ব্রিটেনের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি প্রার্থী আপসানা যেভাবে এগিয়ে গেলেন
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ অক্টোবর ২০১৯
রহমত আলী :: আনন্দ উচ্ছাসটা ছিল অনেকটা সে রকমই, যে রকম একটি চূড়ান্ত নির্বাচনে জয়লাভ করলে হয়ে থাকে। শুধু নেতাকর্মী বা নির্ধারিত আসনের লোকজন নয় সমগ্র পূর্ব লন্ডনের বাঙালিরাও যেন গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন এ নির্বাচনের ফলাফল কী হয় তা জানার জন্য। এমনকী দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে টেলিফোন করে জানতে চেয়েছেন সর্বশেষ খবর কী। আর এ সবের মাত্র একটি কারণ যা ছিল আরেকজন ‘বাঙালি এমপি’। প্রার্থী নির্বাচনের এ প্রতিযোগিতায় আপসানা যদি টিকে থাকেন তবে তিনিই হবেন সংশ্লিষ্ট আসনের পরবর্তী এমপি পদপ্রার্থী।
বহুদিন থেকে এ আসনে একটি প্রথা রয়েছে যে, লেবার পার্টির স্থায়ী এ আসনে যিনি নমিনেশন পান তিনি নিশ্চিতভাবেই হন সে আসনের পরবর্তী সংসদ সদস্য। অন্তত বিগত কয়েক দশকের ইতিহাস তাই বলে। সে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বর্তমান এমপি জিম ফিজ প্যাট্রিক প্রায় দুই যুগ থেকে এখান থেকে নির্বাচিত হন নিকটতম প্রার্থীর চেয়ে বিরাট ভোটের ব্যবধানে।
ব্রিটেনের বহুজাতিক সমাজব্যবস্থায় ‘প্রথা‘ বলে একটি অবিধা রয়েছে। আর সে অবস্থায় তা অন্যান্য অনেককিছুর মতো ‘হাউজ অব কমন্সে’ কিছু আসন রয়েছে যেগুলি যেন সেই নিয়মেরই অন্তর্ভূক্ত। এই আসন গুলোর পরিবর্তন কোনো বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া সহসা হয় না। তবে কিছু কিছু ‘মার্জিনাল সিট’ রয়েছে যেখানে দলের সাম্প্রতিক নীতি ও প্রার্থীর জনপ্রিয়তার মাধ্যমে হেরফের হয়ে থাকে। টাওয়ার হ্যামলেটস এর দু’টি আসনই যেন লেবার পার্টির ‘ট্রেডিশনাল সিট’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে ‘বেথনাল গ্রিন ও বো’ আর অন্যটি হচ্ছে পপলার এণ্ড লাইম হাউজ। এ দু’টি আসন অনেকটা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ‘ঢাকা উত্তর‘, ‘ঢাকা দক্ষিণ‘ এর সাথে তুলনা করা যায়।
বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের একটি আসনের বর্তমান এমপি হচ্ছেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম বাঙালি এমপি রুশনারা আলী। আর অন্যটির বর্তমান এমপি জিম-ফিজ-প্যাট্রিক যিনি রাজনীতি থেকে সম্প্রতি অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আর এই ঘোষণার সাথে সাথেই স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি বংশোদ্ভূত একজন এমপি নির্বাচনের প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর এ থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু। তবে এ প্রক্রিয়া অতিক্রম করে এ পর্যায়ে আসামাত্র ২৩ বছর বয়সী এক মেয়ের পক্ষে সহজ সাধ্য ব্যাপার ছিল না।
এখানে বাঘা বাঘা পুরুষ প্রার্থী ছিলেন, যারা নানা দিক থেকে প্রভাবশালী ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তারা বিগত কয়েক বছর থেকে প্রচারণায়ও চালিয়ে আসছিলেন। বলা যায়, এ আসন ছিল তাদের প্রত্যেকের জন্য একটি সাজানো বাগান। কিন্তু লেবার পার্টির উপর মহলের একটি সিদ্ধান্তে যেন তাদের সেই বাগান তছনছ হয়ে গেল। এ আসনকে ঘোষণা করা হলো ‘‘অল ওমেন সিট”। অর্থাৎ কেবলমাত্র মহিলারাই এ আসনের এমপি হওয়ার জন্য নমিনেশন প্রাপ্ত হবেন। তবে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিকভাবে সম্ভাব্য পুরুষ প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হলেও তা ধুপে টেকেনি। সিদ্ধান্তে দলের এনইসি (কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি) অটল থাকে। কারণ লেবার পার্টির বর্তমান পুরুষ সংসদ সদস্যদের চাইতে নারী সদস্য সংখ্যা অনেক কম। তাই তারা চায় পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদেরকে সমতায় নিয়ে আসতে।
এই সমতার মারপ্যাচে পড়ে যখন পুরুষ প্রার্থীরা হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন কেউ কেউ এ জন্য এই অল্পবয়সী মেয়ে আপসানাকে দোষারোপ করেন। তাদের অনেকের ধারণা যে, দলের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সুবাদে আপসানা বেগমের উর্ধ্বতন মহলের সাথে যোগাযোগের সুযোগ রয়েছে, তাই একমাত্র আপসানাই সে কাজ করতে পারেন। তাই নমিনেশন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও প্রথমেই তাকে নানা বিতর্কে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পর্যবসিত হতে হয়। বলতে গেলে এ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশিসহ তাদের অনুসারীদের ধাক্কা সামলাতে তাকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’। কোনো রকমে নির্বাচনী দৌঁড়ে টিকে থাকলেন আপসানা।
এরপর যখন পার্টি নমিনেশনের জন্য দরখাস্ত আহবান করা হলো তখন তাকে আরও ১৫ জনের সাথে লড়তে হলো। এমতাবস্থায় অনেক যাচাই-বাছাই এর পর দলের নির্বাহী পরিষদ অন্য দুইজনের সাথে সেরা হওয়ার তালিকায় জুড়ে দিলো তাকে। যাকে বলে ‘শর্ট লিস্ট’। এ তালিকায় স্থান পেলেন আপসানা বেগম, আমিনা আলী ও অন্য একজন সাদা প্রার্থী যার নাম নির্বাচনের দিন ব্যালট পেপারে ছিল না। শুরু হলো ক্যাম্পেইন এ আসনের সমস্ত লেবার পার্টির মেম্বারদের মধ্যে। এখানেও সেই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকে তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়ে নানা অপবাদ ছড়াতে থাকে বলে প্রকাশ। ফলে বাঙালি কমিউনিটি অনেকটা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। শঙ্কিত হয়ে পড়েন এ কমিউনিটির সচেতন মহল।
প্রায় এক সপ্তাহ এভাবে নানা প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে ক্যাম্পেইনে অংশ নিতে হলো আপসানা ও তার সমর্থকদের। খুবই আতঙ্কিত ছিল সবাই কখন জানি কী ঘটে যায় এই আশংকায়। অনেকটা আশা-নিরাশার দুলাচল চিত্ততায় ভুগতে থাকেন অনেকে। হতাশার করুণ সুর যেন বাজতে থাকে সমর্থকদের কণ্ঠে। কিন্তু এর পরেও আপসানার আত্মবিশ্বাস সবাইকে উজ্জীবিত করে সকলকে সামনে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে। মনে হচ্ছিল তিনি ‘ভেঙ্গে যেতে পারেন কিন্তু মচকাবেন না’।
আসলো ২৭ অক্টোবর স্থানীয় লেবার পার্টির ভোটে তিনজন থেকে একজন সিলেকশন করার পালা। যাকে বলে ‘হাসটিংস‘। অর্থাৎ উক্ত নির্বাচনে যিনি জয়লাভ করবেন তিনিই হবেন লেবার পার্টির নিরাপদ এই আসনের পরবর্তী এমপি পদপ্রার্থী। যার বিজয় অনেকটা সুনিশ্চিত বলে ধরে নেয়া হয়। তাই সকল প্রার্থী কামড় খেয়ে পড়ে এ নির্বাচনে জয়লাভের জন্য। ভোটের আয়োজন করা হয় স্থানীয় সেন্টপলসওয়ের সেন্টপলস চার্চে। নির্বাচন পরিচালনাকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বিকাল ৪টার সময় হল গেইটে আসার জন্য। কিন্তু দেখা যায় নির্ধারিত সময়ের পূর্ব থেকেই লোকজন সেখানে উপস্থিত হতে শুরু করেন। বেলা যত গড়াচ্ছিল লোকসমাগম তত বাড়তে দেখে অনেকে আশংকা করেছিলেন যে আয়োজিত হলে স্থান সংকুলান হবে কি না। এরই মধ্যে খানিকটা বিলম্ব হতে থাকলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায়। শেষ পর্যন্ত হলের দরজা খুলে দেয়া হলো এবং সাথে সাথে রেজিষ্ট্রেশন প্রক্রিয়াও চলে। প্রায় দেড় ঘন্টার এ প্রক্রিয়া শেষ হলে আরম্ভ হয় -এ আয়োজনের মূল কার্যক্রম।
শুরুতেই দুই প্রার্থীকে একে একে তাদের নির্বাচনী পরিকল্পনা তুলে ধরতে বলা হয়। প্রথমেই আপসানা বেগম এ সূযোগ পান। তিনি সবার সামনে তখন তার লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন। তার বক্তব্য শেষে তাকে আরও পাঁচটি কমন প্রশ্ন আয়োজকদের পক্ষ থেকে করা হয়। তিনি দৃঢ়তার সাথে এগুলির উত্তর দেওয়ার পর হলে তার সমর্থকদের মুহুর্মুহ করতালীর মাধ্যমে তিনি হল ত্যাগ করেন। এরপর আসেন অন্য প্রার্থী আমিনা আলী। তিনিও অনুরুপভাবে লিখিত বক্তব্য পাঠ করার পর ৫টি প্রশ্নের উত্তর দান করেন। তাকেও তার সমর্থকরা হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করেন। হাসটিংস এর চূড়ান্ত পর্ব ছিল পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাভুটি।
এ প্রক্রিয়ায় প্রত্যেককে একটি করে ব্যালট পেপার দেয়া হয় এবং এতে দুই প্রার্থীর নামের পাশে ক্রস চিহ্ন দিয়ে ভোটারগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেচে নিতে ভোট প্রদান করেন। পাঁচ শতাধিক ভোটার এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ তা গণনা করেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। সবাই যখন ফলাফল জানার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন তখনই দায়িত্বরত কর্মকর্তা সবার সামনে এসে ঘোষণা দেন ফলাফলের। অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, কে কত ভোট পেয়েছেন তা উল্লেখ করেই প্রকাশ করা হবে। কিন্তু তা হলো না। শুধুমাত্র বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণাই করা হলো সে যাত্রায়। তবে যেইমাত্র আপসানার নাম ঘোষণা হলো তখন তার সমর্থকদের মধ্যে এক বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস
যেন হলে প্রতিধ্বনিত হলো। সবাই উঠে পড়ে নিজ নিজ আসন থেকে আর উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে নানা শ্লোগান দিয়ে। সর্বশেষ খবরে জানা যায় এ নির্বাচনে আপসানা বেগম পেয়েছেন ২৮১ ভোট আর আমিনা আলী পেয়েছেন ২২৩ ভোট।
আপসানা বেগম লন্ডনের কুইনমেরী বিশ^বিদ্যালয়ের রাজনীতি বিষয়ে ডিগ্রিধারী ও একজন লেবার পার্টি প্রধান জেরেমী করবিন সমর্থিত রাজনীতিক। তিনি ইস্ট লন্ডনেই বড় হয়েছেন ও লেখাপড়া করেছেন।
আপসানা বেগমের দেশের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ইনাতনগর গ্রামে। তাঁর মরহুম পিতা মনির উদ্দিন আহমদ ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সিভিক মেয়র। তিনি বিগত ২০১২ সালে পরলোকগমন করেন।
পরিশেষে আমি এ অপাসনের একজন ভোটার হিসেবে সবাইকে শান্তিপুর্ণভাবে এ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাথে সাথে এটাও কামনা করছি যে, আগামীতেও সাধারণ নির্বাচনসহ আন্যান্য ক্ষেত্রে সবাই শান্তিপূর্ণ ও সহনশীলভাবে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করবেন। বিশেষ করে যাতে কোনো প্রার্থীর প্রতি কেউ কাদা ছোড়াছুড়ি না করেন সে আহ্বানই থাকলো সবার প্রতি।