মুসলমানদের প্রতি নিউজিল্যান্ডের মানুষের ভালোবাসা বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখলো
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মার্চ ২০১৯
জুবায়ের আহমেদ :: নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ টাউনের দু’টি মসজিদে হামলার পর থেকে পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষজন এখনও ব্যথিত। ধর্ম, বর্ণ, দেশ জাতি নির্বিশেষে এমন কাপুরুষজনিত হামলার প্রতিবাদ ফেটে পড়েছেন সবাই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রতিবাদের ঝড় উঠে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। প্রার্থনারত নিরীহ মুসল্লিদের উপর একজন খ্রিস্টান উগ্রবাদীর বর্বরোচিত হামলায় অর্ধশতাধিক মুসল্লি নিহত হওয়ার ঘটনা আন্দোলিত করছে বিশ্বের কোটি কোটি প্রাণকে।
নিউজিল্যান্ডের মুসলমানদের প্রিয় শহর হচ্ছে ক্রাইস্টচার্চ টাউন। এই ক্রাইস্টচার্চ শহরেই ১৮৫০ সালে এক ভারতীয় মুসলিম পরিবারের বসতি স্থাপনের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডে মুসলমানদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিউজিল্যান্ডে মুসলমানদের তেমন শক্তিশালী কোন কমিউনিটি এখনও গড়ে উঠেনি। মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কম হচ্ছেন মুসলমান। তাই ১৫ মার্চের ভয়াবহ ধাক্কা একটি বিকাশমান কমিউনিটির জন্য কাটিয়ে উঠা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এ ভয়াল থাবা বয়ে বেড়াবে নিউজিল্যান্ডের মুসলমানেরা বহুদিন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে মসজিদ আল-নূরে হামলার পর থেকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন এর মুভমেন্ট ছিল রীতিমত অবাক করার মতো। তাঁর নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অসাধারণ। পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন তা শুধু প্রশংসনীয় নয়, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র প্রধানদের জন্যও তা অনুকরণীয়। তাঁর এমন কার্যক্রম ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। গত কয়েক দিন ধরে তিনি হিজাব পরে মুসলমানদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে চলেছেন। নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে কুরআন তেলাওয়াতসহ অন্যান্য ধর্মের বাণী দিয়ে কার্যক্রম শুরু করানো, পার্লামেন্টে সালাম দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করা, পার্লামেন্টে তাঁর চমৎকার বক্তব্য উপস্থাপন, দ্রুত সময়ের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র বহন আইন পরিবর্তন, হিজাব পরে আতঙ্কিত মুসলমানদের বুকে টেনে নেয়া, সান্তনা দেয়া, এ সকল কাজ অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অন্যের ব্যাপারে সহনশীল সর্বোপরি উদার মনের একজন মহান নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ছোট ছোট অথচ কঠিন অনেক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন মুহূর্তের মধ্যে, যে হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া, সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়া, সেখানে সবকিছু ব্যর্থ করে দিয়েছেন জাসিন্ডা তার বিচক্ষন নেতৃত্বের কারিশমায়।
একই সাথে তিনি কঠিন বার্তা দিয়েছেন উগ্রবাদি সন্ত্রাসীদেরও, যারা এরূপ জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত তাদের নিউজিল্যান্ডার এতটাই ঘৃণা করে যাদের নামও মুখে আনতে রাজি নন তাঁরা। বিশ্বের বাঘা বাঘা মিডিয়াগুলো তার এসব কাজের প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। বিশেষায়িত করা হয়েছে তাঁকে নানা বিশেষণে। বিশ্ববাসী প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডার কারিশমাটিক নেতৃত্বে ছিল মুগ্ধ।
নিউজিল্যান্ডার এমনিতে বিশ্বের কাছে একটি শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত। এবং তা যে যথার্থ তারও প্রমাণ তারা আরো একবার দিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে। আল নুর মসজিদে হামলার পর থেকে তারা যেভাবে মুসলমান কমিউনিটির সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, সংহতি প্রকাশ করছেন, যে যেভাবে পেরেছেন একটি আতংকগ্রস্ত সম্প্রদায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে অভয় দিয়েছেন, ছোট ছোট স্কুল কলেজের বাচ্চারা স্বজন হারানো মানুষদের সান্তনা দিতে এসে ব্যথিত হৃদয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছে তা যেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই’ কথারই বাস্তব রূপ।
এক সপ্তাহ আগে যে আল নুর মসজিদের হামলা নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে কালো দিন হিসেবে নাম লিখিয়েছে এর পরের শুক্রবারে এই মসজিদেরই পাশে হ্যাগলে পার্কে হাজার হাজার নিউজিল্যান্ডার জড়ো হয়েছিলেন মুসলমানদের জুমার নামাজে সংহতি প্রকাশ করতে। সৌাগান দিয়েছেন ‘আমরা এক, তোমরা আমাদের’। সমবেত নারীরা মাথায় পরেছিলেন হিজাব, জুমার নামাজ সরাসরি সম্প্রচার করেছে দেশটির টেলিভিশন ও রেডিওগুলো। যা অনলাইনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখেছেন। তা যেন মানবতারই বিজয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী সেখানেও মহানবীর (সাঃ) এর একটি হাদিস উদ্ধৃত করে ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এ মানবিক নিউজিল্যান্ডকে দেখে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের চোখ শীতল হয়েছে, নিউজিল্যান্ডবাসী দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়। যা গণতন্ত্রের সবক দেয়া, মানবতার ফেরিওয়লা অনেক বিশ্ব মোড়ল দেশের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।
সন্ত্রাসীর বুলেটের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত নিউজিল্যান্ডের মুসলমানদের প্রিয় আল নুর মসজিদ আবারো প্রস্তুত হবে তার মুসল্লিরদের জন্য, আবারো হাজী দাউদ নবীরা মানুষজনকে স্বাগত জানাবে ‘হ্যালো ব্রাদার’ বলে, আবারো ছোট ইব্রাহিম, আব্দুল্লাহি দিরিরা পিতার হাত ধরে চলে আসবে মসজিদে, আবারো হোসেন আরা পারভীন বেগমের মতো নামাজি মহিলারা অক্ষম স্বামীদের হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসবেন প্রিয় আল নুর মসজিদে- এটাই শান্তিকামী মানুষদের কামনা।
জুবায়ের আহমেদ : সাংবাদিক, চীফ রিপোর্টার, এলবি২৪টিভি।