কেমন আছেন ফিন্সবারী পার্কে নিহত মকরম আলী ও গ্রেনফিল টাওয়ারে নিহত কমরু মিয়ার পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুলাই ২০১৭
রহমত আলী: সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন ফিন্সবারী পার্ক মসজিদের মুসল্লি মকরম আলী এবং সেন্ট্রাল লন্ডনের গ্রেন্ডফিল টাওয়ারের বাসিন্দা কমরু মিয়া ও তার পরিবারের অন্যান্যরা। আরো যারা নিহত হয়েছেন তাদের চাইতে বাঙালি কমিউনিটিতে এদের আলোচনা সঙ্গত কারণেই বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। হতভাগ্য মকরম আলী নিহত হন ফিন্সবারী পার্ক মসজিদ থেকে তারাবীর নামাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে আর কমরু মিয়া পরিবার পরিজনের অন্যান্যসহ নিহত হন টাওয়ারের অগ্নিকান্ডের ঘটনায়। কমরু মিয়ার সাথে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ মোট পাঁচজন নিহত হন। তবে এ পর্যন্ত তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম ও মেয়ে হুসনার লাশ পাওয়া গেলেও অন্যদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। কমরু মিয়ার একমাত্র জিবিত ছেলে হৃদয় বিদারক এ ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি কাটিয়ে এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেননি। চাচার পরিবারের যাবতীয় কিছু দেখাশুনা করছেন কমরু মিয়ার এক ভাতিজা। সে ভাতিজা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনিও এ ঘটনায় ভেঙ্গে পড়েছেন মানসিকভাবে। চাচাতো ভাইকে তিনি এখন সার্বক্ষনিকভাবে দেখাশুনা করছেন। তাদের দেশের বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কৈসাউড়া (একাটুনা) গ্রামে। এখানে তারা বসবাস করতেন গ্রেনফেল টাওয়ারের ১৭ তলার ১৪৪ নম্বর ফ্লাটে।
এদিকে ফিন্সব্যারী পার্ক মসজিদের নিকট গাড়ি চাপায় নিহত মকরম আলীর দেশের বাড়ি সিলেটের বিশ^নাথ উপজেলার বিশ^নাথ ইউনিয়নের সরুওয়ালা গ্রামে। তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই জাহির আলী ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। এদিন তিনি তারাবীর নামাজ শেষে নিজ ঘরে ফেরার পথে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ভ্যান চালক ৪৭ বছর বয়সী ড্যারন অজবর্ণ কর্তৃক গাড়ী চাপায় নিহত হন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, চার মেয়ে দুই জামাতাসহ সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন।
মকরম আলীর পরিবারকে সহমর্মিতা ও সমবেদনা জানিয়েছেন ধর্ম-বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সর্বস্থরের মানুষ। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রিন্স চার্লস, লেবার নেতা জেরেমী করবিন, কমিউনিটি সেক্রেটারি সাজিদ জাবিদ, লন্ডন মেয়র সাদিক খানসহ আরো অনেকে।
তাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমি ও মৌলানা রফিক আহমদ গত ৫ জুলাই সেখানে গমণ করি। এ সময় আমরা তাদের সাথে সাক্ষাতসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাই। তারপর ফিন্সবারী মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। আমাদের সাথে এ সময় সংগঠনের সদস্য আব্দুল গাফফার নসির মিয়া, আঙ্গুর আলী ও তাহের কামালী যাওয়ার কথা থাকলেও বেশী লোকের উপস্থিতিতে মকররম আলীর পরিবার বিব্রতবোধ করতে পারেন এ জন্য তারা সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। আমাদের ও যাত্রার ব্যবস্থা করেন মকররম আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মৌলানা আশরাফুল ইসলাম, আসাদুর রহমান ও শাহ ইসলাম। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।
আমরা পরিদর্শনকালে দেখতে পাই যে, পরিবারের লোকজনের মধ্যে এখনও আতংক কাঠেনি। এক অজানা আশংকায় তারা শংকিত আছেন। উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে তারা দিনাতিপাত করছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার আশ^াস দেয়া হলেও পরিবারের সবাই যেন ঘর থেকে বের হতে বা কারো সাথে কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না। অনাকাক্সিক্ষত হেইট ক্রাইমের আশংকায় রয়েছেন তারা। আমাদের সাথে কথা বলার সময় বারবার তাদের মধ্যে হতাশার চিত্র ফুটে উঠেছে। এ ঘটনাটি তাদের যেন থমকে দিয়েছে। কর্তা হিসাবে মরহুম মকররম আলীর অনুপস্থিতি যেন পরিবারটিকে একটি কান্ডারিবিহীন দিশেহারা নৌকার মত ভাসিয়ে দিয়েছে। তার দুই ছোট্ট নাতি এখনও নানাকে হন্যে হয়ে খোঁজে। তারা জানতে চায় নানা কখন ফিরে আসবেন। তাদের উত্তর দিতে গিয়ে সবাই বারবার বাকরুদ্ধ হন। পাড়া প্রতিবেশীরাও এ ঘটনায় দারুণভাবে মর্মাহত।
স্থানীয়ভাবে জানা যায় যে, মরহুম মকরম আলী ছিলেন একজন শান্ত স্বভাবের সজ্জন মানুষ। তার সারাটা জীবন কেটেছে শত্রুহীন। তিনি মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তেন ও লোকজনের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কানাডায় তার আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের জন্য বিমান টিকেট সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। এ টিকেট পরে বাতিল করা হয়।
পরিদর্শনকালে আমরা দেখতে পাই যে, ঘটনাস্থলটি প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের চলাচলের জন্য একটি ফুটপাত এবং এর সাথে রয়েছে কিছু খোলা জায়গা। ঘটনার দিন এখানে তারাবির নামাজ শেষে মুসল্লিরা সমবেত হয়ে হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়া মকরম আলীকে দেখাশুনা করছিলেন। এ সময়ই সেই ঘাতক তাদের উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যায়। জানা যায় এ সময় সে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘আমি সব মুসলমানকে হত্যা করতে চাই’। তার গাড়ির আঘাতে মকরম আলী নিহত এবং আরো কয়েকজন আহত হন। এ সময় তার গাড়ির ধাক্কায় রাস্থার পার্শের ব্যারিকেট দেয়া একটি পিলারও উপড়ে যায়। পিলারটি নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে।
এ ঘটনার পর সহমর্মিতা জানাতে অনেকে আসেন এবং নিহত ও আহতদের স্মরণে পুষ্পস্থবক অর্পণ করেন। স্থানীয়ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিভিন্ন প্লেকার্ডে ‘ইউনাইটেড এগেইনস্ট ফেসিজম, রেইসিজম এন্ড হেইটেড ক্রাইম‘ শ্লোগান লিখা ছিল। সব ধরণের বিভেদ বিভাজন পিছনে ফেলে ‘দ্যা ওয়ান লন্ডন ওয়ান কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ থাকবে বলে দৃঢ়ভাবে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এ ঘটনার পর বিভিন্ন মসজিদে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। লন্ডন মেয়র এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরণের হামলা কাপুরোষিত এবং এর একটাই উদ্দেশ্য হলো যা আমাদের বিভিক্ত করা। কিন্তু আমরা তা সফল হতে দেবো না। অন্যান্য নেতৃবৃন্দও এর নিন্দা জানিয়েছেন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, এ সমস্ত ঘটনার পর সরকারী, বেসরকারী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ তাদের সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানান ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কিন্তু বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউকে সেখানে দেখা পায়নি। এমনকি তাদের জানাযায়ও কাউকে নজরে পড়েনি। এ জন্য কমিউনিটি লোকজনের মধ্যে অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশ এ উপলক্ষে এক সভার আয়োজন করে এবং ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, উতকণ্ঠা ও হতাশা প্রকাশ করা হয়। এ সমস্ত ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এ বিষয়গুলির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিটি সংগঠনের পক্ষ থেকেও অনুরুপ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।