ইউরোপ যাত্রার দুঃসহ কাহিনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০১৭
মোঃ সাইদুর রহমান:
প্রিয় বাংলাদেশ। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এক অস্থির সমাজ। যেখানে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। এই তরুণ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই আবার শিক্ষিত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর অপরিকল্পিত শিক্ষানীতির কারণে এই তরুণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই এখানে বেকার। এই বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর এক সদস্য আমি। সবুজ শ্যামল প্রকৃতি, নদী-নালা, খাল-বিল আর হাওর-বাওরে ভরপুর এই মাটিতে জন্মেছি বলে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করতাম।
কিন্তু যখন কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের প্রথম ধাপে পদার্পণ করলাম, তখন থেকেই নিজের পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন, দেশ সর্বোপরি সমাজে নিজের একটি সুন্দর অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতে শিখলাম। তখন প্রিয় বাংলাদেশ আমার কাছে আর্বিভূত হলো নতুন রূপে। যেখানে কেবল নাই নাই আর নাই…। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বাস-ট্রেন, ব্যাবসা-বাণিজ্য, চাকরি সর্বত্রই হাহাকার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি আর নৈতিকতার অভাব সর্বত্র। কেবল ভিন্নমত পোষণের কারণে কিছু দল বা গোষ্ঠীর উপর অমানবিক নির্যাতন। তখন নিজেকে বড়ই দূর্ভাগা মনে হতো এই ভেবে যে আমি বাংলাদেশে জন্মেছি।
যে কারণে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কিংবা স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য আমার মতো অসংখ্য তরুণ বৈধ-অবৈধ পথে দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছে বা পালাচ্ছে। যাদের বেশিরভাগেরই মূল লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ ইউরোপ কিংবা আমেরিকা। এখানে বৈধ পথে যাওয়ার রাস্তা খুবই কম থাকার কারণে বাকিদের বেছে নিতে হচ্ছে অবৈধ পথ। তাতে কেউ সফল হচ্ছে কেউ কেউ সফলতার পথ খুঁজছেন আবার অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন অজানা-অচেনা অথৈ সমুদ্রে কিংবা পর্বতসম পাহাড়ের গভীর খাদে। কারো কারো খোঁজ মিলে বেঁচে যাওয়া সহযাত্রীর মুখে আবার কেউ বা নিখোঁজ থাকেন বছরের পর বছর। স্বজনেরা দিনের পর দিন অন্ধকারে খুঁজে ফিরেন প্রিয়জনের মুখ। উত্তাল সমুদ্র আর পর্বতসম পাহাড়ের সকল গিরিখাদ পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স পৌছানোর ভয়াবহ ও চমকপ্রদ এক কাহিনী আমার ইউরোপ যাত্রা। ইউরোপ আসতে চেষ্টায় আছেন বা রাস্তায় অবস্থানরত সকলের অবগতির জন্যই মূলত আমার এই লেখা।
দীর্ঘদিন নিজের মৌলিক আর নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের জীবন ও পরিবার নিরাপত্তাহীন হয়ে গেলে এক রকম বাধ্য হয়েই ভারত হয়ে জর্জিয়া আসার সিদ্ধান্ত নিই। সঙ্গে আমার এক বড় ভাই এহসান রশিদ রাজু। পরিচিত এক ভাইয়ের (দালাল) সাথে কথা হয়। তিনি আমাদের জর্জিয়া হয়ে বৈধ উপায়ে এক মাসের মধ্যে সেনজেনভুক্ত দেশে পাঠাবেন। সম্ভাব্য দেশ পোলেন্ড বা চেক রিপাবলিক। চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা জর্জিয়া আসি। আমাদের রিসিভ করে আনান নামের একজন। যে আমাদের সেনজেন ভিসার সকল কাজ করবে। রিসিভের পর থেকেই আনান বিভিন্ন কাজের (রিসিভ করা, গাড়ি ভাড়া, সিম কিনা, হোটেল, বাসা খোঁজা, বাস কার্ড, ভিসা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ, উকিল ধরা) জন্য এক টাকার জায়গায় দশ টাকা করে নিতে থাকে। যদিও চুক্তি অনুযায়ী সেনজেন ভিসা হওয়ার পূর্বের সকল ব্যয় তাঁদের বহন করার কথা। দেশে (দালালের সাথে) কথা হলে সে বললো আপাতত আমরা দেওয়ার জন্য, পরবর্তীতে পাঠানো হবে। আসার পর বিভিন্ন মাধ্যেমে জানতে পারলাম জর্জিয়া থেকে বৈধভাবে সেনজেন ভিসা নেওয়া অসম্ভব। তারপরও আমরা অপেক্ষা করি এবং পরামর্শ করে ঠিক করলাম অযথা টাকা খরচ না করে আমরা একজন একজন করে সেনজেন ভিসার প্রসেসিং করবো। আজকাল করে দুই মাস চলে গেলেও কোন কাজ হলো না। ইতোমধ্যে দেশ থেকে ১হাজারেরও বেশি লোক চলে আসে জর্জিয়া। সবার সাথে মোটামুটি একই রকম চুক্তি- কেউ ফ্রান্স, কেউ ইতালি, স্পেন, আবার কেউ কেউ আমাদের মতো পোলেন্ড বা চেক রি পাবলিক। কিন্তু আসার কিছু দিন পর থেকে বেশির ভাগের সাথেই দালালের যোগাযোগ নেই। এই রকম অবস্থায় সবাই দিশেহারা। এই দিকে ভিসার মেয়াদ মাত্র ১ মাস থাকার কারণে প্রায় সবাই অবৈধ। বৈধভাবে জর্জিয়া থেকে অন্য কোন দেশে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আবার অবৈধভাবে যাওয়ার কোন রাস্তা কেউ জানে না। এরই মধ্যে জর্জিয়ায় থাকা পুরাতন কিছু ভাই জর্জিয়া থেকে বাইর হওয়ার রাস্তা খুঁজতে থাকেন। বিভিন্ন দালালের সাথে কথা হয়। জর্জিয়ার পাশ¡বর্তী দেশ রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান এবং আজারবাইজান। স্বাভাবিক কারণেই সবার ১ম পছন্দ ছিলো তুরস্ক। কিন্তু অবৈধ ভাবে জর্জিয়া থেকে সরাসরি তুরস্ক ঢুকার কোন নির্ভরযোগ্য মাধ্যেম পাওয়া যাচ্ছে না। যা ছিলো তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাধ্য হয়েই সবাই অন্যদেশ হয়ে তুরস্ক ঢুকার চিন্তা করে। কেউ ইরান হয়ে আবার কেউ আজারবাইজান হয়ে। আবার কেউ ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি তুরস্ক যাওয়ার চেষ্টা। যতটুকু মনে পড়ে, সবার সাথে কথা বলে সব থেকে নির্ভরযোগ্য রাস্তাটা মনে হচ্ছিলো ইরান হয়ে তুরস্ক যাওয়া। তাই আমরা প্রথমে দুই ধাপে ছয়জন ইরান হয়ে তুরস্ক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা তিন জন পরে যাবো। প্রথমে যাবে অন্য একটা গ্রুপ। কিন্তু প্রথম গ্রুপ তাঁদের সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলো, তারা আমাদের না জানিয়েই সরাসরি জর্জিয়া থেকে তুরস্ক ঢুকার রাস্তায় রওয়ানা দিলো। তিন দিন অতিক্রম হওয়ার পরও তাঁদের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এই দিকে আমাদের দালাল তাড়াহুড়া শুরু করলেন। আরো দুই দিন পর তাঁদের সাথে যোগযোগ হয়। তারা তুরস্ক পৌঁছেছে। কিন্তু তারা এই রাস্তায় অন্য কাউকে না যাওয়ার জন্য বলে। তারা তিন দিন তিন রাত পায়ে হেঁটে তুরস্ক সীমান্তে যায়। পথিমধ্যে বরফ আর ঠান্ডায় গভীর জঙ্গলে তাঁদের রাত্রিযাপন করতে হয়। সীমান্তে তাঁরা মাফিয়াদের হাতে পড়ে। মাফিয়ারা তাঁদের উপর টাকার জন্য নির্যাতন চালায়। সেখান থেকে তুরস্ক সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষ তাঁদের উদ্ধার করে তুরস্ক বর্ডার গার্ডের নিকট প্রেরণ করেন। এই সময় তাঁরা পাঁচজনের মধ্যে সকলের অবস্থা ছিলো করুণ। পাঁচ দিন না খেয়ে, মেঘ-বৃষ্টি আর ঠান্ডায় সবাই ছিলো দুর্বল। পাহাড়ি গাছের কাঁটায় তাঁদের শরীর ছিলো ক্ষতবিক্ষত, বরফ আর ঠান্ডায় কারও হাত আবার কারও পা কাজ করছিলো না। এই অবস্থায় বর্ডার গার্ড তাঁদের খাওয়া, কাপড় ও ওষুধের ব্যবস্থা করে। আর দুই দিন জেলে রাখার পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাঁদের ইস্তাম্ভলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
তাঁদের কথা শুনে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ইরান হয়েই যাবো। পূর্বের চুক্তির কারণেই আমাদের তিনজনের পাসপোর্টে ইতোমধ্যে আজারবাইজানের বাকু থেকে ইরানের ভিসা নেওয়া হয়েছে। ভিসা অরিজিনাল হলেও ভিসা নেওয়ার মাধ্যম ছিলো অবৈধ। কারণ আমরা ছয় জনের কেউই বাকু না গিয়ে ভিসা নিয়েছিলাম। একদিকে জর্জিয়ার ভিসার মেয়াদ নেই, আবার আমরা ফ্লাই করার পর যদি ইরান ইমিগ্রেশন আমাদের আটক করে অবৈধভাবে ভিসা নেওয়ার জন্য, তাহলে আমাদের দেশে ফেরত পাঠাবে, কারণ আমাদের জর্জিয়ার ভিসার মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ। সকল ঝুঁকি নিয়েই আমরা তিনজন আল্লাহ উপর ভরসা করে রওয়ানা দিলাম। ইরান ইমিগ্রেশনের প্রায় ত্রিশ মিনিট তর্ক-বিতর্কের পর আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বের হই।
ইমিগ্রেশনে বারবার আমাদের কাছে একটি কথাই বারার জানতে চাওয়া হয়-তোমরা বাকু না গিয়ে কীভাবে বাকু থেকে ভিসা সংগ্রহ করলে, এখানে আমাদের যুক্তি ছিলো ভিসা অরিজিনাল কি-না। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা শেষ পর্যন্ত ইরানে ঢুকলাম। আমার এখনও মনে হয় ওই ৩০ মিনিটের চেয়ে লম্বা সময় আমি এখনও অতিক্রম করিনি।
পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী ইরান থেকে তুরস্ক যাওয়ার গেইমের দালালের লোক আমাদের রিসিভ করে। সেখান থেকে শুরু হয় আর এক যাত্রা। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও তিনজন। তিনজন করে দু’টি গাড়িতে করে তাঁরা আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে কয়েকবার পুলিশ আমাদের ধাওয়া দেয়। কিন্তু যারা আমাদের নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছিল তাঁরা এতই এক্সপার্ট ছিলো যে, তাঁদের ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভের সকল স্মৃতি আজও যখন মনে পড়ে তখন গায়ের লোম সোজা হয়ে যায়। আমরা ৮ঘন্টার মতো জার্নি করে সিমান্তবর্তী একটি শহরে যাই। তাঁদের বিপজ্জনক গাড়ি চালানোর কারণে ৮ ঘন্টা জার্নির ১ সেকেন্ডও আমাদের কারও চোখে সামান্য ঘুম আসেনি। সর্বশেষ সীমান্তবর্তী শহর থেকে যখন আমাদের কোন এক গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন প্রায় ৪ কিলোমিটার রাস্তা তাঁরা অন্ধকারে লাইট নিভিয়ে গাড়ি চালায়, আর এই অবস্থায় গাড়ির গতি ছিলো অকল্পনীয়। রাত ১১টার দিকে আমাদের একটা ঘরে ঢুকানো হয়। আজকের রাত এখানে থাকতে হবে। আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টায় আবার যাত্রা শুরু হবে। ঘরে দেখলাম আরও ১৬ জন আছে। স্কয়ার ১৫ ফুটের মতো ঘরের মধ্যে কাপড় দিয়ে আড়াল করা বাথরুম। এটি ছিলো মূলত দুম্ভা/ভেড়ার ঘর। দুম্ভার গন্ধে ঘরে রাত্রিযাপন অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। এরই মধ্যে আরও কয়েক জনের আগমন। সব মিলিয়ে যতটুকু মনেপড়ে ২৫ জন। ঠান্ডা, গন্ধ… যা লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। মাটির উপর পুরনো কার্পেট দিয়ে সবাই কোনভাবে রাত পার করলাম। বাংলাদেশী ছিলাম কেবল আমরা তিনজন। পুরোদিন কিছু খাওয়া হয়নি। সকালে খুবই ক্ষুধার্ত। একজন আমাদের সবার জন্য রুটি নিয়ে আসেন। রুটি এতই শক্ত যে তা দু’হাত দিয়ে ছিঁড়াও কষ্টকর। পানি আর বিস্কিট খেয়েই সকালটা কাটাতে হলো।
(চলবে…)
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। প্যারিস, ফ্রান্স।