একজন তজম্মুল আলী স্যার
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ আগস্ট ২০১৭
রহমত আলী: বিশ্বনাথের প্রায় তিন প্রজন্মের যিনি সরাসরি শিক্ষক তিনি হচ্ছেন- রামসুন্দর হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম তজম্মুল আলী। দীর্ঘ ৫০ বছরের মতো তিনি একই স্কুলে এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। গত ১১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুতে দেশের মতো বিলেতেও তার ছাত্রছাত্রী ও পরিচিত মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে।
আমার ছাত্রাবস্থা থেকে শিক্ষকতা পর্যায় পর্যন্ত তাকে বিভিন্ন কাজে বিশেষ করে এলাকার শিক্ষার উন্নয়নে যেভাবে আত্মনিয়োগ করতে দেখেছি তা সত্যিই বিরল। শিক্ষকতার সাথে সাথে তিনি বিশ^নাথের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। বিশ^নাথ কলেজ, হাজী মফিজ আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, জাগরন উচ্চ বিদ্যালয়, আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও রামসুন্দর হাইস্কুলে একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে তার ভূমিকা এলাকাবাসী অনেকদিন স্মরণ রাখবেন। রামসুন্দর হাইস্কুলে এসএসসি পরীক্ষা সেন্টার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অনন্য। তার সময়ে এ স্কুলে এসএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের মেধাতালিকায় প্রথম বিশ জনের মধ্যে পরপর কয়েকজন ছাত্র স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ কবির উদ্দিন ও এ স্কুলের প্রয়াত শিক্ষক রসরাজ বাবুর এক ছেলের নাম উল্লেখযোগ্য। বিশ্বনাথের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘বিশ^নাথ প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্ট’র স্থানীয় কমিটির উপদেষ্টা হিসাবেও তিনি যতেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। দেশে এ সংগঠনের একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণে তার পরিকল্পনা ছিল সুদূর প্রসারী।
শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়াও এলাকার সালিশ পঞ্চায়েত ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও তার যতেষ্ট প্রভাব ছিল। এমন অনেক উত্তেজনাকর বিষয় তিনি সকলের সম্মতির ভিত্তিতে সমাধান করেছেন। বিশেষ করে সে সময়ের ‘বাটার দোকান’ বলে পরিচিত দোকানে বসেই এ ধরনের অনেক বিষয় আলোচিত হতো। তার দেয়া সিদ্ধান্ত সকলেই মেনে নিতেন। জটিল বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমা হলেও তিনি তা আইনের ভিত্তিতে প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করতেন। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। অনেক দুর্নীতিবাজ ঘুষখোর আমলাকে সেখান থেকে বদলীর ব্যাপারেও তিনি পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন।
বিশ্বনাথে একসময় ভূমিজরিপ কার্যক্রম শুরু হলে এর সাথে জড়িত কর্মচারীদের ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রা এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যা ছিল বর্ণনাতীত। জনগন তাদের অত্যাচারে মারাত্মকভাবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমি তখন ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা বিশ্বনাথ’ শাখার সেক্রেটারি হিসাবে এ সংগঠনের সকলকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করি। বিশ্বনাথ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল মরহুম শফি আহমদ ছিলেন এ সংগঠনের সভাপতি। আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হলে আমিসহ আমাদের সংগঠনের আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কাজে বাঁধা দেয়ার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মামলা দায়ের করেন। আমি তখন অনেককে পাশে পাইনি, যারা প্রথম দিকে আমার সাথে ছিলেন। সেই সময়ে আমাকে যারা বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তজম্মুল আলী স্যার, সাংবাদিক ফিরোজ আলী, দলিল লেখক মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান, ব্যবসায়ি শেখ মনির মিয়া, এডভোকেট আব্দুল গফুর ও কারীকোনা গ্রামের জমির উদ্দিন। আমার নামে যখন ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয় তখন তজম্মুল আলী স্যারের ভুমিকা ছিল খুবই বলিষ্ঠ। তিনি তখন বিশ্বনাথের ওসিকে জানান দিয়েছিলেন যে যদি আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় তবে বিশ^নাথের মানুষ এর প্রতিবাদ করবে এবং মিছিল করে থানা ঘেরাও করবে। আর তখনই ওসি আমাকে গ্রেপ্তার থেকে বিরত থাকেন। সাথে সাথে সেই ওসি আমাকে গ্রেপ্তার করলে এখানে আইনশৃংখলার অবনতি হবে বলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পৌছে দেন। আমি তখন সে যাত্রায় গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা পাই।
আমি বিদেশ চলে আসার পর প্রায় সময়ই স্যারের সাথে টেলিফোনে আলাপ হতো। বিশেষ করে আমার ছেলে তখন রামসুন্দর হাইস্কুলে লেখাপড়া করতো। তার লেখাপড়ার উন্নতিসহ নানা বিষয়ে আলাপ হতো। এ সময় আমি আমার এক সময়ের সহকর্মী মহিউদ্দিন বিএসসি, নবেন্দু বাবু, মহসিন সাব, রাসু ভাই এর কুশলবার্তা জেনে নিতাম। তিনিও লন্ডনের অনেকের খবর জেনে নিতেন। বিশেষ করে এ স্কুলের সাবেক শিক্ষক মরহুম আব্দুল মন্নান সাবের কথা তিনি জিজ্ঞেস করতেন। এরপর যতবারই দেশে গিয়েছি ততবারই স্কুলে গিয়ে আমি তাঁর সাথে দেখা করেছি। এছাড়া বিশ^নাথ এডুকেশন ট্রাস্টের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। তিনি যুক্তরাজ্যে আসলেও আমি তাকে উপলক্ষ্য করে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান করতাম। বক্তৃতায় সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো। আমিও তার বিভিন্ন প্রশংসনীয় কাজের কথা তুলে ধরতাম। শেষবারের মতো তাঁর সাথে আমার দেখা হয় এ বছর (২০১৭) সালের এপ্রির মাসে।
লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট কার্গো ব্যবসায়ী মনির আহমদের একটি নতুন ব্যবসা সম্প্রসারনের উদ্দেশ্যে সিলেটে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আর সে অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হিসাবে যোগদান করেছিলেন। বিবিসিসির সাবেক প্রেসিডেন্ট শাহগীর বক্ত ফারুক সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদান করেছিলেন। আমি তখন তাকে খুবই দুর্বল অবস্থায় দেখেছিলাম। অনুষ্ঠান শুরুর আগে তার সাথে অনেক্ষণ বসেছিলাম কিন্তু তাকে কিছুটা বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। খুব একটা কথা বলতে চাইছিলেন না। শুধু বলেছিলেন এ অনুষ্ঠানে তিনি না এসে পারেন না তাই উপস্থিত হয়েছেন। আমি তখনও জানতামনা যে এটাই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা। তার মৃত্যু সংবাদটি মোবাইলে ফোনের একটি ম্যাসেজের মাধ্যমেই জানতে পারি। প্রথমে কে একজন সেটা পাঠিয়েছিল তা মনে পড়ছে না। তবে এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টেক্সট ম্যাসেজ, ওয়ার্টসআপ, ফেসুকসহ অন্যান্য মিডিয়ায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেনা জানিয়েছেন সবাই। আমিও আজকে আবার তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। সাথে সাথে একটি কবিতা লিখে তার জীবন ও কর্মের সম্যক পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
একজন তজম্মুল আলী
বাবার স্যার, ছেলের স্যার
দাদার স্যার, নাতির স্যার
স্যারের স্যার, সবার স্যার
রামসুন্দরের তজম্মুল স্যার।
পিতার নাম ছিফত আলী
মাতার নাম সায়রা বানু
গ্রামের নাম তাতীকোনা
মোহাম্মদপুর- মুল্লাবাড়ী।
জন্ম তার বিয়াল্লিশ সালে
কর্ম শুরু ষাট সালে
প্রধান শিক্ষক তেষট্টিতে
অবসরে যান দুই হাজার সাতে।
ছাত্র ছিলেন রামসুন্দরের
মেট্রিক দিলেন ছাপ্পান্নতে
বিয়ে পাশ ষাট সালে
বি এড দিলেন একাত্তরে।
জীবন ছিল সাদাসিদে
থাকতেন বেশি ক্ষমতার পাশে
মৃত্যু হলো পঁচাত্তর বয়েসে
দুই হাজার সতের সালে।