অসাম্প্রদায়িকতা ও মোদীর মায়া কান্না
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৪
আহমেদ ইকবাল চৌধুরী:: অসাম্প্রদায়িকতা বা Secularism একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পুরো দুনিয়ায় এ শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ দেখা যায়। সাম্প্রদায়িক শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক মানে আপনি যত বেশী ইসলাম বিদ্বেষী , প্রগতিশীল, তত বেশী আপনি অসাম্প্রদায়িক। Robert Worth Frank এর মতে Secularism is ‘ A variety of utilitarian social ethic which seeks human improvement without reference to a religion and exclusively by means of human reason, science and social organisation’. Robert Frank এর definition এর সাথে যে কোন বিবেকবান মানুষ একমত হবে, এবং এর চর্চা বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ইসলামেও ধর্মীয় এ সামাজিক বৈষম্যের স্থান নেই। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষপটে রাজনৈতিক মুনাফা লাভের জন্য ২০২৪ এর পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক, জঙ্গী ও অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর পায়তারা করছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ফ্যাসিবাদের শাসনে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ যখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিজমের কবর রচনা করছে, তখন কিছু নির্যাতিত বা অতি উৎসাহী মানুষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাডি্ ঘরে হামলা করে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, যদিও তা কাম্য নয়। কিন্ত এটাকে কোন ক্রমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন বা সাম্প্রদায়িক দাংগা বলা যাবে না।
সম্প্রতি ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমনকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসাবে আখ্যায়িত করে ভারতের ১৪০ মিলিয়ন মানুষ বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে মি. মোদীর এ উদ্বেগই সাম্প্রদায়িক যা একটি দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেয়ার প্রধান উপাদান এবং একটি স্বাধীন দেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। মি. মোদী বাংলাদেশে আধিপত্যবাদি ও ফ্যাসিষ্ট অবৈধ সরকার দ্বারা বিগত ১৫ বছরের মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো এবং ২০২৪ এর ছাত্র জনতার উপর শ্বৈরশাসকের Genocide বা গণহত্যার ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ না করে ভিন দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা লাগানোর মত একটি সুচতুর মন্তব্য করে শ্বৈরাচারকে পুনর্বাসনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, যা বাংলাদেশের মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে।
ভারত একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র। আর ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বর্তমান ভারতে এ উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রবর্তক বলা যায়। তিনি ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমান গণহত্যার মহানায়ক। যে দাঙ্গায় প্রায় ২০০০ মানুষ প্রাণ হারান। সুতরাং মোদীর মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বেমানান। বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে যদি মোদীর এতই আন্তরিকতা, এতই উৎকন্ঠা, তাহলে পতিত শ্বৈরাচার বিগত ১৫ বছরে হিন্দুদের বাড়ি দখল, জায়গা দখল ও মন্দিরে হামলা করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামাতকে দমন পীড়নের যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, আল্লামা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর সাক্ষী হওয়ার অপরাধে শ্বৈরাচার ও তার দোষররা সুখরঞ্জন বালিকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে তুলে নিয়ে ভারতে পুশবেক করেছিল, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে যখন রাস্তায় ফেলে শেখ হাসিনার পুলিশলীগ ও ছাত্রলীগ লাটিপেটা করছিল, নিপুন চন্দ্র রায়কে যখন রাজপথে জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলায় শ্বৈরাচারের লাটিয়াল বাহিনী তার মাথা দ্বিখন্ডিত করছিল, তখন মোদিজীর হিন্দুত্ববাদ ও ভারতের ১৪০ মিলিয়ন হিন্দুদের আবেগ কোথায় ছিল? অতএব, মোদীর বর্তমান উদ্বেগ, উৎকন্ঠা বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রতি লোক দেখানো মায়াকান্না ও পতিত শ্বৈরাচারকে পুনর্বাসিত করার ফন্দি ছাড়া কিছুই নয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হাজার বছরের। ৯০% মুসলমানের দেশে যদি আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল একজন হিন্দু হতে পারে, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিন্দু হতে পারে (যদিও বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃকুঁডে্), মন্ত্রী এমপি, সচিব সব খানেই হিন্দুদের জয় জয়কার, সে দেশে মোদীজীর প্রেসক্রিপশন নিয়ে অসাম্প্রদায়িক সাজার দরকার নেই। অপরদিকে আল্লামা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী ইলেকশনে শুধাংশ শেখর হাওলাদারকে পরাজিত করে হিন্দুদের ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যতে অসংখ্য হিন্দু ভাইয়েরা কেঁদেছে। আমার নিজের এলাকায় ইউপি সদস্য মৃত মানব চন্দ্র মুসলমানের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র জনতার গণঅভ্যূথানে শ্বৈরাচার যখন পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ১৬ বছরের নির্যাতন নিষ্পেষিত অসহায় মানুষগুলো যখন নিজেদের অধিকার ফিরে পাবার আনন্দে আত্মহারা, তখন কিছু দুষ্কৃতিকারী প্রতিপক্ষের বাডিতে হামলা চালায়, যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল না। তবে এ ধরনের হামলা, লুটতরাজ বা জ্বালাও পোড়াও কোনো বিবেকবান মানুষ সমর্থন করে না। এ ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে হাজারো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়কে ম্লান করবে। যারা এ সকল ঘটনার সাথে জড়িত, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মনে রাখা দরকার যে, ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট অন্তবর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল না, পুলিশ ছিল না। তাই দুষ্কৃতিকারীরা ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার চেষ্টা করে এবং কোনো কোনো এলাকায় নতুন সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য কিছু হিন্দু পরিবারে হামলা করে। তবে আমাদের ছাত্র সমাজ দুষ্কৃতিকারীদের রুখে দিতে সমর্থ হয়। সচরাচর হিন্দু পরিবারের বাড়ি ঘরে বা মন্দিরে হামলা হলে কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই মাদ্রাসার ছাত্রদের দোষারোপ করার যেখানে চিরাচরিত রেওয়াজ ছিল, সেখানে আমাদের মাদ্রাসার ছাত্ররা হিন্দুদের বাড়ি ঘর এবং মন্দির পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। সারাদেশের ছাত্র সমাজ জনগণের নিরাপত্তা বিধানে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও মুসলিম আমরা সবাই বাংলাদেশী, এক ও অভিন্ন। এদেশে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলতে কেউ নেই। সকলের মন থেকে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ধারণা পাল্টে দেশ গড়ার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। রানা দাশ গুপ্তদের মত কোনো রাজনৈতিক দলের বা শ্বৈরাচারে দাবার গুটি না হয়ে দেশের অন্যান নাগরিকের মত হিন্দুদেরকে ও বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র গঠনে মুসলমানদের কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সকলের জন্য বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, আর এ বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে লাখো শহীদের এবং ২০২৪ সালের হাজারো ছাত্র জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা ও গণঅভ্যুত্থান সফল বলে বিবেচিত হবে।
লেখক: ব্যাংকার, লন্ডন প্রবাসী।