লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব নির্বাচন কমিউনিটি সংগঠনগুলোর জন্য হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
সাদিক রহমান:
২৭ জানুয়ারি রোববার ছিলো বিলেতের বাংলা মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন। প্রেস ক্লাব যেহেতু সাংবাদিকদের সংগঠন তাই এই সংগঠনের নির্বাচন সংক্রান্ত যেকোনো সংবাদ মিডিয়ায় প্রধান্য পেয়ে থাকে। তাই প্রেস ক্লাবের নির্বাচন এলেই কমিউনিটিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। মনে হয় একটি বিশাল কিছু ঘটে যাচ্ছে। কমিউনিটির মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট মানুষের আগ্রহের শেষ থাকেনা।
আমি নিজেকে সাংবাদিক বলে দাবি করিনা। তবে টুকটাক লেখালেখির যে অভ্যাস আছে তা অস্বীকার করবো না। বাংলাদেশে থাকাকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিয়মিত লিখতাম। কিন্তু লন্ডন আসার পর এখানকার যান্ত্রিক জীবন লেখালেখি থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তবে কিছুদিন যাবত উপলব্ধি করছি, আমার এই প্রিয় মিডিয়া ক্ষেত্র আমাকে আবার কাছে ডাকছে। আবার লেখালেখির চর্চায় ফিরে আসতে মন চাইছে। মাঝে মধ্যে লিখি। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা সেই সুযোগটি করে দিয়েছে। কারণ সাপ্তাহিক দেশ নতুন লেখক সৃষ্টি কিংবা পুরনো লেখকদের খুঁজে বের করে তাঁদেরকে আবারও লেখালেখিতে উদ্ধুদ্ধ করে থাকে।
যেহেতু লেখালেখি নেশা, তাই সাংবাদিক ও লেখকদের সঙ্গে থাকতে চাই। থাকতে চাই মিডয়া হাউজগুলোর সাথে। প্রেস ক্লাব সদস্য নই। এরপরও আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম নির্বাচনে যাওয়ার। তবে যেহেতু আমি মেম্বার নই, তাই নির্বাচনী হলে গিয়েছিলাম সাধারণ সভা শেষ হওয়ার পরে। তখন ছিলো শুধু ভোটের আমেজ। আমাকে ভোটার ভেবে অনেক প্রার্থী ভোটও চেয়েছেন। কিন্তু ভোট দিতে পারিনি। আশা আছে, আগামীতে ভোট দেয়ার সুযোগ হবে।
দুপুর আড়াইটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৬টা পর্যন্ত নির্বাচনে একটানা ভোট গ্রহণ চলে। এই সময়টাই ছিলো সবচেয়ে উৎসবমুখর। এরপর শুরু হয় ভোট গননা। ইম্প্রেশন ইভেন্ট হলের প্রথমতলায় ভোট গগনা চলে পৌনে ৯টা পর্যন্ত। নিচতলায় চলে গান, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুক ইত্যাদির আসর। প্রায় তিন শতাধিক মিডিয়াকর্মী জড়ো হয়েছিলেন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এসেছিলেন কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গও। নির্বাচন নয়, যেনো এক উৎসব। দুটো প্যানেলে উনত্রিশজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও নির্বাচনী হলে তাঁদের দেখে মনে হলো যেনো সকলই একই প্যানেলের প্রার্থী। এক প্রার্থী অপর প্রার্থীকে জড়িয়ে ধরছেন। দুজনে মিলে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিচ্ছেন।
এই কমিউনিটিতে বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচন দেখেছি। নির্বাচন এলেই একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যেনো তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পড়েন। এরপর মামলা মোকদ্দমা হয়। আলাদত পর্যন্ত গড়ায়। দেখা যায় নির্বাচন করতে গিয়ে যখন মামলা হয়, আরো দুই বছর চলে যায় মামলার গ্লানি টানতে টানতে। আর কোনো কাজ হয়না।
কিন্তু লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের নির্বাচন ছিলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখানে প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। কিন্তু প্রতিহিংসা নেই। যারাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তারা নিজের স্বার্থের চেয়ে ক্লাবের স্বার্থকে বড় করে দেখেন। আর এই জন্য ১৯৯৩ সালে ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত যে ক’টি নির্বাচন হয়েছে নির্বাচনগুলো হয়েছে নির্মল আনন্দঘন। হারজিত আছে বলেই নির্বাচন। এক গ্রুপ হারবে, অন্য গ্রুপ জিতবে। এটাই নির্বাচনের নিয়ম। আর প্রেস ক্লাবের সদস্যরা এ কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচলে ফলাফল যাই হোক, ঘোষণার সাথে সাথে মেনে নিয়ে হাসিমুখে বিজয়ীদের আলিঙ্গন করে নেওয়ার যে চর্চা সেটা আমি প্রেস ক্লাবেই দেখেছি। এই জন্য বলি প্রেস ক্লাবের নির্বাচনকে একটি ভালো নির্বাচনের দৃষ্টান্ত হিসেবে অন্যরা অনুসরণ করতে পারেন।
সে যাক। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঘোষণা আছে ভোট গণনা শেষ, নির্বাচন কমিশন ফলাফলের জন্য প্রস্তুত। এর ১০মিনিট পর ইম্প্রেশন হলের প্রথমতলা থেকে নেমে এলেন তিন নির্বাচন কমিশনার ও চার পর্যবেক্ষক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বজলুর রশিদ এমবিই, কমিশনার ব্যারিস্টার আনোয়ার বাবুল মিয়া ও আজিজ চৌধুরী। আর চার পর্যবেক্ষক যথাক্রমে এমাদ-জুবায়ের-মুরাদ অ্যালায়েন্সের পক্ষে সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমদ ও সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক তাইসির মাহমুদ এবং নাহাস-আনিস-মাসুম অ্যালায়েন্সের পক্ষে সাপ্তাহিক জনমত এর নির্বাহী সম্পাদক সাঈম চৌধুরী ও সত্যবাণী অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা।
আনুষ্ঠানিভাবে ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বজলুর রশিদ এমবিই। দুটো শক্তিশালী প্যানেলের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর এমাদ-জুবায়ের-মুরাদ অ্যালায়েন্স ১৫টি পদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্টসহ ১০টি পদ পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। প্রতিদ্বন্দ্বী নাহাস-আনিছ-মাসুম অ্যালায়েন্স ট্রেজারারসহ ৫টি পদ বিজয় লাভ করে। ক্লাবের নির্বাচনী ইতিহাসে এবারই প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি দুজনই একই টিম থেকে নির্বাচিত হলেন।
গত ২৯ বছর ধরে বিলেতের বাংলা মিডিয়ায় কর্মরত মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী নির্বাচিত হলেন সভাপতি পদে। গত ১০ বছর ধরে বৃটেনের প্রথম ও একমাত্র ব্রডশীট বাংলা সংবাদপত্র সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে ছিলেন বৃটেনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এমদাদুল হক চৌধুরীর ভূমিকা ছিলো। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দেশ বিকাশ’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরে তিনি সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বাংলাদেশ মেলা।
মোহাম্মদ জুবায়ের এবার পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক পদে। ১৯৯৪ সালে সিলেটের দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা পেশার সূচনা। এরপর সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিলেটের বহুল প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক-এ। ১৯৯৬ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর পাড়ি জমান লন্ডনে। এখানে এসেও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তখনকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক ইউরোবাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চ্যানেল এস এর সাথে যুক্ত হন ২০০৬ সালে। বর্তমানে তিনি চ্যানেল এস এর চিফ রিপোর্টার। জনপ্রিয় শো ‘রিয়েলিটি উইথ মাহি’র একজন প্রডিউসার। ২০১৪ সালে ক্লাবের জন্য প্রায় ৭০ হাজার পাউন্ড সংগ্রহে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় শীর্ষ ফান্ডরাইজার। সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন মিডিয়া কোম্পানির সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। তিনি একসময় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়রের মিডিয়া অ্যাডভাইজার হিসেবেও কাজ করেছেন। গ্রামীণ জনপদের উপজীব্য নিয়ে রচিত ‘গাও গেরামে ঘুরে ঘুরে’ তাঁর একটি জনপ্রিয় বই। মোহাম্মদ জুবায়ের এর যৌথ সম্পাদনায় রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকাশনা।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ব্যারিস্টার ও সলিসিটর তারেক চৌধুরী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি পত্রিকা দৈনিক ডেইলি স্টারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন সাপ্তাহিক দুনিয়া, চিত্র বাংলা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন। অত্যন্ত সুন্দর মনের একজন মানুষ।
আরেকজনের কথা না লিখলে না হয়। তিনি আমাদের এক প্রিয় ছোট বোন পলি রহমান। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত নির্বাহী সদস্য। একজন নিবেদিতপ্রাণ মিডিয়াকর্মী। নব্বুইয়ের দশকে থিয়েটার দিয়ে মিডিয়াতে তার আগমন। ২০০৫ সালে ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে সাপ্তাহিক নতুন দিনে যোগ দেন। বর্তমানে পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনে একই পদে দায়িত্বে রয়েছেন । ২০০৭ সালে চ্যানেল এস এর লাইভ অনুষ্ঠান মিডনাইট এক্সপ্রেস উপস্থাপনা করতেন। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টে কাউন্সিলর পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
নির্বাচনে বার্মিংহাম থেকে এসেছিলেন অনেক সংবাদিক। তাঁদের সাথে যোগাযোগ ছিলো আগে থেকেই। ইউকের বিভিন্ন শহর থেকে স্কুল জীবনের অনেক বন্ধু-বান্ধব এসেছিলেন। সকলেই সাংবাদিক আর সকলের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রায় সকলেই একমত যে এবারের নির্বাচনে শুধু নেতা নির্বাচিত হননি, গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা হয়েছে।
ফলাফল ঘোষণার পর ক্লাবের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, সকলকে সাথে নিয়েই তিনি ক্লাবের কার্যক্রম এগিয়ে নেবেন। এতে তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্টের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সাহায্য প্রত্যাশা করেন। বিদায়ী প্রেসেডেন্ট সৈয়দ নাহাস পাশা বিজয়ীদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বার্তা। নতুন কমিটি প্রেস ক্লাবকে আরো গতিশীল করে সংগঠনকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই আমার বিশ্বাস। নবনির্বাচিত কমিটিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
সাদিক রহমান : স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, সাপ্তাহিক দেশ।