্দের আতিশয্যে এদিক-ওদিক গুলি ছুড়ছে। বুঝতে পারছিলামনা ও কেন যুদ্ধ থেকে ফিরে এলো। কারণ আমি ভাবতে পারিনি এতো তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। মুকিত বললো, ভাবী দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তাঁর কথা বিশ্বাস হচ্ছিলো না। পরে রেডিওতে বিজয়ের খবর শোনে বিশ্বাস হলো।
বাবাও মাঝে মধ্যে যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতেন। একদিন পাক সেনা বাড়িতে এলো। বাবা ও বৃদ্ধ দাদা তখন বাড়িতে। বাবার কাছে জানতে চায় বাড়ির মহিলারা কোথায়? তিনি বলতে না চাইলে তাঁকে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে। দাদার গায়েও আঘাত করে রাইফেলের বাট দিয়ে। বাবা বলেন, দাদার গায়ে আঘাতের সাথে সাথে তিনি রেগে ফেটে পড়েন। প্রতিজ্ঞা করে বসেন, আরো একটি আঘাত এলে তিনি জীবনের মোহ ত্যাগ করবেন। দা দিয়ে কুপিয়ে খতম করবেন পাঞ্জাবীকে। ভ্যাগিস ওরা আর কোনো আঘাত না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
বাবা বলতেন, পাক-সেনারা গ্রামের বৃদ্ধ লোকজনকে দিয়ে সারাদিন কাজ করাতো। সকালে এসে তাঁদেরকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেতো। কোথায়ও সারাদিন রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ করতে হতো। কাজে কোনো বিরতি দেয়ার সুযোগ থাকতো না। কাজ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকলে নির্যাতন করতো। গুলি করার ভয় দেখাতো। তাই সারাদিনই বিরামহীন কাজ করতে হতো। কখনোবা রাস্তার পাশে বাংকার খননের কাজ করাতো। বাড়ি থেকে কলা গাছ ও সুপারি কাছ কেটে নিয়ে যেতে হতো। বাংকারের মুখে শেকড়বিহীন কলা আর সুপারি গাছ রোপন করে তাতে পানি ঢালতে হতো। বাংকারের মুখে এগুলো রোপন করে তারা মুক্তিবাহিনীর গুলি থেকে বাঁচতে চাইতো। তিনি বলেন, মানুষ নির্যাতনের ভয়ে সারাদিন কাজ করলেও রাতের বেলা মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানিদের অবস্থান জানিয়ে দিতো। মুক্তিবাহিনী এসেই গুলিতে উড়িয়ে দিতো ব্যাংকারগুলো।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।