ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ নিশ্চিত করবে বিএনপি : সেমিনারে তারেক রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ নভেম্বর ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে প্রধানমন্ত্রীসহ কোনো ব্যক্তি যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেছেন, আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচার হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবেন না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীন মতামত নিশ্চিত করতে চাই। আমরা মানবাধিকার, মানবাধিকারকর্মী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাই।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করবে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। গুলশানের লেকশোর হোটেল মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে প্রথমে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের পটভূমি তুলে ধরেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ। এর পর পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল এবং ড. মাহাদী আমিন। সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, নরওয়ে, পাকিস্তানসহ ৩৮ দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, ৩১ দফার প্রতিটি ধারার পক্ষে এবং বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। এজন্য প্রত্যেক দফাকেন্দ্রিক তর্ক জারি রাখা দরকার।
বর্তমানে দেশে আলোচিত প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই বিএনপির ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, আমি সংস্কারের উদ্দেশ্য বলতে সেটিই বুঝি, যার মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্য শুধু নয়, বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ একজন মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা হবে, তাঁর ও পরিবারের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা ও সঞ্চয় নিশ্চিত হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, এই অগ্রযাত্রার গতি হতে হবে দ্রুত। তবে স্থির। লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট। জাতীয় ঐতিহ্য ও অতীতের ভালো অর্জনগুলো ধারণ করে আমাদের চেতনা এবং দায়বদ্ধতাকে হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী। গতানুগতিক ধারার রাষ্ট্র পরিচালনায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের উৎসাহ দিতে হবে আধুনিকতাকে, বরণ করে নিতে হবে অভিনবত্বকে। সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আলিঙ্গন করে নিতে হবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের চিন্তাধারাকে, যা পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেও।
গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা যেখানে ইউটিউব, ফেসবুক এবং তাদের অনলাইন প্লাটফর্মে নিজের ভাবনা প্রকাশের কারণে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে কাউকে যেন হেনস্তা করা না হয়। মিথ্যা তথ্য প্রচার করতেও সরকার কাউকে চাপ দেবে না। তবে দেশ গঠনের দায়িত্ব সবার। আমরা মিডিয়ার নিরপেক্ষ অবস্থান প্রত্যাশা করি।’
গত ১৬ বছরে গুম ও খুনের মাধ্যমের দেশে ভয়ের যে সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে, তা বিএনপি নির্মূল করবে বলেও অঙ্গীকার করেন তারেক রহমান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায়, যাতে কেউ পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন। আইন-বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী-গুনীদের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষ বা বাই ক্যামেরাল পার্লামেন্ট সিস্টেম প্রবর্তন করতে চাই।
তিনি বলেন, তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যোগ্যতা অনুযায়ী বেকার ভাতা প্রবর্তন করা হবে। সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ, তৃণমূলের ক্ষমতায়ন এবং ঐতিহাসিক খাল কাটা কর্মসূচি ফের বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, শিক্ষা, জ্বালানি খাতে আমূল পরিবর্তন করে দক্ষ জনশক্তি, রপ্তানিমুখী শিল্প সম্প্রসারণ এবং জাতীয় রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দলের পরিকল্পনাও তুলে ধরেন তিনি।
সংস্কার প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, সব আলোচিত সংস্কার প্রস্তাবই ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি, যা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি নারী-পুরুষের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করবে, নারীদের সম্মান-স্বাধীনতা-ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে, সব মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন করবে, মানুষকে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দেবে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখবে। আমি সংস্কার বলতে বুঝি কৃষক-শ্রমিকসহ সব কর্মজীবী-মেহনতি মানুষের ন্যায্য ও প্রাপ্য নিশ্চিত করা।
বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে প্রণীত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক-বৈষম্যহীন-সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই দফা নির্ধারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা সচিবালয়, ন্যায়পাল নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে দেখা যায়, গণঅভ্যুত্থানকালে দেড় হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে হত্যা করার পরও আওয়ামী লীগের কোনো নেতার অনুতাপ, অনুশোচনা বা আত্মসমালোচনার নজির নেই। অন্যদিকে বিএনপির মতো এত বিশাল সংগঠনের নাম ব্যবহার করে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে কোনো অপরাধে জড়িত হলেও তা জানামাত্রই আমরা দ্রুত সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছি। ৫ আগস্টের পরে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে না জড়িয়ে বিএনপি সহিংসতাকে প্রতিহত করেছে এবং সহাবস্থান নিশ্চিত করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ এখন পলাতক। যারা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তাদের ভেতরেও আমি বিভেদ লক্ষ্য করছি। আমরা দেশের মঙ্গলের জন্য এই সংঘাত এবং দ্বন্দ্বের ওপরে কেন উঠতে পারছি না?
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংস্কারের শুরুও নেই এবং শেষও নেই। সব সময় সংস্কার চলবে। আর নতুন বাংলাদেশ চাইলে দেশে গণতন্ত্র লাগবে, সে জন্য ভোট লাগবে। এমন ভোট, যেটা সবাই গ্রহণ করবে। এ জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এই দফাগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই একটা জাতীয় ঐক্য এবং মানুষের সমর্থন লক্ষ্য করেছি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি ৩১ দফা দিয়েছে, জামায়াত ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে এবং অন্য দলগুলোও দিয়েছে। এসব বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিএনপি যাতে ৩১ দফাতেই না আটকে যায়। প্রয়োজনে যাতে আমরা আরও কিছু সম্পৃক্ত করতে পারি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং দলের নেতা শামা ওবায়েদ ও ফারজানা শারমিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সেমিনারে জামায়াতের হামিদুর রহমান আজাদ, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বিকল্পধারা বাংলাদেশের নুরুল আমিন বেপারি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জহির উদ্দিন স্বপন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, আবদুস সালাম আজাদসহ কেন্দ্রীয়, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল আমিন, অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিমসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী ও চিকিসক, আইনজীবী ও সাংবাদিক নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।