বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্নভঙ্গ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০১৯
আহবাব মোস্তফা খান, বার্মিংহাম থেকে :: পঁচিশ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার গ্যালারির প্রায় পুরোটা জুড়েই ভারতীয় সমর্থক। ‘জিতেগা রে জিতেগা ইন্ডিয়া জিতেগা’ এই শ্লোগান তাই বেশিই শোনা যায় এজবাস্টনে। সংখ্যায় তারা বেশি হওয়ায় নীলের মাঝে লাল-সবুজ চোখে পড়েছে কমই। বাংলাদেশের অন্য ম্যাচে গ্যালারিতে সমর্থকদের ঢেউ দেখা গেলেও এখানে একদমই বিপরীত চিত্র। তবুও চোখে স্বপ্ন, বুকে সাহস নিয়ে ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ সৌাগানে মুখর ছিলো মাঠ। একটি স্বপ্ন জয়ের আশায়। কিন্তু মোস্তাফিজ, সাকিব আর সাইফের দেখানো স্বপ্ন শেষ বিকেলে হয়ে গেলো ম্লান। অনেক আশার ম্যাচে একটুর জন্য হেরে গেলো বাংলাদেশ। তাতে সেমির স্বপ্ন থেকে গেলো স্বপ্নই।
লক্ষ্য ৩৮৬ কিংবা ৪০০ নয়। লক্ষ্য তো ৩১৫। নাগালের ভেতরেই। এই তো সেদিন অন্ট্রেলিয়াকে ৩৩৩ রান তাড়া করলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাটিতে নামিয়ে আনল। অথচ মঙ্গলবার আর হলোনা। বোলিংয়ে মুস্তাফিজের আলো ছড়ানো দিনেও তামিম, মুশফিক, সৌম্যরা দিলেন হতাশা উপহার। এক সাকিবকে যোগ্য সঙ্গও দিতে পারলেন না। উইকেটে এলেন আর গেলেন। সেদিন যেভাবে ভারত ভুলে গিয়েছিলো ব্যাটিং, ঠিক তেমনই যেন তামিমরাও ভুলে গেলেন ব্যাটিং! তামিমের ২২, মুশফিকের ২৪, লিটন দাসের ২২ হলো টপ অর্ডারদের ব্যাটিং চিত্র। এমন চিত্র দিয়ে কি আর সেমির স্বপ্ন দেখা যায়? আর তাদের ভুলে যাওয়া এমন দীনহীন ব্যাটিংয়ে ভারত এগিয়ে গেলো সেমি ফাইলানের দিকে। আর বাংলাদেশ আটকে গেলো হতাশার চোরাবালিতে। এতে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় পুড়লো বাংলাদেশ। কেবল সাকিবের ৬৬ রানই হতাশাময় গ্যালারীতে কিছুটা আনন্দ দিয়েছিলো। তবে শেষ বিকেলে গোধুলী বেলায় সাইফুদ্দিন যেন আশার আলো হয়ে ওঠেছিলেন। তার ফিফটিতে বাংলাদেশ জয়ের স্বপ্নও দেখে। স্বভাবসুলভ ব্যাটিং চালিয়ে তিনি দেখিয়ে দেন জয় আসলেই বেশী দূরে নয়। তার ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় ২৮৬ রানে। তাতে আক্ষেপটাও যেনে বেড়ে গেলো। ইস আর মাত্র ২৮ রান হলেই তো জয়ের কাব্য রচিত হতো। এ যেন স্বপ্ন দেখিয়ে দেখিয়ে স্বপ্নভঙ্গ।
তবে সেমির স্বপ্ন হোচঁট খেলেও এবার মুগ্ধতা ছড়িয়েছে ঠিকই বাংলাদেশ। সেদিন ভারতের সাথে ম্যাচও রীতিমত ক্রিকেটীয় রোমাঞ্চে ভরা ছিলো। ৩১৫ রানের টার্গেট মোকাবেলা করতে নেমে পর পর উইকেট হারিয়ে একসময়ে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। ৩৩ ওভারের মাথায় শেষ ভরসা সাকিব আল হাসানও যখন দীনেশ কার্তিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান, তখন অতি বড় বাংলাদেশী সমর্থকও ভাবতে পারেননি ম্যাচটা বের করতে পারবেন মাশরাফিরা। বুমরার আগুনে বোলিংয়ের সামনে সৌম্য,তামিম,মুশফিকুররা আগেই আত্মসমর্পণ করেছেন। আশা জাগিয়েও প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন সাকিব। কিন্তু, ক্রিজে সাত নম্বরে ব্যাট করতে নামা ২২ বছর বয়সী সাইফুদ্দিন হয়তো অন্য কিছু ভেবেছিলেন। ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের হাত থেকে ম্যাচ তখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। বল কমে গিয়ে লক্ষ্য ক্রমশই অসম্ভব হয়ে উঠছে। ঠিক তখনই খোলস ছেড়ে বেরোন সাইফুদ্দিন। সাব্বির রহমানকে সঙ্গী করে পালটা মার দিতে শুরু করেন তিনি। কুঁকড়ে না থেকে সইফুদ্দিন সাহসী ব্যাটিং শুরু করেন। তাঁর ব্যাট কথা বলতে শুরু করায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাংলাদেশ। অসম্ভবকে যদি সম্ভব করা যায়! ভারতের আগ্রাসন দেখে গ্যালারিতে ঝিমিয়ে থাকা লাল-সবুজ সমর্থকরা ফের জেগে ওঠেন। এর আগে কেরিয়ারে তাঁর সর্বাধিক রান ছিল ৪১, ব্যাট হাতে কোনও সময়েই সফল হননি তিনি। সেই সইফুদ্দিনই যেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে দেখা দেন এজবাস্টনে। ৩৮ বলে ৫১ রান করে নিজের সেরা ইনিংস খেলেও ম্যাচ বের করতে পারেননি তিনি। তাঁর সঙ্গেই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ এজবাস্টনেই। তবে শেষ মুুহুর্তে তাঁর লড়াই সুরভী ছড়িয়েছে ঠিকই।
ওদিকে, মঙ্গলবার দিনের শুরুটাই নিজেদের করে নেন কোহলি। বাংলাদেশের অতি গুরুত্বর্পনূ ম্যাচের টসভাগ্যও তার। বাংলাদেশকে পাঠালেন বোলিংয়ে। তাতে মোটেই অবাক হওয়ার কথা নয় মাশরাফির। যাদের বিশ¡সেরা ব্যাটিং লাইন আপ তারা তো আর হাতের লক্ষী সহজেই পায়ে ঠেলে দেবেনা। তবে তাদের বোলিং আমন্ত্রন যেন সাদরে গ্রহণ করেছিলেন মোস্তাফিজ। তাই নয়তো কি! কাটার আর ব্লেয়ারের জাদুজালে রীতিমত মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়েছেন এজবাস্টনে। ভারতের বিরুদ্ধে তৃতীয়বারের মতো নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। তার চিরচেনা মায়াবী কাটারে একে একে প্যাভিলয়নের পথ ধরিয়েছেন কোহলী, হারদিক পান্ডে, ধোনী, কার্তিক আর শামীকে। এই মুস্তাফিজ অতীতে ভারতকে আরো বহুবার বেগ দিয়েছেন। আর অতীত ইতিহাস বলে, ওয়ানডেতে মোস্তাফিজ তিন বা এর বেশি উইকেট পেয়েছেন এমন ম্যাচে বাংলাদেশ হারে না। তবে বাঁ হাতি ‘কাটার মাস্টার’ কাল শুরুতেই হিটম্যান রোহিতকে তুলে নিতে পারতেন। একটি সৌায়ার শর্ট বল দিয়েছিলেন ফিজ। ঠিকমতো টাইমিং না হওয়ায় ডিপ স্কোয়ার লেগে তামিম ইকবালের হাতে ক্যাচ যায়। সবাইকে অবাক করে রোহিতকে ফেলে দেন তামিম। রোহিত তখন ৯ রানে আর দল ১৯ রানে। সেই সময়েই যদি ‘হিটম্যান’ ফিরে যেতেন, তা হলে হয়তো ভারতের রানের চিত্র অন্যরকম হতো। জীবন ফিরে পাওয়ার পরেই রোহিতের ব্যাট কথা বলতে শুরু করে। ক্যাচ মিসের পরিনতি যে কী হতে পারে তা বুঝিয়ে দিলেন ৯২ বলে ১০৪ রানের ইনিংস খেলে। তার শতরান হওয়ার পর কমেন্টেটররাও মজার ছলে বললেন, এমন ব্যাটসম্যানকে কি কেউ জীবন গিফট দেয়? সেঞ্চুরি করার পরে রোহিত অবশ্য বেশিক্ষণ টেকেননি। রোহিতকে ফেরান সৌম্য সরকার। তিনি যখন ফেরেন, তখন ভারতের রান এক উইকেটে ১৮০। তখন ৩৫০ রানের পাহাড়ে চড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। তবে মোস্তাফিজের জাদুজালে ৯ উইকেটে ৩১৪ রানের বেশি করতে পারেনি ভারত। রোহিত ছাড়াও লোকেশ রাহুল এ দিন নিজের বদনাম ঘোঁচান। ৯২ বলে রাহুল ৭৭ রান করেন। রোহিতের সঙ্গে ১৮০ রানের পার্টনারশিপ গড়েন ওপেনিং জুটিতে। বিরাট কোহালি (২৬) অন্যদিনের মতো খেলতে পারেননি। ঋষভ প্যাান্থ দ্রুতগতিতে ৪১ বলে ৪৮ রান করেন। তবে হার্দিক পান্ডে রানের খাতা খুলতে পারেননি। ধোনি ৩৩ বলে ৩৫ রান করেন।
আসলে ওভাল থেকে প্রজ্বলিত আশার বাতিটা নিভে গেছে এজবাস্টনে। আজ শুক্রবারের পাকিস্তানের বিপক্ষে লর্ডসে ম্যাচটি বাংলাদেশের জন্য তাই কেবলই আনুষ্ঠানিকতার। সেটিই আবার প্রতিপক্ষের জন্য হতে পারে শেষ চারে ওঠার সিঁড়ি। সমীকরণ যাই হোক, পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচটা খুবই গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে বাংলাদেশ। কোচ স্টিভ রোডসও জানালেন, যাবার বেলায় ২ পয়েন্ট পেতে মরিয়া তার দল।
ওদিকে, আরেকটি কথা না বললে রিপোর্টটি অসমাপ্তই থেকে যাবে। এবারের টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ফুল ফোটাচ্ছেন সাকিব। ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে ইতিহাসের পাতায় নাম তুলে ফেললেন তিনি। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একটি বিশ্বকাপে ৫০০ রান এবং ১০টি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এখন তাঁর দখলে। বিশ্বের এক নম্বর অল রাউন্ডার ব্যাটে তুলেছেন ৫৪২ রান। বল হাতে তুলে নিয়েছেন ১১টি উইকেট। এই মুহূর্তে চলতি বিশ্বকাপে সর্বাধিক রান সংগ্রহের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। সেমিতে পৌঁছতে না পারলেও একজন সাকিবের এই অর্জন বা বাংলাদেশের জন্য কম কিসে!