বিশ্বখ্যাত টাওয়ার ব্রিজ : বিশেষ মুহূর্তে কাছে থেকে দেখার অনভূতি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০১৭
নুজহাত নূর সাদিয়া:
গতিময় লন্ডনের সরগরম জনপদের চমৎকার দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম যুক্তরাজ্যের জগদ্বিখ্যাত স্থাপনা ‘টাওয়ার ব্রিজের’ পাদদেশে। আচমকা গার্ডের হুইসেলের শব্দে স্বপ্নময় ঘোরটা কেটে গেল। ব্রিজের উপর দাঁড়ানো পথচারীদের একপাশে সরে দাঁড়াতে বলছে কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী। টেমসের পানি কেটে প্রায় দ্বিতল জাহাজ আসার মৃদু অথচ সূক্ষ¦ আওয়াজ কানে এসে পৌঁছল, উফ! কী কপাল আমার। এই চমকপ্রদ ব্যাপারটি দেখার আশায় অনেকগুলো দিন অপেক্ষায় ছিলাম। উৎসুক পর্যটক আর পথচারীদের ভিড়ে আমিও একজন আগ্রহী দর্শক যে কিনা ব্রিজের বামপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ওইতো, জাহাজটি ব্রিজ পারাপারের পথটির প্রায় কাছে চলে এসেছে, কি আশ্চর্য ঘড়ঘড় শব্দে ব্রিজের মাঝখানে ফাঁক তৈরি হচ্ছে, দু’পাশের ভিক্টোরিয়ান যুগের আদলে তৈরি পিলার দু’টি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, ব্রিজের ডান ও বাম দু’পাশের দু’টি অংশ মসৃণ গতিতে উপরে উঠে গেল। আর গুনে গুনে মাত্র পাঁচটি মিনিট, অনেকগুলো বিস্ফোরিত চোখের সামনে জাহাজটি ভোঁজবাজির মতো ব্রিজ পারাপারের অবন্ধুর পথটি বিনা-বাধায় পার হয়ে গেল!
ঠিক সে মূহূর্তে আমার চোখের সামনে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মত ঝিলিক দিয়ে উঠল কিশোরী বয়সে টিভি পর্দায় দেখা, গুপ্তধনের আশায় কাঠুরে আলীবাবার পাথুরে গুহাটিতে সাহসিকতার সাথে ঢুকে পড়ার দৃশ্যটি। টাওয়ার ব্রিজ, গ্রেট ব্রিটেনের পর্যটক আকর্ষণের আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর এক অনুপম নিদর্শন। এ মনোরম সেতুটি স্থাপনার ইতিহাসটি বেশ পুরনো প্রায় ১২০ বছর আগের কথা। ঐতিহ্যময় লন্ডন শহরটিকে আধুনিক লন্ডনে পরিণত করার তাগিদে ১৮৯৪ সালের ৩০ জুন তৎকালীন প্রিন্স অব নওয়েলস এবং ভবিষ্যতের রাজা এডওর্য়াড সপ্তম এ ব্রিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। একটু দূরে অবস্থিত ‘টাওয়ার অব লন্ডনের’ আদলে নামাঙ্কিত হয় এ মনোরম সেতুটির। সাধারণ পথচারীরা অনেক সময় লন্ডন ব্রিজের সাথে একে গুলিয়ে ফেললেও আপন স্বকীয়তায় এ স্থাপনাটি তার নিজস্বতা ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। যুক্তরাজ্য তথা পুরো বিশ্বের কাছে যে স্থাপনাটি ব্রিটেনবাসীকে তুলে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়, সেটির নির্মাণশৈলী নির্বাচন নিতান্ত সহজ ছিল না।
আনুমানিক ৫০খানা ডিজাইন, কোনোটি খুব সূক্ষ। কারুকার্যে ভরপুর কোনটি আবার অদক্ষ হাতের অপরিণত বুদ্ধির ফসল। নানা জল্পনা-কল্পনা আর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নগর স্থাপত্যবিদ স্যার হোরেস জোনসের নির্মিত ডিজাইনটিকে চূড়ান্ত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়, যিনি ছিলেন এ প্রকল্পটির অন্যতম বিচারক। ১৮৮৪ সালে এ যোগাযোগের মাধ্যমটির ভিত্তি রচনার শুরু। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা এ ব্রিজটিকে চাক্ষুষ দেখতে প্রত্যাশী জনতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর তাদের সুবিধার্থে সবসময় সচল থাকে ওয়েবক্যাম নামক বর্তমান প্রযুক্তির নিখাদ বিস্ময়টি। টাওয়ার ব্রিজের জ্যামিতিক পরিমাপের বিষয়গুলো ও খুব ভেবে-চিন্তে নির্ধারিত। ৮০০ ফিট লম্বা অর্থাৎ, ২৪৪ মিটার দীর্ঘ এ সেতুটির ঘড়ির আদলে তৈরি পিলার দু’টি আনুমানিক ২১৩ ফিট উঁচু অর্থাৎ, প্রায় ৬৫ মিটার উচ্চতা ঘোষণা করছে। পিলার দু’টির মধ্যবর্তী ফাঁক ২০০ ফিট বা ৬১ মিটারের মত দুরত্ব ঘোষণা করছে যা নদী পারাপারের সময় আনুমানিক ৮৬ ডিগ্রি উপরের দিকে বেঁকে যায়। এ পিলার দু’টির জাপানী সুমো পালোয়ানদের মতই সক্ষমতা! প্রতিটি পিলার ১০০০ টনের মত ভার বহনে সক্ষম। সড়ক পথের চাইতে নদী-পথের পারাপারটি বরাবরই কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ, তাইতো ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের মোটর শোভাযাত্রা ক্ষণিকের জন্য বিরতি দিয়েছিল এবং কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল টাওয়ার ব্রিজের সে কঠোর নিয়ন্ত্রিত ট্র্যাফিক ব্যবস্থাটিকে সম্মাননা জানিয়ে।
সে সময়কার দায়িত্বরত এক নিরাপত্তাকর্মীর ভাষ্য অনুসারে, আমরা অসংখ্যবার আমেরিকান অ্যাম্বেসিকে ফোন দিয়েছি সর্তকতাস্বরুপ, হয়তোবা দায়িত্বে ব্যস্ত থাকার কারণে আমাদের সাথে সঠিক সময়ে তাদের যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। টাওয়ার ব্রিজে কর্তব্যরত এক অফিসারের কাছ থেকে আমার আগ্রহী মন অনেক কিছু জেনে নিল, তবে জানার কি শেষ আছে? হঠাৎ চোখ পড়ল ব্রিজের কোনায় বাদাম খাওয়ায় মগ্ন এক মধ্যবয়সী মহিলার দিকে। নতুন দেশ নতুন মানুষ নতুন কৃষ্টি বরাবরই আমায় কাছে টানে। স্বউদ্যোগে আলাপ জুড়ে দিলাম ৪২ বছর বয়স্ক ক্রিস্টিন জ্যামাইকান ব্রিটিশ মহিলার সাথে। তিনি লন্ডনে সেটেলড। আলাপের এক ফাঁকে হঠাৎ ক্রিস্টিনের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল এক বিস্ময় জাগানিয়া তথ্য। তাঁর দাদার বাবা টাওয়ার ব্রিজ নির্মাণে অবদান রাখা এক খেটে খাওয়া শ্রমিক। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল, মনের স্মৃতি ভান্ডারে টুকে নিতে লাগলাম নানা অজানা চমকপ্রদ ব্যাপার। ক্রিস্টিনের ভাষ্য অনুসারে, পিতৃসূত্রে তিনি জ্যামাইকান। বাবার কাছ হতে ভাসা-ভাসা শোনা ভাগ্য-বদলের আশায় তাঁর পূর্বপুরুষ এসেছিল এ পশ্চিমা উন্নত বিশ্বে। গায়ের কালো রঙ আর স্বল্প-শিক্ষার ফলে, খুব ভালো কোন জায়গায় কাজ জুটাতে পারেনি তার বড় বাবা।
সৌভাগ্যবশত এ টাওয়ার ব্রিজ নির্মাণে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেওয়া তাঁর জন্য সহজ হয়ে পড়ে আকর্ষণীয় পেশীবহুল শরীরের কারণে। কাজ করতে গিয়েই একসময় পরিচয় এখানকার এক ব্রিটিশ তরুণীর সাথে, তারপর ভালবাসার বন্ধনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা ও অতঃপর বিয়ে এবং পাকাপাকিভাবেই এখানে বসতি গড়ে তোলা। বাবার কাছে আরো শুনেছি, প্রতিদিন সূর্য উঠার সাথে সাথেই আনুমানিক ৪৩২ জন শ্রমিক কাজে নেমে পড়ত আর দিন-রাত মুখ-বুঁজে খেটে চলত সূর্য অস্ত যাওয়া অবধি। অর্থনৈতিক সুখ-প্রত্যাশী এ পরিশ্রমী মানুষগুলোর ব্রিজের নির্মাণকাজের আয়ুষ্কাল ছিল দীর্ঘ ৮টি বছর (১৮৮৪-১৮৯৬ সাল অবধি)। ৩ কোটি ১০ লাখ ইট ২২ হাজার লিটার রঙ ও প্রায় ২ মিলিয়ন ধাতব পাতের মাধ্যমে সংযোগ দেওয়া এ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১১ লাখ ৮৪ হাজার পাউন্ড বর্তমান বাজার মূল্যে যা দাঁড়ায় ১১৮ মিলিয়ন ব্রিটিশ মুদ্রা। পূর্বে অবস্থিত দেশগুলোর মানুষের কাছে লোভনীয় এ পশ্চিমা সুন্দর স্থাপনাটির আদলে চিনা শহর সুজৌউতে তৈরি হয়েছে একটি ‘টাওয়ার ব্রিজ’ রেপ্লিকা- যাতে আগত অতিথিদের সাদরে খাঁটি ‘ইংলিশ টি’ সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন ৪০ হাজার লোকের পদভারে প্রকম্পিত সেতুটির উপর যানবাহন চলাচল ও মালামাল পরিবহনে নিয়মের বেড়াজাল ভাঙ্গার কিছুমাত্র উপায় নেই। ঘন্টা প্রতি ২০ মাইল বেগে গাড়ি চলাচল ও ১৮ টনের বেশি মালামাল পরিবহনে অক্ষম সেতুটির অপূর্ব সৌন্দর্য বজায় রাখার স্বার্থেই ১৯১০ সালে সেতুটির উপরের পথচারী পারাপারের পথটিকে আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছিনতাইকারী ও রাতের দেহপসারিণীদের অনাহুত আগমনকে ঠেকিয়ে দিতে। ১৯৮২ সালে এক নতুন আইন ও ভর্তুকির মাধ্যমে তা আবার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। রাত হয়ে এল এবার যে আমায় বাড়ি ফিরতে হবে। কত কি জানার কত কি দেখার আছে এ আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীতে। যুগের পর যুগ, নয় শুধ্ইু মন ভরানো যোগাযোগের মাধ্যমে সেবাপরায়নতার এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন রেখে চলেছে বিশ্বব্যাপী গ্রেটার লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ।
লেখিকা : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক