মাসলা-মাসায়েল : ড. আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুলাই ২০১৭
প্রশ্নঃ কিছু কিছু শায়খ এখন বলছেন যে ‘ঈদ মোবারক’ বলা বেদয়াত। এবং ঈদ মোবারক বললে জাহান্নামে যেতে হবে। এ ব্যাপারে আপনার সুচিন্তিত মতামত দরকার। দলীল সহকারে ব্যাখ্যা করার অনুরোধ করছি।
উত্তরঃ অনেক শুকরিয়া ভাই এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করার জন্য। আমার নিজেরও প্রশ্ন ছিলো- আসলে ঈদ মোবারক বা এই ধরণের অভিবাদন তো রাসূলুল্লাহ (সা:) বা তার সাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে আমরা পাই না। তাহলে আমরা এটা কেন করি বা করা ঠিক কি না। এটা করা বেদয়াত হবে কি না। কারণ, আমরা ভালো মনেকরে কিছু করলেই তাতে সাওয়াব হবে- এটা মনে করার কোন কারণ নেই। লোকেরা বিদয়াত করে আসলে ভালো মনে করে। বিদয়াত হলো- সাওয়াবের আশায় এমন ইবাদত করেন যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বা তাঁর সাহাবায়ে কেরাম করেন নি। এখন বুঝতে হবে ‘ঈদ মোবারক’ বলাটা ইবাদত কি-না, ইবাদত হলে কী ধরণের ইবাদত। আর ইবাদত না হলে শরীয়তে এটাকে কী বলা হবে?
এটা বুঝার জন্যে একটা উদাহরণ দিইঃ আমরা একজনের সাথে দেখা হলে প্রথমে সালাম দিই এবং বলি কেমন আছেন, ভালো আছেন, বাড়ির সবাই কেমন আছেন? ইত্যাদি আরো অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করি। এটা কি ইবাদত? এটা তো রাসূলুল্লাহ (স) করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাহলে এটা কি বিদয়াত? যদি বিদয়াত হয়, তাহলে তো সকল মুসলমানই এই বিদয়াত করছেন। ফলে, সকল মুসলমানই তো এই বিদয়াত করার কারণে জাহান্নামে চলে যাবেন। আসলে কি তাই? ব্যাপার একটু ভালো করে বুঝতে হবে। কোন আমলকে হুট করে বিদয়াত ফতোয়া দেওয়ার আগে তা আগে ভালো করে বুঝে দিতে হবে। আজকাল কিছু লোকের মধ্যে এমন প্রবণতা হয়েছে যে, যিনি যত বেশি বিদয়াত বের করতে পারবেন তিনি তত বেশি সহীহ আকীদা ও মানহাজের লোক। এবং তিনি জান্নাতের তত কাছের মানুষ। এই প্রবণতাটা খুবই সমস্যাযুক্ত। ইসলামের অনেক মৌলিক আমল আছে যেগুলো ইবাদত। যেগুলো মানুষ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর দেখানো তরীকার বাইরে করতে পারবেন না। কিন্তু কিছু আছে অভ্যাস ও সামাজিকতা। এগুলো সহীহ নিয়তে করলে সাওয়াব হবে। তবে, তা যেন হয় সুন্দর ও ভালো অর্থপূর্ণ। ঈদের সময় আমরা কীভাবে একে অপরকে অভিবাদন করব, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রাসূলুল্লাহ (সা:) ঈদের সময় অন্যদেরকে কিভাবে গ্রিটিং বা সম্ভাষণ করতেন তা আমাদের জানা নেই। বা এ বিষয়ে কোনো আদেশ বা নিষেধ আমরা পাইনি। এর অর্থ হলো ঈদের সময় গ্রিটিং করা এমন কোনো ইবাদতের মধ্যে পড়ে না, যা আমাদের করতে হবে, অথবা না করলে এমন কোন ক্ষতি হবে। এটা বিশেষ কোন ইবাদত হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বা খোলাফায়ে রাশেদা নিশ্চয় তার চর্চা বা আমল করতেন।
ফলে, ঈদের সময় অভিবাদন জানানোকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সৌজন্যবোধের মধ্যে গণ্য করতে হবে। এটা সরাসরি ইবাদত নয়, কিন্তু এটাকে আমাদের সৌজন্যতা ও আচার-ব্যবহারের মধ্যে গণ্য করলে তাতে সাওয়াব হবে। ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে ঈদ মোবারক বা এ জাতীয় সম্ভাষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ ঈদের পর সাক্ষাতে একে অপরকে ‘তাকাব্বাল্লাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে ও আপনাদের কাছ থেকে কবুল করুন), আহালাহু ল্লাহু আলাইকা (আল্লাহ এটা আপনার ওপর আবার ফিরিয়ে আনুন), বা এ জাতীয় সম্ভাষণ কিছু কিছু সাহাবা করেছেন বলে বর্ণনা এসেছে। ইমাম আহমদ এটার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন যে আমি কাউকে এসব সম্ভাষণ দিয়ে শুরু করি না, যদি কেউ করে আমি তার উত্তর দেই।
কারণ যে কোন সম্ভাষণ (তাহিয়্যাহ-গ্রীটিং) এর উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। আর সম্ভাষণ জানানো কোন আদিষ্ট সুন্নাত নয় অথবা কোন নিষিদ্ধ বিষয় নয়। ফলে, যিনি এটা করবেন তিনি একটা ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, এবং যিনি করলেন না তিনিও একটা ভালো উদাহরণ পালন করেছেন (মাজমু আল-ফাতাওয়া ২৪/২৫৩)। চিন্তাশীল আর অনেক ফকীহ ও উলামায়ে কেরাম ঈদের সম্ভাষনকে ইবাদত না বলে আ’দত (সৌজন্যতাবোধ ও সামাজিকতা) হিসাবে দেখেছেন। ফলে এটা একটা গ্রহনযোগ্য চর্চা হিসাবেই নিতে হবে। তবে দেখতে হবে এটা যেন আবশ্যকীয় ইবাদতে পরিণত না হয়। এবং এটা না করলে বা না বললে কাউকে যেন সমাজত্যাগী অসভ্য হিসাবে গণ্য না করা হয়। শায়খ সালেহ বিন উসাইমিনসহ অনেক বিজ্ঞ উলামাও এই মত প্রকাশ করেছেন। সকল মুসলমানকে বিদয়াত সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কেউ যদি জেনেশুনে বিদয়াত করে সেই আমলের কারণে সে সাওয়াব তো পাবেই না, বরং সে জাহান্নামে যাবে। আবার এই ধরণের চর্চা বিদায়াত ফতোয়া দিয়ে কোটি কোটি মুসলমানকে জাহান্নামে পাঠানোর দরকার নেই। বিদয়াত হলো এমন আমল বা ইবাদত যার কোন সূত্র শরীয়তে নাই। কিন্তু আ’দাত, লেনদেন ও সামাজিকতার ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হলো- সৌজন্যতাবোধ ও ভালো কাজ- যদি সেখানে অন্য কোন গুনাহের উপাদান না থাকে। ঈদ মোবারককে উলামায়ের কেরাম এভাবেই দেখেন। আশাকরি, এটা নিয়ে আমরা আর কোনো বাক-বিতন্ডা ও ঝগড়া না করি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবার সাওম ও অন্যান্য আমলকে কবুল করুন এবং এর মধ্যে কোন ভুল ক্রুটি হলো ক্ষমা করুন। আমিন।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ। সম্পাদক- মাসিক জায়তুন।