গণহত্যায় হাসিনাসহ ৪৬ জনের নামে পরোয়ানা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ অক্টোবর ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টায় ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী’ অপরাধের দুই অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি গোলাম মুর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর এই প্রথম কোনো আদেশ এলো।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর পর থেকে তিনি সেই দেশে আছেন।
ট্রাইব্যুনালের অন্য আদেশে সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি এ বিষয়ক অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
অন্য আসামিরা হলেন– শেখ রেহানা, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, ডা. দীপু মনি, জুনাইদ আহমেদ পলক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সজীব ওয়াজেদ জয়, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক বিচারপতি এএইচ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, র্যাবের সাবেক ডিজি হারুন অর রশীদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান, পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার প্রমুখ। পরোয়ানা জারির আবেদনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমল এবং জুলাই-আগস্টে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা তুলে ধরা হয়। ঘটনার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশকে।
সদ্য পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম ও বি এম সুলতান মাহমুদ।
আদেশের পর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দেশজুড়ে বিস্তৃত মাত্রায় অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে। তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের কাছে দুটি আবেদন জানানো হয়েছিল। এই অপরাধের আসামিরা অসম্ভব প্রভাবশালী, তাদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা কঠিন। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানিয়েছিলাম। তিনি বলেন, প্রথমটিতে শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন এবং অন্যটিতে ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনাল আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। তিনি বলেন, এই আসামিদের মধ্যে অনেকে এখনও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এই কারণে তাদের সবার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
ট্রাইব্যুনালে যা বললেন চিফ প্রসিকিউটর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম কর্মদিবসের ট্রাইব্যুনালের সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের সব হত্যা, বিডিআর বিদ্রোহে ৭৪ জনকে হত্যা, মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হত্যা, র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, আয়নাঘর এবং জুলাই-আগস্টে গণহত্যাসহ আওয়ামী লীগের ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বল প্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন তিনি। পাশাপশি অভিযোগের তদন্তের স্বার্থে শেখ হাসিনাসহ পলাতক অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করে তাজুল বলেন, এ আসামির বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া মামলার তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি। এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামির অবস্থান জানেন কিনা। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর ‘না’ সূচক জবাব দেন।
আসামির বিরুদ্ধে অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, এক থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে।
প্রেক্ষাপট
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এই ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীসহ অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আরও বেশ কয়েকজনের বিচার ট্রাইব্যুনালে চলছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমনপীড়নকে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী’ অপরাধ বিবেচনা করে এ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত সোমবার নতুন তিন বিচারক নিয়োগের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও দুই সদস্য মঙ্গলবার কাজে যোগ দেন। গতকাল তারা মামলার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলেন।
গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে সারাদেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের নেতা, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ৫৬টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৫৪টি অভিযোগে প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে।
বিশ্ব গণমাধ্যমে পরোয়ানার খবর
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে।
এর মধ্যে বার্তা সংস্থা রয়টার্স তার শিরোনামে লিখেছে, ‘নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি শিরোনাম করেছে, ‘শেখ হাসিনা: সাবেক নেতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।’ বিবিসি প্রতিবেদনে লিখেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জারি করা পরোয়ানা নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি লিখেছে, হাসিনা সরকার ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার করতে এই আদালত প্রতিষ্ঠা করে। যদিও এটির বিচারকার্য নিয়ে জাতিসংঘসহ অন্যরা প্রশ্ন তুলেছিল। অভিযোগ ছিল, বিরোধীদলীয় সদস্যদের হত্যায় এই আদালত ব্যবহার করা হয়েছে।
এ ছাড়া পাকিস্তানের দ্য ডন, মধ্যপ্রাচ্যের গালফ নিউজ, খালিজ টাইমসেও হাসিনার বিরুদ্ধে জারি হওয়া পরোয়ানা নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ভারতেই অবস্থান করছেন। সম্প্রতি জানা গেছে, হাসিনাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে ভারত, যা দিয়ে তিনি চাইলে অন্য দেশে যেতে পারবেন। তিনি যদি ভারতে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে ফেরত দিতে হবে।
শেখ হাসিনাকে ফেরাতে প্রয়োজনীয় সবই করবে সরকার
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে যা যা করা দরকার, তার সবই করবে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আদালত এক মাস সময় দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁকে ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় সব কিছু করব।
শেখ হাসিনাকে কোন প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা হবে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কীভাবে আনা হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো কোর্ট বলেছে গ্রেপ্তার করতে। পরোয়ানা তো আমার কাছে আসেনি, এসেছে পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ সেটি পারবে না, কারণ তিনি দেশে নেই। যখন আমাদের কাছে আসবে, তখন দেখা যাবে।
শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে যতটুকু জানতে পেরেছি, সম্ভবত তিনি দিল্লিতেই আছেন। খবর: সমকাল