স্বাস্থ্য এবং সময়ের সদ্ব্যবহারে উদাসীনতা মানুষের জীবনে ক্ষতির বড় কারণ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
রাসুল (সাঃ) বলেছেন: “দুটি নেয়ামতের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এ দুটো হচ্ছে, “স্বাস্থ্য এবং অবসর সময়।” এই হাদীসের মূল বার্তা হলো, স্বাস্থ্য এবং সময় দুটি অমূল্য সম্পদ । যারা এ দুটোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে, তারা ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ অর্জন করতে পারে । কিন্তু আমরা সাধারণত এই দুটো নেয়ামতের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারিনা, যতক্ষণ না আমরা স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলি, আমাদের মূল্যবান সময় ফুরিয়ে যায় ।
হাদীসের উদ্বৃতি দিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম সৈয়দ আনিসুল হক । তিনি ৬ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার খুতবায় বক্তব্য উপস্থাপন করছিলেন।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে মসজিদে এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে আলাপকালে আমরা লক্ষ্য করলাম কত দ্রুত দিন, মাস, বছর কেটে যাচ্ছে, সুবহানাল্লাহ । মনে হচ্ছে এইতো সেদিন আমরা ২০২৩ সালের শীতকালীন কর্মসুচি নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম; আর এখন আবারো ২০২৪ সালের পরিকল্পনা পেরিয়ে, ২০২৫ সালের রমাদানের পরিকল্পনা নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা ও ভাবনা চলছে। সত্যিই সময় যেন পাখির ডানার মতো উড়ে যাচ্ছে । এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি হাদীস স্মরণ হলো, যেখানে তিনি বলেছেন: “কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ না সময় খুব দ্রুত চলে যাবে; তখন এক বছর মনে হবে এক মাসের মত, এক মাস এক সপ্তাহের মত, এক সপ্তাহ একদিনের মত, এক দিন এক ঘন্টার মত এবং এক ঘন্টা আগুনের শিখার মত দ্রুত কেটে যাবে।”
এই হাদীস আমাদের দেখায় যে, কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে সময়ের গতি মানুষের অনুভূতিতে খুব দ্রুত হয়ে উঠবে । বিশেষ করে মানুষ যখন উদাসীনতায় সময় পার করবে, তখন সময়ের এই গতিবেগ আরও তীব্র হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর অফুরন্ত নেয়ামত বর্ষণ করেছেন । কিন্তু সময়ের নেয়ামত তুলনাহীন । যদি কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়- এক সপ্তাহের সীমাহীন ভোগবিলাস নিতে চাও, নাকি একদিন অতিরিক্ত বেঁচে থাকতে চাও? আল্লাহর শপথ, অধিকাংশ মানুষ অতিরিক্ত একদিন বেঁচে থাকার সুযোগটাই নিতে চাইতো । কেন? কারণ সময়ই সবকিছু। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ যখন অনুশোচনাকারী লোকদের কথা উল্লেখ করেন, যারা মৃত্যুর পর এ দুনিয়াতে ফিরে আসতে চায়, তারা বলে:
“যখন এদের কারো মৃত্যু হাজির হয়, তখন সে বলে, ‘হে আমার রব! আমাকে ফিরিয়ে দাও, যাতে আমি যা ফেলে এসেছি (অর্থাৎ যা করতে পারিনি) তা পূরণ করে কিছু সৎকর্ম করতে পারি।’(সুরা মুমিনূন ৯৯-১০০)। এছাড়াও অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, যারা ফিরে আসতে চায় সামান্য দান-সদকা করার জন্য:
“আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি মৃত্যুর আগেই তা থেকে ব্যয় করো । অন্যথায় তোমাদের মধ্যে কেউ যখন মৃত্যুর দুয়ারে হাজির হবে তখন বলবে: ‘হে আমার প্রতিপালক, আরো একটু সময় বাড়িয়ে দাও, আমি সদকা করব এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হব ।’(সুরা মুনাফিকুন-১০)
ইমাম আনিসুল হক এই আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আমরা যদি এগুলোর গভীরে প্রবেশ করি, তাহলে দেখব মানুষ আসলে সময় চাইছে যাতে আরও ভালো কাজ করতে পারে । আরও দান করতে পারে, আরও ইবাদাত করতে পারে । যারা বয়স্ক বাবা-মা বা দাদা-দাদির সাথে থাকেন, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে দেখবেন অনেকেই বলছেন, “অহ! যদি সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম, আমি অমুক কাজটা করতাম।” এটি হলো সত্য অনুশোচনা।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন: “দুটি নেয়ামতের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রতারিত হয়: স্বাস্থ্য এবং অবসর সময়।”
এই হাদীসের মূল বার্তা হলো, স্বাস্থ্য ও সময় দুটি অমূল্য সম্পদ । যারা এ দুটোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে, তারা ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ অর্জন করতে পারে । কিন্তু আমরা সাধারণত এই দুটো নেয়ামতের মূল্য উপলব্ধি করতে পারিনা, যতক্ষণ না আমরা স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলি, আমাদের মূল্যবান সময় ফুরিয়ে যায় ।
প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনুল কাইয়ূম (রহঃ) বলেছেন: “সময় নষ্ট করা মৃত্যূর চেয়েও কঠিন । কারণ সময় নষ্টকারি মানুষ আল্লাহ থেকে এবং পরকালের সফলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে মৃত্যু কেবল দুনিয়া ও দুনিয়ার মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে।”
আল্লাহু আকবার! কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বারবার সময়ের বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে শপথ করেছেন। যেমন: সূর্য, চন্দ্র, দিন, ইত্যাদি । তাফসীরবিদদের মতে, আল্লাহ তা’আলা কোনো সামান্য বিষয়ে শপথ করেন না; তিনি মহৎ বিষয়েই শপথ করেন । সময়ের প্রতি আল্লাহর শপথ আমাদেরকে সময়ের গুরুত্ব ও মূল্য বুঝতে সহযোগিতা করে ।
তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাজিল করেছেন যা ‘সময়’ দ্বারা নামকরণ করা হয়েছে। সূরা আল ‘আসর । অর্থাৎ সময় । এটি খুবই ছোট্ট, অথচ অত্যন্ত তাৎপর্যপর্ণ একটি সূরা । ইমাম শাফিঈ (রহ.) বলেছেন: “যদি মানুষ এই সূরাটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করত, তবে তাদের জন্য এটাই যথেষ্ট হত।” তিনি আরও বলেছেন: “আল্লাহ তায়ালা যদি কোনো দলিল হিসেবে শুধু এই সূরাটিই নাজিল করতেন, তাহলেও মানুষকে জবাবদিহির জন্য যথেষ্ট হত।”
তিনি আরো বলেন, সাহাবীরা একত্রে মিলিত হলে একজন অন্যজনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সূরা আল-আসর পাঠ করতেন, যাতে একে অপরকে সময়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন ।
কেন তারা এটি করতেন? তারা তা করতেন একে অপরকে বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে যে, সময় কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদের নবী (সাঃ) বলেছেন: “বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে নিজেকে পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করে । আর অক্ষম সেই ব্যক্তি যে নিজ প্রবৃত্তি (চাওয়া-পাওয়া) অনুসরণ করে এবং তারপর আল্লাহর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করে (কোনো ভিত্তি ছাড়া)।”
মর্যাদাপূর্ণ জুমার দিনে সাহাবীদের সুন্নাহ অনুসরণ করে আমাদেরও উচিত সূরা আল-আসর তেলাওয়াত করা, এর মর্মার্থ নিয়ে চিন্তা করা, যাতে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকটবর্তী হতে পারি- ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তা’আলা সূরা আল-আসরে বলেন: “ওয়াল আসর । অর্থাৎ সময়ের শপথ। আরবী ভাষায় ‘আসর’ শব্দটি ‘আছারা, ইয়াছিরু’ ক্রিয়া থেকে এসেছে, যার অর্থ নিংড়ে বের করা । ফলে সময়ও মানুষকে নিংড়ে ধরে, চেপে ধরে, যতক্ষণ না সে অনুভব করে যে, সময়-সুযোগ দুটোই ফুরিয়ে আসছে । এই শপথের পর আল্লাহ তাআলা বলেন: ইন্নাল ইনসানা লাফী খুসর । নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। লোকসানের মধ্যে আছে।
সুবহানাল্লাহ! সৃষ্টিকর্তার এমন কথা শুনে আমাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হওয়া উচিত। এই ক্ষতির অর্থ কী? সব ধরণের ক্ষতি– সম্পদের ক্ষতি, স্বাস্থ্যের ক্ষতি, প্রিয়জনের ক্ষতি। আল্লাহ বলেছেন: “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষধা, সম্পদ ও প্রাণের ক্ষতি এবং ফল-ফসলের ঘাটতির মাধ্যমে।”
কিছু দিন আগে ২২ বছরের এক যুবককে আমি দেখতে গেলাম, যিনি ছিলেন একজন কুরআনে হাফিজ । তিনি একটি পার্কে হাঁটার সময় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই ইন্তেকাল করলেন (আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁকে জান্নাতে সমাসীন করেন)। এটি একটি কঠিন বাস্তবতা –’সময়’ আমাদের বয়স দেখে না, মর্যাদা দেখে না। মৃত্যু এসে গেলে আর এক মুহূর্তের অবকাশও দেয় না।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এভাবে ক্ষতির কথা জানিয়েই শেষ করেননি । মানুষের মনে যেন হতাশা না ভর করে, তাই সুরা আছরের পরবর্তী আয়াতে আমাদের জন্য পথ দেখিয়েছেন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ইল্লাল লাজিনা আ-মানু, ওয়ামিলুস সওয়ালিহাতি, ওতাওয়াসাউ ফিল হাক্কি, ওতাওয়াসাউ বিসাবরী। অর্থ্যাৎ, অব্যাহত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে কেবল তারাই, যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, পরস্পরকে সত্যবাদিতার উপদেশ দিয়েছে এবং ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।”
সুবহানাল্লাহ! এখানেই আমাদের আশার আলো। এই চারটি পদক্ষেপ সময়ের চাপে ক্ষতি থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে।
প্রথমত: ঈমান । যদি তোমার কাছে দুনিয়ার সকল সম্পদ থাকে, কিন্তু ঈমান না থাকে, তবে কিয়ামতের দিন সবকিছু মূল্যহীন হয়ে পড়েব ।
নবী (সা.) বলেছেন: (একটি কথা শুনে) “আনন্দিত হও এবং মানুষকে আনন্দ দাও। যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সত্যিকার অর্থে মনে প্রাণে বিশ্বাস করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
দ্বিতীয়ত: সৎকর্ম । ঈমান কেবল মুখের কথা নয়, কাজেও প্রকাশ পায় । পবিত্র কুরআনে দেখা যায়, ঈমানের পরে সঙ্গে সঙ্গে সৎকর্মের কথা উল্লেখ করা হয় । ঈমান বাড়ে ইবাদতের মাধ্যমে, আর কমে পাপের কাজের মাধ্যমে । তাই আমাদের কাজের মাধ্যমে ঈমানকে মজবুত করতে হবে।
তৃতীয়ত: সত্যবাদিতার উপদেশ । আমরা একা নই; আমরা একটি সম্প্রদায় । আমাদের উচিত একে অপরকে সত্যের পথে ডাকতে, সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করতে এবং অসত্য থেকে বিরত রাখতে । এটি শুধু ইমাম বা আলেমদের কাজ নয়, প্রত্যেক মুমিন-নর-নারীর দায়িত্ব।
চতুর্থত: ধৈর্যের উপদেশ । ইবাদতে ধৈর্য, হারাম থেকে বিরত থাকতে ধৈর্য এবং বিপদে ধৈর্য – এ তিন প্রকারের ধৈর্যের গুণ অর্জন করতে হবে । ফজরের নামাজে শীতের সকালে জাগা ধৈর্যের কাজ । হারাম বিষয় থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া ধৈর্যের কাজ । অসুস্থ হলে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এই ধৈর্যের মাধ্যমেই আমরা দুনিয়ার কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারি।
এই দুনিয়া কঠিন, সংক্ষিপ্ত, এবং পরকালের তুলনায় নগণ্য। নবী (সা.) বলেছেন: “দুনিয়া ও আখিরাতের তুলনা এমন, যেন কেউ সমুদ্রে আঙুল ডুবিয়ে তুলে দেখে হাতে কী লাগে! (অর্থাৎ খুবই নগণ্য)।”
আল্লাহ, তুমি আমাদের দুনিয়াকে আমাদের প্রধান লক্ষ্য বানিও না, এবং আমাদেরকে সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দাও । আমীন।