‘হ্যালোইন’ কার উৎসব, কারা পালন করছে?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০২০
ওয়াসিক সিদ্দিকী :: দু-দশক হল স্বদেশের মাটি ছেড়েছি। ছাড়তে পারিনি মাটির টান। দেশ ও জাতির প্রতি, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই দেশের খবর নিই নিয়ম করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অক্টোবর-নভেম্বর মাস এলেই দেখতে পাই দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয় কিছু সচিত্র সংবাদ। তা হল ,আমাদের দেশে ইদানিং হ্যালোইন পার্টি উদযাপিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ মহানগরগুলোর নাইট ক্লাব ও ধনাঢ্য বসতিতে পালন করা হয় ’হ্যালোইন নাইট’। যা আবার ইউটিউব ফেইসবুকে লাইভও করেন কিছু অতি উৎসাহী । কেন যেন মনে হচ্ছে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি উত্তর-আধুনিকতার প্যাকেটে বাংলাদেশের মানুষকে গেলানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত একটি মহল এইসব ঘটনার নেপথ্যে পরিকল্পিত তৎপরতায় লিপ্ত। এ লেখাটিতে মূলত হেলোইন এর পোস্টমর্টেম করে ভেতরটা দেখাতে চেয়েছি, তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি এই মূর্খ বদ-রসুমের বীভৎসতা।
ইউরোপ আমেরিকায়, পশ্চিমা মহাদেশগুলোতে মহাউৎসাহে উদযাপিত একটি উৎসবের নাম হ্যালোইন। এইসব জনপদে আচরিত ও চর্চিত প্রাচীনতম পর্বদিনগুলোর মাঝে হ্যালোইন অন্যতম। জনপ্রিয়তার দিক থেকে ক্রিসমাসের পরই এই উৎসব এর স্থান। কিন্তু হ্যালোইনের গোড়ার কথা কি? কোথা হতে কিভাবে কখন এর উৎপত্তি? কি ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার বা সংস্কার রয়েছে এই উৎসবের মূলে? তা জেনে বা না জেনেই আমাদের অনেকে আজকাল এইসব উৎসব পালন করতে শুরু করে দিয়েছেন অন্যের দেখাদেখি। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে আমাদের এই প্রজন্মের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের মাঝে হ্যালোইন নিয়ে মাতামাতি ও আগ্রহ জন্ম নিয়েছে ইদানিং। এ ব্যাপারে বড়রা হয়তো বলবেন যে, “হাসি তামাশার বিষয় হিসেবে একটু-আধটু কস্টিউম পরে বাচ্চারা পাড়া-মহল্লায়, বাসাবাড়িতে ক্যান্ডি সংগ্রহ করে কিছু আনন্দ-ফুর্তি করবে, আমরা তো এর আসল ধর্মীয় রীতি পালনের জন্য তা করি না। এ শুধু বাচ্চাদের সাময়িক আনন্দ ফুর্তির আয়োজন। “কিন্তু আসলে হ্যালোইনের মূলকথা জানলে হয়তোবা আপনিও আপনার সন্তানকে এরকম একটি অপসংস্কৃতি চর্চা করতে দিতেন না। তবে তা অবশ্যই নির্ভর করে আপনি কতটুকু আত“-সচেতন? নিজস্ব ধর্ম, বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নিজের কতটুকু আবেগ অনুভূতি রয়েছে? কতটা গভীর উপলব্ধি ও বোধ আছে আপনার হৃদয়ে, তার ওপর।
“ক্যালটিকরা তাদের বছরের শেষ দিন ৩১শে অক্টোবরের দিবাগত রাত বছরের সবচেয়ে অন্ধকার, অশুভ ও ভীতিকর রাত বলে বিশ্বাস করতো। তারা ভাবতো এই অশুভ রাতে মৃত মানুষের সব আত্মা দুনিয়ায় এসে জীবিতদের নিয়ে যেতে চায় তাদের আত্মার জগতে। তারা জীবিতদের ক্ষতিসাধন করতে চায় । এমনকি মেরে ফেলতেও চায়, যাতে জীবিতরা মৃতদের সাথে যোগ দিতে পারে।”
প্রতি বছর অক্টোবর মাসের একত্রিশ তারিখ পালন করা হয় এই হ্যালোইন উৎসব। হ্যালোইনে লোকেরা হাসি-তামাশার দিন হিসেবে হাস্য-রসাত“ক পোশাক-পরিচ্ছদ পরে থাকে। ভূত-পেত্নী, রাক্ষস-খোক্ষস ইত্যাদি কল্পিত অশরীরীর হরেক রকম পোশাক-আশাক। কেউ বা কিম্ভুতকিমাকার মুখোশ পরে হাঁটাচলা করে। এগুলির কোনো কোনটি মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া হাস্যরসে ভরা। কিন্তু বেশির ভাগই দুর্বল চিত্তের মানুষের মনে ভয় জাগানিয়া, ভয়ঙ্কর ও অদ্ভুত। হ্যালোইনে কেউ ছোট বড় ভোজ-ভাজের অনুষ্ঠান করে। অনেকে আবার একে ধর্মীয় একটি পর্ব দিন হিসেবে পালন করে, চার্চে যায়। যে ধর্ম বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে ভুত-প্রেত, অপদেবতা, অশুভ আত্না, অশরীরি প্রেতাম্না ইত্যাদিকে আরাধনা ও পূজা অর্চনার কুসঙস্কারাচ্ছন্ন চর্চা।
এই দিনটির উৎস ও ক্রমবিকাশ যে জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে, যারা মূলত এর আচার বা লালন করে থাকেন সেই খ্রীষ্ট জগতেই এই দিনটির আচরণগত বা মৌলিক উৎসগত ভিত্তি ও ইতিহাস নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। প্রত্যেকটি প্রপঞ্চ নিজ নিজ বিশ্বাসের আলোকে এর ব্যাখ্যা করে থাকেন। হ্যালোইনের উৎস বিষয়ে বিতর্ক বহুযুগ ধরে তাদের মাঝে বিরাজ করলেও অবলীলায় তারা সবাই এই উৎসব পালন করতে দ্বিধাবোধ করেননি। কোনো জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ধর্মীয় বিশ্বাস হতে এই দিনটি মানার জন্য তাগিদ আসে, তা না ভেবে চিন্তে তারা খেল-তামাশার বিকেল হিসেবেই কাটান হেলোইনের সময়টি। রসবোধ ও কৌতুকই প্রাধান্য পায় তখন। ভাবতে সময় হয়না এর মূল কথা।
সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা বলছেন, হ্যালোইনের জন্ম প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইউরোপে। সে সময়টায় ক্যালটিক বা ক্যালট নামে এক জাতি বসবাস করত ঠিক সেখানে, যেখানে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অবস্থিত। ক্যালটিকদের মাঝে জন্ম ও উদযাপিত হলেও সে সময়কার প্রায় সমগ্র ইউরোপে এই হেলোইন সংস্কৃতির চর্চা বিস্তার লাভ করেছিল ব্যাপকভাবে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা রোমান বছরের একত্রিশ অক্টোবর তারিখটি ক্যালটিক বর্ষপঞ্জির শেষ দিন। কেননা ইংরেজি নভেম্বরের প্রথম দিবস ক্যালটিকরা নববর্ষ হিসেবে পালন করত। প্রাচীন ক্যালটিক বর্ষপঞ্জিতে বছর শুরু নভেম্বরের পয়লা দিন হতে। সে হিসেবে অক্টোবরের শেষ সময়টা একাধারে ফসল তোলার মৌসুম এবং বছরের শেষ দিন। তাই এসব উপলক্ষকে সামনে রেখে একত্রিশ অক্টোবর সন্ধ্যায় তারা সায়িন বা সেমহেইন নামে একটি পর্ব পালন করত। তারা সেমহেইন সন্ধ্যাকে জাদুময় অতিপ্রাকৃতিক ধর্মীয় আচার রজনী বিবেচনা করত। তারা বিশ্বাস করতো এযাবৎ সব মৃত মানুষের আত“াগুলি ভূত-প্রেতের আকার ধারণ করে ওই রাতে তাদের মাঝে ফিরে আসে এবং হাঁটাচলা করে পৃথিবীময়।
গ্রীষ্মকাল যেমন আলোকোজ্জ্বল হয় উলটো শীতকাল তাপহীন, অনুজ্জ্বল ও মলিন থাকে। তাই ক্যালটিকরা তাদের বছরের শেষ দিন একত্রিশে অক্টোবরের দিবাগত রাত বছরের সবচেয়ে অন্ধকার, অশুভ ও ভীতিকর রাত বলে বিশ্বাস করতো। তারা ভাবতো এই অশুভ রাতে মৃত মানুষের সব আত“া দুনিয়ায় এসে জীবিতদের নিয়ে যেতে চায় তাদের আত“ার জগতে। তারা জীবিতদের ক্ষতিসাধন করতে চায় । এমনকি মেরে ফেলতেও চায়, যাতে জীবিতরা মৃতদের সাথে যোগ দিতে পারে। তারা বিশ্বাস করতো, গ্রীষ্মের খরতাপের পর অশুভ আত“াগুলো শীতের ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে পৃথিবীতে চলে আসে। আর তাই শীতে মাঠে ঘাটে কেবল নির্জীব শুস্কতা বিরাজ করে। খামারে ফসল ফলে না, গাছের পাতা শুকিয়ে যায়, বৃক্ষলতা মারা যায়, চারপাশের সবকিছু নির্জীব প্রাণহীন হয়ে যায়। তাদের এমন ধারণাও ছিল, মৃত পূর্বপুরুষদের আত“া অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছু জানে। খারাপ আত“াগুলোই ফসল না ফলার জন্য দায়ী। তাই হেলোইনের রাতে খারাপ আত“াদের ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারলে কিংবা পুজো অর্চনা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলে আগামী মৌসুমে ফসল আর ফল-ফলাদি ও চাষাবাদ সমৃদ্ধ হবে।
ক্যালটদের জনপদে এসব কারণে তারা সামষ্টিক প্রেত পূজার আয়োজন করতো। হ্যালোইন সন্ধ্যায় সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী বড় আকারের আগুনের কুন্ড জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে নৃত্যগীত করতো। এ সময় তারা ভূত পেত্নীর মত সাজসজ্জা করে অগ্নিকুন্ডের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াতো, যাতে ভূতেরা তাদের চিনতে না পারে ও ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। কিংবা ভূতেরা তাদের মতোই দেখতে মুখোশ পরা মানুষজনকে বিদেহী আত“া ভেবে ক্ষতিসাধন না করতে পারে। যাতে আত“ারা জীবিতদের দুনিয়া ছেড়ে মৃতদের দেশে চলে যায়। এ ছিল আদিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ক্যালটদের অলীক ধারণা।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সহ বিশ্বের বড় বড় বিশ্বকোষগুলিতে এই হ্যালোইনকে প্যাগান ধর্মালম্বীদের একটি পবিত্র দিন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যে দিনটি তারা মৃতদের সম্মানে পালন করত। এখানে প্যাগান শব্দটির কথা একটু এখানে বলে রাখি। শব্দটি ইউরোপীয় খ্রিস্টান জগতে সৃষ্ট ও বহুল ব্যবহৃত একটি অভিধা। এর মূল অর্থ পৌত্তলিক বা মূর্তিপূজারী। খ্রিস্টানরা অতীতে শব্দটি দিয়ে শুধুমাত্র অখ্রিস্টান সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বুঝাতো। পরবর্তীতে খ্রিস্টান, ইহুদী ও মুসলিম নয় অর্থাৎ আহলে কিতাব কিংবা বাংলায় বলতে গেলে আসমানী কিতাবের ধারক নয় এমন সব ধর্মবলম্বীদের বুঝতে শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। যদিও বর্তমানে শব্দটির উৎপত্তিকালীন অর্থে এটি আর ব্যবহৃত হয় না। এখন এটার কোন অর্থবহ মানেই বর্তমান নেই। কেননা খোদ খ্রিস্টানরাই কালের বিবর্তনে মূর্তিপূজারী হয়ে গেছে। খ্রিস্টানরা নবী ঈসা বা জেসাস, নবীমাতা মারিয়াম (আঃ) বা মেরীর কল্পমূর্তি নির্মাণ করে চার্চে, কাথিড্রালে করছে ওইসব নিপ্রাণ পাথরের পূজা অর্চনা। ত্রিত্ববাদী, সঠিক অর্থে বলতে গেলে বর্তমান বহুত্ববাদী খ্রিস্টানরা এমনকি তাদের সাধুসন্ত সেইন্ট জেইমস, সেইন্ট পল, সেইন্ট মার্টিন ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের কল্পমূর্তি তৈরি করে তাদেরও পূজো দিচ্ছে। তাই তাদের কাছে শব্দটির যথার্থ পূর্ণতা বহন করে না।
যাইহোক আমাদের মুল আলোচনা ছিল হেলোইন। হ্যালোইনের সাথে মূলত খ্রিস্টান অল সেইন্টস ডে বা সর্বসাধু দিবস এবং ক্যালটদের সেমহেইন এর গভীর সম্পর্ক। অল হেলো’স ইভ পালন করা হতো অল সেন্টস ডে’র পূর্ব সন্ধ্যায়, অর্থাৎ একত্রিশে অক্টোবর বিকেলে। পহেলা নভেম্বর এর আগের সন্ধ্যায়। ইউরোপে যখন খ্রিস্টধর্ম বিস্তার লাভ করে তখন বর্তমান গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের নভেম্বর মাসের পয়লা তারিখে অল সেইন্টস ডে পালন করা হয়। তৎকালীন ধর্মহীন মানুষকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার উৎসব ছিল পয়লা নভেম্বর। সকল পূর্বতন সাধু ব্যক্তির স্মরণে, তাদের আত্নার শান্তি কামনায় পালিত হতো অল সেইন্টস ডে। ওই সন্ধ্যায় ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করে খ্রিষ্টধর্মে স্বাগত জানানো হতো নবাগতদের। কিংবা সারা বছর ধরে যারা খ্রিস্টান হতো তাদেরকে ঐ সন্ধ্যায় অভিষেক জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রহণ করা হতো নবদীক্ষিতদের।
কিন্তু কালের বিবর্তনে খ্রিস্টধর্ম যখন ইউরোপে ক্রমশ বিস্তার ও প্রতিপত্তি লাভ করে খ্রিস্টানরা তখন অ-খ্রিস্টীয় এই জাতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে কটাক্ষ ও ভ্রƒকুঞ্চিত দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ক্যাথলিক চার্চ ছলনার আশ্রয় নেয় । তারা ক্যালটদের সোইন বা সামহেইনকে ভেটিকান চার্চ স্বীকৃত পবিত্র দিন হিসেবে ঘোষণা করে পালন করতে শুরু করে। কিন্তু তারা এর ভিন্ন নাম দেয় অল সেইন্টস’ ডে। সামহেইন বলি বা অল সেইন্টস ডে বলি, উভয় ধর্মাচার এ রয়েছে মৃত্যুপরবর্তী জগতের ধারণা কেন্দ্রিক। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর পর তারা অন্য এক রূপান্তরিত জগতে থাকেন এ জাতীয় বিশ্বাস ভিত্তিক। আসলে খ্রিস্টান চার্চ কর্তৃপক্ষ অনেক হিসাব-নিকাশ করে এ দুটি ভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানকে একাকার করে ফেলে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে।
অল সেইন্টস ডে’ র মোড়কে তারা ভিন্ন ধর্মের এক অনুরূপ আচার-অনুষ্ঠানকে একীভূত করার সুপ্ত উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হলো প্যাগানদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে আকর্ষণ করা ও ধর্মান্তরিত করার মাধ্যমে সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করা। অল সেইন্টস’ ডে কে তারা ক্যালটদের সেমহেইন এর সাথে মিল রেখে ও একীভূত করে নতুন শংকর জাতীয় ধর্মাচারের নামকরণ করে হেলোমাস নামে। ইউরোপীয় স্কটিশ হ্যালো শব্দের মানে হল পবিত্র আর ম্যাস হল আনন্দপ্রহর বা শুভক্ষণের আচার-অনুষ্ঠান। ক্রিসমাস শব্দটিতে যেমন ম্যাস শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অক্টোবর এর শেষ তারিখ পূর্বে ছিল অল হেলো’স ইভ, যা ক্রমে হেলোইভ থেকে হ্যালোউইন শব্দে রূপান্তরিত হয়ে ব্যবহৃত ও পালিত হতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই উদ্ভট সংস্কৃতির জন্ম দেয়া ও একে লালন করার সাথে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের বস্তুবাদী চিন্তা ও ধর্মব্যাবসায়ী ভোগবাদী পুরোহিত মহলের স্বার্থ সরাসরি জড়িত ছিল ।
পরবর্তীতে আঠারোশো চল্লিশ সালে ইউরোপে যখন পটেটো ফ্যামিন বা আলু চাষে দুর্যোগ দেখা দেয়, আর তা দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। ইউরোপিয়ানরা সেসময় জীবন ও জীবিকার অন্বেষায় উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমাতে থাকে। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তারা এ ভূখণ্ডে ব্যাপক হারে আসতে শুরু করে। সাথে নিয়ে আসে তাদের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও উৎসব অনুষ্ঠান। সেসময় হেলোইন আমেরিকা প্রবেশ করে। তারা হেলোইনের ঠাট্টা-মশকরার সংস্কৃতি আমেরিকায় চালু করে। হেলোইনে তরুণরা কৌতুকচ্ছলে মানুষের বাড়ি ঘরে হানা দিত, বাড়ির ফটক খুলে অন্যত্র লুকিয়ে রাখতো। হেলোয়িন সন্ধ্যায় বাড়িঘরে, পথে-ঘাটে লোকজনকে ভয় দেখানোর কৌতুক করতো। ভূত-প্রেতের মুখোশ পরা থাকার কারণে তাদেরকে বাড়িওয়ালারা শনাক্ত করতে পারত না। কিন্তু এই তামাশা কৌতুকের সংস্কৃতি কিছুকাল পরে আর নির্দোষ হাস্যরসে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সীমা ছাড়িয়ে ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত“ক সামাজিক অপরাধে রূপ নেয়। উনিশশো ত্রিশ সালের সালের দিকে আমেরিকার হেলোয়িন এক ভয়ঙ্কর বিপদজনক অপসংস্কৃতির আকার ধারণ করার ফলে লোকজনকে এমনকি প্রশাসনের সাহায্যপ্রার্থী হতে হয়েছিল। হেলোইনের সৌাগান “ট্রিক অর ট্রিট” “ক্যান্ডি দাও অথবা তোমাদেরকে ভয় দেখাবো ” তখন আর নির্দোষ কৌতুক বিবেচিত হতোনা। হ্যালোইন পরিণত হয়েছিল ধর্মানুষ্ঠানের নামে এক ধরনের অত্যাচারে। কিন্তু সে সময় থেকেই আবার “ট্রিক অর ট্রিট” আনন্দ দিনের সম্ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। মোটামুটি এই হল হ্যালোইন এর আদ্যোপান্ত ।
দুহাজার বছর আগে ইউরোপে জন্ম নিলেও বর্তমানে এশিয়া , আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, দুই আমেরিকাসহ সারাবিশ্বেই এই হেলোয়িন প্রসারিত হয়েছে। এশিয়ার বেশ কিছু দেশে আগে থেকেই পালিত হলেও প্রিয় মাতৃভূমি জন্মভূমি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী এই অপসংস্কৃতি কথা এই কিছুদিন আগেও জানত না। তবে লক্ষণীয় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বড় শহর নগরের এলিট লোকালয়ে এবং বিদেশী দূতাবাস পাড়ায় দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত নব্য গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি বেশ খানিকটা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে এটা যেন আকর্ষণীয় চৌকষ রীতি হিসাবে চর্চিত হতে যাচ্ছে। বহু শতাব্দীকাল হতে চর্চিত আমাদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস, অনুশাসন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর এ যেন এক বিজাতীয় নগ্ন হামলা হিসাবে আত“ প্রকাশ করছে। এইসব অপসাংস্কৃতিক চর্চা আমাদের নতুন প্রজন্মের মন, মনন ও চিন্তার বিধ্বংসী বিপর্যয় বলে আমরা মনে করি।
বিশ্বনবী মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ ( সাঃ) এর একটি হাদীসের বাণী দিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪০৩১। ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। সনদ সহীহ।) তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্ট্রি এন্ড কালচার অফ কেলটিকস, এনসিয়েন্ট ইউরোপিয়ন্স, অকালট বিলিফস।
ওয়াসিক সিদ্দিকী : লেখক ও গবেষক, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।