লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের শোকসভা : শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় বিবিসিখ্যাত প্রয়াত পাঁচ সাংবাদিককে স্মরণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০২৪
লন্ডন, ২৩ অক্টোবর ২০২৪ : লন্ডনে সহকর্মীদের আবেগঘন স্মৃতিচারণের মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হলো বিবিসির প্রয়াত পাঁচ বৃটিশ-বাংলাদেশী সাংবাদিককে। গত ১৮ অক্টোবর শুক্রবার সন্ধ্যায় লন্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাব কার্যালয়ে আয়োজিত শোকসভায় এই গুণী সাংবাদিকদের স্মরণ করা হয় । এঁরা হলেন ঊর্মি রহমান, গোলাম কাদের, কাদের মাহমুদ, গোলাম মুর্শিদ ও শাহীন জামান । প্রত্যেকেই ছিলেন বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক, দীর্ঘদিন বিবিসির বাংলা বিভাগে কাজ করে সুনাম অর্জন করেন তাঁরা । একইসঙ্গে লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত ও নতুন দিনের প্রকাশনায়ও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সহকর্মীদের স্মৃতিকথায় উঠে আসে বিলেতে সাংবাদিকতা, বাংলা ভাষার চর্চা-বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার কথা । তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছিলেন মহীরুহসম। সাংবাদিকরা মনে করেন এসব কীর্তিমান তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিলেতে বাংলাদেশী সমাজ ও সাংস্কৃতিকে অনেক দূর নিয়ে গেছেন । তাদের হারানোর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশী কমিনিটির যে ক্ষতি এবং শূন্যতার সৃষ্ঠি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার কথা নয় । এই পাঁচজন স্বনামধন্য সাংবাদিক সম্প্রতি অল্প সময়ের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করেন।
শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ জুবায়ের । সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রয়াত সাংবাদিকদের কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মহিব চৌধুরী, দৈনিক প্রথম আলোর সাবেক পরামর্শক সম্পাদক কামাল আহমেদ, সাপ্তাহিক জনমত এর সাবেক নির্বাহী সম্পাদক দানেস আহমেদ, অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক নতুন দিন-এর সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি খুররম মতিন, প্রেস ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট নবাব উদ্দিন, চ্যানেল এস এর সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার ডাঃ জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মিলন, সাপ্তাহিক সুরমা সম্পাদক শামসুল আলম লিটন, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক চৌধুরী ও সাংবাদিক আব্দুল মুনিন জাহেদী ক্যারল প্রমুখ।
তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে প্রয়াত পাঁচ সাংবাদিকের কর্মনিষ্ঠা, বন্ধুত্ব, সহকর্মীদের প্রতি গভীর আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ এবং বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের মমতার কথা। এ সময় ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
সভায় কবিতা পাঠ করেন সাংবাদিক ঊর্মি মাযহার ও কবি সারওয়ার-ই আলম ।
বিবিসি বাংলার সাবেক সাংবাদিক কামাল আহমেদ বলেন, মূলত পাঁচজন নয়, সৈয়দ আফসার উদ্দিনসহ বিবিসি বাংলার ছয়জন প্রয়াত সাংবাদিকের মধ্যে একটি বিষয়ে অভিন্ন মিল ছিল, আর তা হলো—ব্রিটেনে বাংলা ভাষা, শিল্পকলা-সাহিত্য চর্চা ও প্রসারে তাঁরা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন । শুধু সাংবাদিকতাই নয়, এর বাইরেও তাঁদের কিছু না কিছু অবদান আছে। উর্মি রহমান ব্রিটেনে বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য এখানে তিনি অনেক ভূমিকা রেখেছেন। গোলাম মুরশিদ বাংলা বই যেমন লিখেছেন, তাঁর সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রসার-সাহিত্য এবং ইতিহাস নিয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন । তিনি ছিলেন শিক্ষক ।শাহীন জামান শিল্পচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ।সাংবাদিকতা ছাড়াও নাটক, সঙ্গীত আয়োজনে তাঁর ভূমিকা ছিলো উল্লেখ্য করার মতো । কাদের মাহমুদ লেখক হিসাবে শুধু ব্রিটেনে নয়, বাংলাদেশে ভূমিকা রেখেছেন ।এঁদের সবার ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। গোলাম কাদের ব্রিটেন বাংলা পাড়ায় এবং ব্রিটেনের বাইরে কম্পিউটারে বাংলা ফন্ট ব্যবহারের প্রচলন শুরু করতে ভূমিকা রেখেছেন।
সাপ্তাহিক জনমতের সাবেক সম্পাদক নবাব উদ্দিন বলেন, গত এক বছরে আমরা ছয় জন গুনি সাংবাদিককে হারিয়েছি, এটা সত্যি আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি ।তিনি বলেন, গোলাম কাদেরের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক ছিলো, শেষ দেখা হয় বাংলাদেশ বিমানে ।সাংবাদিক গোলাম মুরশিদ বাংলা ভাষার পন্ডিত ছিলেন । মালবারি স্কুলের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন, মারবারি স্কুলে থাকাকালীন এ লেভেল এবং জিসিএসই শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি মালবারি গুচ্ছ প্রকাশ করেন যা বাংলা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সাপ্তাহিক জনমত মালবারি গুচ্ছ প্রকাশের দায়িত্ব পালন করে। বইগুলো বাঙালির জীবন কাহিনী নিয়ে সরল ভাষায় রচিত । একইসঙ্গে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে অভিধান রচনা করেন । রুপসী বাংলা ডিকসনারী তৈরী ও ‘কালাপানির হাতছান নামে একটি বই লেখেন যা বিতর্কের সৃষ্টি করে।
ঊর্মি রহমান সম্পর্কে নবাব উদ্দিন বলেন, তাঁর সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক ছিল ।কাদের মাহমুদ সম্পর্কে তিনি বলেন, জনমতে থাকাকালে কাদের মাহমুদ সাহিত্য পাতা চালু করে লন্ডনে বাংলা সাহিত্য চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । তিনি পঞ্চাশটির মতো বই রচনা করেন । এছাড়াও তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক ।শাহীন জামানের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিলো, তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মতো ।তার সাথে অনেক কাজ করেছি, নাটক করেছি । তাঁর মৃত্যুর পর আমি দাফন-কাপন থেকে শুরু করে চেষ্টা করেছি সধ্যমতো সবকিছু করার।
সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী গোলাম কাদের সম্পর্কে বলেন, তাঁর প্রতি বিলেতের বাংলা গণমাধ্যমকর্মীদের অনেক ঋণ রয়েছে । বাংলা কাগজগুলোতে বাংলা ফন্ট ব্যবহারের কাজটি তিনি খুব সহজ করে দেন । তিনি আমাদেরকে শিখিয়ে দেন কীভাবে সহজে বাংলা ফন্ট বিজয় ব্যবহার করা যায় ।বাংলা ফন্ট নিয়ে বিপদে পড়লে উনাকে ডাকতাম।
ঊর্মি রহমান সম্পর্কে মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ খুব নিবিড় ছিল । ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত আন্তরিক ও সদালাপী মানুষ ছিলেন তিনি। পনের বছর আগে প্রেস ক্লাবের একটি নির্বাচনে তিনি নির্বাচন কমিশনার হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন । প্রেস ক্লাবের যে ক’জন সদস্য নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে একজন ।
লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মহিব চৌধুরী বলেন, গোলাম কাদের একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন নিরপেক্ষতা এবং ভ্যালেন্স বজায় রেখে যতটা কাজ করা যায় তা তিনি করতেন।এটা হয়তো বিবিসির প্রভাব হতে পারে । তিনি অত্যন্ত অনেস্ট মানুষ ছিলেন।
লন্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ৭০/৮০ এর দশকে যারা সাংবাদিকতা করেছেন তাদের সাথে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের একটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। গত ১০/১২ বছরে একটা জেনারেশন মিডিয়াতে তৈরি হয়ে গেছে যারা ৭০/৮০ দশকের সাংবাদিকদের ততটা চিনেন না ।প্রয়াত পাঁচজন সাংবাদিকের সাথে সাপ্তাহিক জনমত ও নতুন দিনের সুত্রে গত ৩০/৪০ বছর ধরে সম্পর্ক গড়ে উঠে । আমরা এসব গুনি সাংবাদিকদের স্মরণ করছি, দোয়া করেছি আল্লাহ উনাদের মাফ করে দেন । আমরা লন্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাব অন্যান্য সিনিয়র সাংবাদিকদের সহযোগিতায় তাদের স্থায়ীভাবে স্মরনে রাখতে কিছু ভূমিকা রাখবো।
সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ বলেন উর্মি রহমান, গোলাম কাদের, কাদের মাহমুদ, গোলাম মুর্শেদ ও শাহীন জামান এই পাঁচজন সাংবাদিক স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভাবান এবং গুনি ছিলেন । তারা সাংবাদিকতার পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রচার এবং প্রচারে অন্যন্য ভূমিকা রেখেছেন, এজন্য তঁরা বাংলাদেশী কমিউনিনিতে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন।
শোকসভা শেষে প্রয়াত পাঁচ সাংবাদিকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। নৈশভোজের মাধ্যমে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।