এমইপি নির্বাচন পর্যালোচনা : টমি রবিনসনকে ফিরতে হলো শুন্য হাতে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুন ২০১৯
মাহী মাসুম : ২০১৯ সালের ২৩ মে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এমইপি নির্বাচনে ভয়াবহ ভরাডুবি হয়েছে ১৮৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী কনজারভেটিভ দলের। আর শক্তি ও সমর্থন কমেছে ১১৯ বছরের শক্তিশালী লেবার দলের । চমক দেখিয়েছে মাত্র তিন মাসের ব্রেক্সিট পার্টি। ব্রিটিশ জনগণ ব্রেক্সিটের পক্ষে মত দিয়েছে আড়াই বছর আগেই, কিন্তু তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। সেইসাথে তেরেসা মে এর অর্থ সংকোচন নীতিতে বেজায় চটেছে তুলনামূলক কম অর্থ আয়কারী বিট্রিশ নাগরিকরা, তার ওপরে কনজারভেটিভ পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে জন ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার মতোই।
জেরেমি করবিন একজন যুদ্ধবিরোধী, আদর্শবাদী ও সাদামাটা রাজনৈতিক ব্যক্তি। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নিয়ে সংসয় ছিলো শুরু থেকেই, ভাল মানুষ হলেই যে ভাল নেতৃত্ব দিতে পারবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া জেরেমি করবিনকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। নেহায়েত সাধারণ
জীবনযাপন করেন এবং অহংকার বা দেমাগের লেশমাত্র নেই, তবে তাঁর বিশ্বাসে কেউ চির ধরাতে পারবে না । করবিনের নীতিবাক্য শ্রুতিমধুর কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা বা ভবিষ্যত রূপ রেখা দেয়াতে তার একটা দুর্বলতা দেখতে পেয়েছে ব্রিটিশ জনগণ।
তেরেসা মে যে সঠিক পথে ব্রিটেনকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন তা হয়তো অনেকই স্বীকার করবেন। কিন্তু জনাব করবিন, জনাবা মে এর সমালোচনা করে বেশি দূর আগাতে পারে নাই। কেননা বর্তমান প্রজন্ম শুধু সমালোচনা শুনে সন্তষ্ট হবে না, তারা চায় দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার সঠিক পরিকল্পনা, যে জায়গাতে লেবার লিডার অনেকটা দূর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করেন সাধারণ জনগন।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ভোটের দিন কাকে ভোট দিলেন বা কেন দিলেন- প্রশ্ন করেছিলাম গ্রেটার ম্যানচেষ্টারের উচ্চবিত্তদের থাকার আবাসিক এলাকা অলটিংহাম জামে মসজিদের কিছু মুসুল্লিকে । বেশিরভাগ মুসলিম লেবার সমর্থক, কিন্তু তারা হতাশ লেবারের সঠিক পরিকল্পনা না থাকায়, সেখানের বেশিরভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন লেবারের পরিবর্তে লিবডেম বা গ্রীন দলকে। তাই এবার ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভকে ডুবিয়ে লিবডেমের জয়জকার, সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ইতালীতে জন্ম নেয়া গ্রীন দল।
নির্বাচনী প্রচারণা দেখতে গিয়েছিলাম লিভারপুলসহ বিভিন্ন শহরে। কথা হয়েছিলো নানান পেশাজীবী মানুষের সাথে। তাদের অভিমত ব্রেক্সিট নিয়ে তুলকালাম না করে গণরায় সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা উচিত ছিলো। ব্রেক্সিট নিয়ে সময়ক্ষেপন করাতে ইউরোপীয় নাগরিকসহ ব্যবসায়ী শ্রেণীদের অনিশ্চয়তায় ভুগতে হচ্ছে, ক্ষুদ্ধ সাধারণ জনতাও। তাই তাদের অনেকেই জানালেন প্রথম পছন্দ বর্তমানের আলোচিত ৫ ফেরুয়ারী ভূমিষ্ট হওয়া ব্রেক্সিট পার্টি। যুক্তরাজ্যের সাধারণ জনতা মানবতাবাদী গোত্রের। শ্রেণী বা বর্ণ বিদ্বেষ তাদের বিরক্ত করে, সমঅধিকার নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক সুনাম আছে। নাইজেল ফারাজের ওপর যে বানানা মিল্কশেক ছোঁড়া হয়েছে তাতে দেশের সমঅধিকার ভাবমূর্তী ক্ষন্ন হয়েছে, আর বিরক্ত হয়েছে সাধারণ ভোটারা। তাইতো ভোটের মাঠে নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট দল একেবারে কিস্তিমাত করে দিয়েছে।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৭৩টি আসনের বারোটি এলাকার জাতীয় ফলাফল অনুযায়ী ব্রেক্সিট পার্টি ৩১.৬ শতাংশ ভোট নিয়ে ২৯টি আসন, লিবডেম ২০.৩ শতাংশ ভোট নিয়ে ১৬টি আসন, লেবার ১৪.১ শতাংশ ভোট নিয়ে ১০টি আসন, গ্রিণ ১২.১ শতাংশ ভোট নিয়ে ৭টি আসন, কনজারভেটিভ ৯.১ শতাংশ ভোট নিয়ে মাত্র ৪টি আসন এবং এসএনপি ৩.৬ শতাংশ ভোট নিয়ে ৩টি আসন, এছাড়াও অন্যান্যরা ৪টি আসনে জয়লাভ করেছে । চেঞ্জ ইউকে ৩.৪ শতাংশ এবং ইউকেআইপি ৩.৩ শতাংশ ভোট পেলেও কোনও আসন পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমি নর্থ ওয়েস্ট এরিয়ার গ্রেটার ম্যানচেষ্টারের ম্যানচেষ্টারের বাসিন্দা। নর্থ ওয়েষ্টের ভোটের কথা তো কিছু বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে সাবেক বিএনপি দলের সদস্য ও বর্তমান সতন্ত্র প্রার্থী টমি রবিনসন এর কথা। মানবাতাবাদী সংগঠণগুলো ও সম্যের গান যারা গান তারা প্রায় সকলেই উঠেপড়ে লেগেছিলো টমিকে রুখে দিতে। সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন টমি যেন এমইপি না হতে পারেন। টমির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদের গুরুতর অভিযোগ এবং টমি চরম ডানপন্থি। টমিকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সরব ছিলো বিভিন্ন সংগঠন।
ষ্ট্যান্ড আপ টু রেইসিজম ম্যানচেষ্টার সংগঠনটির টমি বিরোধী প্রচারণা দেখতে গিয়েছিলাম ওল্ড ট্রাফড ম্যানচেষ্টার ফুটবল ক্লাবের সামনে । রুসম ওয়ার্ডের ম্যানচেষ্টার সিটি কাউন্সিলের লেবার কাউন্সিলর রব নেওয়াজ ফুটবল ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকদের কাছে আর্জি করছিলেন যাকে খুশি ভোট দিন কিন্তু সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তি চরম ডানপন্থি টমিকে ভোট দেবেন
না । ওখানে অন্য দলের যে বা যারাই ছিলো তারা ব্যস্ত সময় পার করেছে টমি রবিনসনকে ভোট না দেওয়ার অনুরোধে।
ম্যানচেষ্টারস্থ ভারমিলিয়ন হলে সী মার্ক ও ইবকো চেয়ারম্যান ডক্টর ইকবাল আহমেদ ওবিইর ইফতার ও দোয়া মাহফিলে বক্তৃতাকালে শ্যাডো ইমিগ্রেশন মিনিষ্টার আফজাল খান লেবার এমপি ও কনজারভেটিভ এমইপি সাজ্জাদ করিম উভয়ই তাদের বক্তৃতায় তাদের দলের পক্ষে ভোট না চেয়ে টমি রবিনসনকে ভোট না দেওয়ার অনুরোধ করেন।
এতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে, নর্থ ওয়েষ্টে লেবার বা কনজারভেটিভ দলের নিজ নিজ দলের পক্ষে ভোট চাওয়ার বদলে টমি রবিনসনকে ভোট না দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টমিকে ৩৮,৯০৮ ভোটে ধামিয়ে দিতে পারলেও থামাতে পারেনি বেক্সিট দলের ঝড়কে । নর্থ ওয়েষ্ট এলাকায় ব্রেক্সিট দল ৫,৪১,৮৪৩ ভোট নিয়ে ৩টি, লেবার ৩,৮০,১৯৩ ভোটে ২জন, লিবারেল ডেমোক্রেট ২,৯৭,৫০৭ ভোটে লেবার সমান ২জন ও ২,১৬,৫৮১ ভোট পেয়ে এবং গ্রীণ দলের ১ জন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে।
নর্থ ওয়েষ্টে কনজারভেটিভ, ইউকেআইপি, চেইঞ্জ ইউকে ও সতন্ত্র প্রার্থীরা শুন্য হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে। পুন:নির্বাচিত হতে পারেন দুই এশিয়ান বংশদ্ভুত সাবেক এমইপি, ব্রেক্সিট পার্টির দাবানলে কপাল পুড়েছে লেবার দলের ওয়াজেদ খান ও কনজারভেটিভ দলের সাজ্জাদ করিমের।
এবারের ইউরোপীয় নির্বাচনে অন্যতম আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিলো ব্রেক্সিট পক্ষে ভোট অথবা ব্রেক্সিট বিপক্ষ ভোট দেয়া।
জাতীয়ভাবে প্রো হার্ড ব্রেক্সিটের পক্ষে দলগুলো হলো ব্রেক্সিট দল ও ইউকেআইপি দল যারা সর্বোসাকুল্লে ৩৩.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে আর ব্রেক্সিট এর বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়া দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক দল, গ্রীণ দল, চেইঞ্জ ইউকে, এসএনপিসহ পেয়েছে ৩৯.১ শতাংশ ভোট । অন্যদিকে গণতান্ত্রীক রায়কে মেনে নিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রেক্সিট এর পক্ষে অবস্থান নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দুই দল কনজারভেটিভ ও লেবার দল মিলে পেয়েছে মাত্র ২২.৫ শতাংশ ভোট। গত চল্লিশ বছরের হিসাব অনুযায়ী এবার ইউরোপীয় নির্বাচনে মোট ভোটার অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৭.৭ শতাংশ ভোট ব্যালট বক্সে জমা পড়েছে। সেই অর্থে বোঝা যায় যে বেশিরভাগ ব্রিটেনের জনগন এখনো ব্রেক্সিট এর পক্ষেই রয়ে গেছে । তবে আশারবাণী হলো, ইউরোপীয় অন্যান্য দেশে যেভাবে চরম ডানপন্থী মাথাছাড়া দিয়ে ওঠেছে সেক্ষেত্রে ব্রিটেনের ভোটাররা চরম ডানপন্থিদের বাতিলের কোটায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
পরিসমাপ্তিতে বলতে চাই, ব্রেক্সিট কার্যকর কবে হবে, কে দায়িত্ব পাবে ব্রেক্সিট কার্যকর করার জন্য, সমঝোতার ব্রেক্সিট বা প্রো হার্ড ব্রেক্সিট অথবা আদৌ ব্রেক্সিট হবে কিনা তা হয়তো জানা যাবে ভবিষ্যতে। উপরন্তু যুক্তরাজ্য হতে নাইজেল ফারুজসহ ব্রেক্সিট সর্মথনযুক্ত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মেম্বররাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক, পর্যেবেক্ষক, ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচন ২০১৯।