বেথনাল গ্রীন এণ্ড বো’তে পরিবর্তনের হাওয়া : লেবারের আসন তাই কনফিডেন্ট রুশানারা, মাসরুরের পক্ষে নীরব জনসমর্থন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মে ২০১৭
দেশ রিপোর্ট: ৮ই জুনের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আর বাকী আছে মাত্র দুই সপ্তাহ। নির্বাচনের দিন তারিখে যত ঘনিয়ে আসছে বাঙালি অধ্যুষিত বো এন্ড বেথনাল গ্রীন আসনে ভোটের হিসাব-নিকাশ পালটে যেতে শুরু হয়েছে। ১৯ মে আকস্মিক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন কনজার্ভেটিভের সাথে লড়াইয়ে লেবার পার্টিকে অনেকেই যেমন হিসেবের বাইরে রেখেছিলেন, তেমনি বেথনাল গ্রীন এন্ড বো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজমাল মাসরুরকেও কেউ তেমন আমলে নেননি। কিন্তু দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পরিস্থিতি পালটাতে শুরু হয়েছে। লেবার লিডার জেরিমি করবিনের পালে যেমন হাওয়া লেগেছে, তেমনী আজমাল মাসরুরের পক্ষেও টাওয়ার হ্যামলেটসে একটি নীরব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম প্রথম অনেকেই বলেছেন, আজমাল মাসরুর লেবার প্রার্থী রুশানারা আলীর কিছু ভোট নষ্ট করবেন। কিন্তু এখন সুর পালটাচ্ছেন। দিন দিন জনসমর্থন দেখে ভাবছেন শেষে এসে নাটকীয় কিছু ঘটে যেতে পারে। গত নির্বাচনে ২৪ হাজারেরও বেশি ভোটে বিজয়ী রুশানারা আলীকে তিনি হারিয়ে দিতে পারেন। মিডিয়ায় আজমাল মাসরুরের তেজোদীপ্ত কথা-বার্তা শুনে অনেকেই আশাবাদী যে, তিনি ফাইট দিতে পারবেন।
কেউ কেউ বলছেন, খুব কম ভোটের ব্যবধানে হারজিত হবে। কেউ বলছেন, জনগণ পরিবর্তন চায়। আজমাল মাসরুরকে দিয়েই সেই পরিবর্তন সম্ভব। সুতরাং ৮ই জুনের নির্বাচনে তিনিই হবেন টাওয়ার হ্যামলেটসের নতুন কিং। কেউ বলছেন, স্বতন্ত্র হিসেবে না দাঁড়িয়ে কোনো দলের প্রার্থী হলে ভালো হতো। কেউ বলছেন, এটি লেবারের সেইফ সীট। অবশেষে রুশানারা আলীই জিতবেন। তবে যে যাই বলুন না কেন, জেরিমি করবিনের মতোই টাওয়ার হ্যামলেটসে আজমাল মাসরুরের পালে হাওয়া লেগেছে। গদিনশীন এমপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ক্যাম্পেইনে এগিয়ে না এলেও বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে নীরবে সমর্থন করছেন।
৮ জুন তারা ব্যালটের মাধ্যমেই প্রকাশ্য হতে চান। আজমাল মাসরুর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় শুরু থেকেই জোরালো ক্যাম্পেইন অব্যাহত রেখেছেন। দিন-রাত ভোটারদের ঘরে ঘরে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু রুশানারা আলীর ক্যাম্পেইন চলছে ঢিমে-তালে। যেহেতু গত নির্বাচনে ২৪ হাজারেরও বেশি ভোটে বিজয়ী হয়েছেন তাই তিনি অতিশয় আত্মবিশ্বাসী। ফলে নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। মাঝে মধ্যে কমিউনিটির দুই-একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু গত নির্বাচনগুলোতে লেবারের নবীণ-প্রবীণ নেতাকর্মীদেরকে সঙ্গে নিয়ে যেভাবে ক্যাম্পেইন করতে দেখা গেছে এ বছর তা অনুপস্থিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আজমাল মাসরুরের বিজয়ের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁদের এ বক্তব্যে ভালো যুক্তিও রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বেথনাল গ্রীন এন্ড বো এলাকার ২০১০ সালের নির্বাচনে মূলধারার সকল বড় রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। এই এলাকায় ভোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশী কমিউনিটিকে সবচেয়ে সক্রিয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়; বাংলাদেশীরা ভোট প্রয়োগেও দারুন উৎসাহী। আরেকটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে- এই আসনে বাংলাদেশী, সোমালীসহ বিভিন্ন কমিউনিটিতে লেবার পার্টির সমর্থনই বেশি। এর ফলে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসাবে ২১ হাজার ৭৮৪ ভোট পেয়ে রুশানারা আলী জয়লাভ করেছিলেন। অপরদিকে, বাংলাদেশী কমিউনিটির ভোট বিভক্ত হয়ে পড়েছিল লেবার পার্টি, লিবডেম, রেসপেক্ট ও কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে। লিবেডমের প্রার্থী হিসাবে আজমাল মাসরুর ১০ হাজার ২১০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। অপরদিকে, রেসপেক্ট পার্টি থেকে আবজল মিয়া ৮ হাজার ৫৩২ ভোট আর কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী জাকির খান পেয়েছিলেন ৭ হাজার ৭১ ভোট।
আজমাল মাসরুর ও রাজনৈতিক বিশ্লেসকেরা বলছেন, বাঙালিদের ভোট বিভক্ত হয়ে না পড়লে ২০১০ সালে আজমাল মাসরুরের জয়লাভের বেশ সম্ভাবনা ছিল। কারণ উক্ত তিন বাঙালি প্রার্থীর ভোট এক পাল্লায় তুললে ২৫,৮১৩ হয়। রুশানারা ২১,৭৮৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। সেই হিসেবে আজমাল মাসরুর একা ২৫,৮১৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হতেন। উপরোক্ত হিসেবে এ বছর যেহেতু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে আর কোনো বাঙালি প্রার্থী নেই, তাই বাঙালি সকল ভোট রুশানারা আলী ও আজমাল মাসরুরের মধ্যেই ভাগাভাগি হবে। খায়রুল কবির নামে টাওয়ার হ্যামলেটসের একজন সচেতন বাসিন্দা বলেন, একদিকে আকস্মিক নির্বাচন, উপরন্তু রোযা থাকায় এ বছর ভোট পড়বে অনেক কম। গত দুই নির্বাচনে ভোট কাস্ট হয়েছে ৫০ হাজারের কিছু বেশি।
এবার বড়জোর ভোট পড়বে ৪৫ হাজার। এই ভোট থেকে সাদা ভোট ১০ হাজার বাদ দিলে থাকে ৩৫ হাজার। এই ৩৫ হাজার ভোটেই দুই প্রার্থীর জয় পরাজয় হবে। অর্থাৎ ১৭/১৮ হাজার ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। ২০১০ সালের নির্বাচনে আজমাল মাসরুর যেখানে কনজার্ভেটিভ ও রেসপেক্টের দুই বাঙালি প্রার্থী থাকা সত্তেও ১০ হাজারের বেশি ভোট পান তাই এ বছর একক বাঙালি প্রার্থী হিসেবে ১৭/১৮ হাজার ভোট পেয়ে যাবেন। এদিকে ২০১০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের নির্বাচনী মৌসুম পর্যন্ত থেমসের নদীতে অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। রুশানারা আলী এমপির ব্যর্থতার নদীও ভাঙ্গনের কারণে বড় হয়েছে। আর এ কথা ভালো করে জানেন বলেই আজমল মাসরুর এই সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করতে চান না। রাইটটুদেম ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইটের উদ্ধৃতি দিয়ে আজমল অভিযোগ করছেন, রুশানারা আলী জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা যোগাযোগ করতে চাইলেও তিনি তাদেরকে আমলে নিচ্ছেন না। ২০১৫-১৬ সালে ৭০ শতাংশ লোকের চিঠিপত্র কিংবা অন্যান্য খোঁজ-খবরের জবাব দেননি রুশানারা আলী।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান উল্লেখ করে আজমল মাসরুর বলছেন, তিনিই হবেন সবচেয়ে জনঘনিষ্ট এমপি। এলাকার মানুষকে সর্বোচ্চ সময় দেয়া ও তাদের সুখে-দুঃখে কাছে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আজমল। ২০১৫/১৬ সালে রুশানারা আলী লন্ডনের সকল এমপির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অংকের সরকারী অর্থ খরচ করেছেন। বরাদ্দ নিচ্ছেন উচ্চ হারে কিন্তু সেই অনুপাতে জনগণের জন্য রুশানারা আলী কাজ করছেন না বলে অভিযোগ করেছেন আজমল মাসরুর। এছাড়াও, নির্বাচনী দৌড়ের রাস্তায় নিজের খুঁড়ে রাখা গর্তে পড়েই গন্তব্যে পৌঁছাতে রুশানারা আলীর বিলম্ব হবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের প্রতি প্রকাশ্যে অবাধ্যতা প্রকাশের ফলে টাওয়ার হ্যামলেটস তথা বেথনাল গ্রীন এন্ড বো এলাকার লেবার পার্টির বিপুলসংখ্যক কর্মী, সমর্থক ও ভোটারকে রুশানারা আলী বিক্ষুব্ধ করে তুলেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাঁর এই অবাধ্যতা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের লেবার মেয়র জন বিগসের উদ্যোগে কেবিনেটে সাম্প্রতিক রদবলসহ আসন্ন কাউন্সিল নির্বাচনে কাউন্সিলার প্রার্থী বাছাই নিয়ে স্থানীয় লেবার পার্টিতে চাপা অসন্তোষ ও নানা ধরণের বিভক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলের অভ্যন্তরীণ এসব অনৈক্য রুশানারা আলীর নির্বাচনী প্রচারণায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মিডিয়া-বিমুখ হিসাবেও দীর্ঘদিন যাবত সমালোচিত হয়ে আসছেন রুশানারা আলী। নিজের পছন্দ মতো মিডিয়া বেছে তাদের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কে অংশগ্রহণের প্রস্তাবকেও মূল্যায়ন করছেন না তিনি। রুশানারা আলীর জনবিচ্ছিন্নতা, এলাকাবিমুখতাসহ নানা ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট সুযোগকে নির্বাচনী সাফল্য হিসাবে নিজের ঘরে তুলতে চান আজমল মাসরুর।