একটি বিশ্লেষণ: শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা কতটুকু?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ অক্টোবর ২০১৭
তাইসির মাহমুদ:
আর মাত্র একদিন বাকি। ৬ অক্টোবর শুক্রবার সকাল এগারোটায় নরওয়েতে ২০১৭ সালের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। এই নোবেল পুরষ্কার নিয়ে দেশে বিদেশে একটি মহলের মধ্যে বেশ উত্তাপ ও উচ্ছাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষকরে আওয়ামী ঘরানার মানুষ প্রচণ্ড আশাবাদী যে, এবার নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ঘোষণা করা হবে। তবে শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে চলমান প্রচারনা বিরোধী মহলের জন্য আবার বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূলত: ২৫ আগস্টের পর মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশে প্রবেশ বাধামুক্ত করার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে ফেসবুক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে লেখালেখির ঝড় ওঠে।
মোহাম্মদ হাসান জাফরী নামে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষার্থী ১ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রিন্ট সংস্করণে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার আর যেন প্রশ্নের সৃষ্টি না করে’ শিরোনামে লেখা একটি কলামে শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন “ইতোমধ্যে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মনোনীত তিনজনের একজন হতে পারায় আমাদের আশার পথ আরো পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।” গতকাল ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসে দেখলাম, শেখ হাসিনা এই বছরই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হতে যাচ্ছেন। তাছাড়া নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর পছন্দের ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন শেখ হাসিনা, নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকায় ১০ জনের মধ্যে একজন হচ্ছেন শেখ হাসিনা, নোবেলের জন্য মনোনীতদের তালিকায় শেখ হাসিনা এখন তৃতীয় অবস্থানে- ফেসবুকে এধরনের সংবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
ফেসবুক একটি শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ সার্বক্ষনিক ফেসবুকে সক্রিয় থাকেন। তাই এ ধরনের সংবাদ বিশ্বের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতুহল সৃষ্টি করে থাকে। কৌতুহলী করে তুলে আমাকেও। আসলেই কি বাংলাদেশ আরো একটি নোবেল প্রাইজ পেতে যাচ্ছে- জানতে আগ্রহ হয়। তাই একটু ঘাটাঘাটির চেষ্টা করি। নোবেল প্রাইজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ঘেটে যা পেলাম তাতে নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই প্রধানমন্ত্রী এ বছর নোবেল প্রাইজ পাবেন কিনা। তাছাড়া তিনি যে নোবেল কমিটিতে প্রাথমিক মনোনীতদের তালিকায় ১০ জনের মধ্যে একজন কিংবা তিনজনের মধ্যে একজন হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।
এখানে নোবেল পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়াটির একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরতে চাই। তাহলে সহজেই বুঝা যাবে চলতি বছর শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার সুযোগ বা সম্ভাবনা আছে কি-না। যে বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরন করে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী নির্বাচিত করা হয় তাতে সময় লাগে এক বছর। কোনো ব্যক্তিবিশেষ নিজে নিজের মনোনয়ন দাখিল করতে পারেন না। একটি সুনির্দিষ্ট ক্যাটাগরির মানুষ তাঁর পছন্দের যেকোনো ব্যক্তির জন্য মনোনয়ন দাখিল করতে পারেন। প্রতি বছরের ৩১ জানুয়ারি রাত ১২টার মধ্যে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন জমা করতে হয়। অর্থ্যাৎ এই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মনোনয়ন জমা করা। তারপর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের প্রোফাইল পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই শেষে একটি শর্ট লিস্ট বা প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে নোবেল কমিটি। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই তালিকাটি পর্যালোচনা করা হয়। অক্টোবর মাসে নোবেল কমিটি ভোটাভুটির মাধ্যমে ওই বছরের নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত করে নাম ঘোষণা করে। কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে অ্যাপিলের কোনো সুযোগ থাকেনা। এর পর ডিসেম্বরে নরওয়ের ওসলোতে নোবেল পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরষ্কার তুলে দেয়া হয়। পুরস্কারের মাধ্যে থাকে একটি নোবেল মেডেল, ডিপ্লোমা ও প্রাইজমানির ডকুমেন্ট। ৫ সদস্য বিশিষ্ট নোবেল কমিটি নোবেল প্রাইজ বিজয়ীদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এই ৫ সদস্য নিযুক্ত হয়ে থাকেন নরওইজান পার্লামেন্ট কর্তৃক। তবে মনোনয়ন ছাড়াও নোবেল কমিটি যদি কাউকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য মনে করে তাহলে তাঁরা স্বউদ্যোগে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। তবে নোবেল পুরষ্কারের বিধি অনুযায়ী সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় নোবেল কমিটির প্রথম সভায়। অর্থাৎ মার্চ মাসের মধ্যে।
এবারের নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য নোবেল কমিটির কাছে জমা পড়েছে ৩১৮টি মনোনয়ন। এর মধ্যে ২১৫টি ব্যক্তি বিশেষের নামে আর বাকি ১০৩টি সংগঠনের জন্য। নোবেল প্রাইজের নিয়ম অনুযায়ী মনোনীত ব্যক্তিদের নাম এবং মনোনয়ন সংক্রান্ত কোনো তথ্য ৫০ বছরের আগে প্রকাশ করা হয়না।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয়, ২০১৭ সালের নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিলো গত ৩১ জানুয়ারি। ওই তারিখের মধ্যে শেখ হাসিনার পক্ষে কোনো মনোনয়ন জমা করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। যদি জমা করা হয়ে থাকে, আর নোবেল কমিটি তাঁকে যোগ্য মনে করে তাহলে ৬ অক্টোবর শুক্রবার বিজয়ী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হতে পারে। যদি কেউ শেখ হাসিনার পক্ষে মনোনয়ন জমা না করে থাকেন তাহলে একমাত্র সুযোগ হচ্ছে, যদি নোবেল কমিটি তাঁকে যোগ্য মনে করে তাহলে তাঁরা স্বউদ্যোগে শেখ হাসিনার নাম শর্ট লিস্টে অন্তর্ভূক্ত করবেন। তবে সেই অন্তর্ভূক্তির সময়সীমাও গত মার্চ মাসে অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাই সেই সুযোগও দেখা যাচ্ছেনা। শেখ হাসিনার নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা ইস্যুর প্রেক্ষিতে। ৫ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার জন্য তিনি বিশ্বে আলোচনায় ওঠে এসেছেন। এর আগে তিনি আলোচনায় ছিলেন না। বরং ৫ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের কারণে বিশ্বজুড়ে সমালোচিত ছিলেন। এমতাবস্থায় নোবেল কমিটি তাঁকে কেন বিশেষ বিবেচনায় শর্ট লিস্টে অন্তর্ভূক্ত করবে? এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া যদি নোবেল পুরস্কারের নিয়ম অনুসরণ করে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তাঁর পক্ষে মনোনয়ন জমা করা হয়েও থাকে, তাহলে গত মার্চের মধ্যে যে শর্ট লিস্ট করা হয়েছে তাতে কি শেখ হাসিনার নাম অন্তর্ভূক্ত হয়েছে? হওয়ার যুক্তি কতটুকু? কারণ তখন তো রোহিঙ্গা ইস্যু ছিলো না। রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণেই তো মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে। সুতরাং এসব প্রক্রিয়া বিবেচনায় এ বছর তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। হয়তো আগামী জানুয়ারির ৩১ তারিখের মধ্যে যদি তাঁর পক্ষে মনোনয়ন দাখিল করা হয়, আর নোবেল কমিটি বর্তমান রোহিঙ্গা ইস্যু বিবেচনায় নিয়ে ২০১৮ সালের নোবেলের জন্য তাঁকে মনোনীত করে, তাহলে তিনি নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হতে পারেন। নোবেল প্রাইজের মনোনয়ন সংক্রান্ত কোনো তথ্য পরবর্তী ৫০ বছরের আগে প্রকাশ করা হয়না, তাই কারও পক্ষে জানার সুযোগ নেই যে, নোবেল কমিটি তাঁকে ১০ জনের মধ্যে একজন হিসেবে মনোনীত করেছে কিংবা তিনি ইতোমধ্যে তিনজনের মধ্যে একজন মনোনীত হয়েছেন। এধরনের প্রচারণা সম্পুর্ণ ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশ সরকার প্রথম দিকে রোহিঙ্গা প্রবেশকে স্বাগত জানায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে বহির্বিশ্বের চাপের মুখে তাদের প্রবেশ বাধামুক্ত করে দেয়। চাপের মুখে হোক, আর স্বইচ্ছে হোক নতুন ও পুরাতন সব মিলিয়ে ৯ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে বাংলাদেশে আশ্রয়ের সুযোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য একটি বৃটিশ মিডিয়া তাঁকে ইতোমধ্যে ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ বা মানবতার মা বলে অভিহিত করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে ছোট্ট একটি ভূখন্ড। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল এই দেশে ১৬ কোটি মানুষের সাথে আরো ৯ লক্ষ মানুষকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত অনেক বড় কথা। তাই বিশ্ব মিডিয়ায় শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত আলোচিত হবে, প্রশংসা পাবে-এটা স্বাভাবিক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর বর্তমান ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারলে আগামীতে হয়তো নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা তাঁকে ধরা দিতে পারে।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন।