হিমেলের চোখ দেখল না ‘নতুন’ বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ আগস্ট ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়ের মৌতাত এখনও চারদিকে। নতুন উদ্যমে দেশ গড়ার নানা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কেউ রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করছেন, তো কেউ দেয়ালে আঁকছেন নতুন এক স্বপ্নের বাংলাদেশের গ্রাফিতি। কেউ বা অংশ নিচ্ছেন পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে। অথচ এ আন্দোলনের অংশ হয়েও নতুন বাংলাদেশের আলো দেখা হচ্ছে না পুলিশের ছররা গুলিতে চোখ হারানো টাঙ্গাইলের স্কুলছাত্র হিমেল আহমেদের। সহপাঠীরা যখন বিজয় উৎসবে মাতোয়ারা রাজপথে, তখন চোখে অনন্ত অন্ধকার নিয়ে হিমেল কাতরাচ্ছে হাসপাতালে। প্রচণ্ড কষ্টে উথলে ওঠা কান্না চেপে হিমেল বলে, আমাদের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। গণতন্ত্রের বিজয় এসেছে। তবে আমি নিজেই এখন অন্ধকারে। শিক্ষার্থীদের সাজানো বাংলাদেশের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার স্থানীয় গোড়াই উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র হিমেলের চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শটগানের শতাধিক ছররা গুলি লেগেছে হিমেলের মাথা ও মুখমণ্ডলজুড়ে। গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত তার চোখে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে না। এখনও কয়েকটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কবে সুস্থ হবে, তা নিশ্চিত নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ৪ আগস্টের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল হিমেল। ছিল টাঙ্গাইল শহরের মূল সড়কে একটি মিছিলের নেতৃত্বে। তারা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পৌঁছালে গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই সময় মিছিলের সামনে থাকা হিমেলের মাথা ও মুখমণ্ডলে শতাধিক ছররা গুলি লাগে। সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সদর হাসপাতালে। এর পর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে হিমেলের ঠাঁই হয়েছে ঢামেক হাসপাতালে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢামেকের চক্ষু বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ১৭ নম্বর শয্যায় বসে রয়েছে দৃষ্টিহীন হিমেল। মা নাসিমা আক্তার হাসপাতাল থেকে পাওয়া কলা-রুটি খাওয়াচ্ছেন। তার মাথা ও মুখমণ্ডলভর্তি ছররা গুলির ক্ষত। একাধিক গুলির চিহ্ন দুই চোখে। চারটি দাঁত ভেঙে যাওয়ায় স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারছে না। মাঝেমধ্যে শুধু মাকে ডাকছে। কিন্তু ডাকবে যে ঠোঁটে, তাতেও লেগেছে গুলির আঘাত। দিতে হয়েছে ছয়টি সেলাই।
এ অবস্থা নিয়ে অস্ফুট স্বরে হিমেল বলে, গুলি লাগার পরপরই দুই চোখে অন্ধকার নেমে এসেছে। ডাক্তার যখন আম্মুকে বলল, আমি আর এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পারব না, তখন কষ্টটা আরও বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে কান্না করি। নিজেকে আজ খুব অসহায় মনে হয়। বুকের ভেতরটা ফেটে যায়।
হিমেলের মা নাসিমা আক্তার জানান, ছেলে মাঝে মাঝেই কাঁদতে কাঁদতে বলে, আল্লাহ, আমারে তুমি এত বড় শাস্তি কেন দিলা? আমার কাছে জানতে চায়, সে আর আগের মতো লেখাপড়া করতে পারবে কিনা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনা। কিন্তু হিমেলের এসব প্রশ্নের উত্তর নেই তাঁর কাছে।
এমন পরিস্থিতিতে বন্ধু ও চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে হিমেল বলে, গুলিবিদ্ধ অবস্থা থেকে হাসপাতালে আনা, চিকিৎসা নিশ্চিত করার সব বিষয়ে বন্ধুরা পাশে ছিল। কোনো ওষুধ বা রক্ত লাগবে– এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরাই সব ম্যানেজ করে দিয়েছে।
দেশ গঠনের নতুন প্রক্রিয়া দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপের পাশাপাশি ১০ বছর আগে বাবাকে হারানো হিমেলের দরিদ্র পরিবার নিয়েও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সে সমকালকে বলে, স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে বিদেশ যাব। সেখানে ভালো চাকরি করে সংসারের হাল ধরব। সেই স্বপ্ন আর পূর্ণ হলো না। নতুন সরকারের কাছে এখন একটাই দাবি– আমার চোখের আলো ফেরাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমার চলার মতো একটা ব্যবস্থা যাতে করে দেয় এই সরকার।
হিমেলের শয্যার পাশেই বসে ছিলেন বড় ভাই জনি মিয়া। তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল, রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতাল, সবশেষ ঢামেক হাসপাতালে ভাইয়ের চিকিৎসা চলছে। চোখের ছররা গুলি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা হয়েছে। তবে মুখ ও মাথায় বিদ্ধ হওয়া গুলি বের করা হয়নি। এভাবে কতদিন চলব, জানি না। যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তা শেষ।
তিনি আরও বলেন, টাঙ্গাইল সদরে মাসিক আট হাজার টাকা বেতনে সুতার কারখানায় কাজ করি। এই স্বল্প আয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে। পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকায় এসেছি। ছুটি শেষ হয়েছে দু’দিন আগে। বুধবার কারখানায় ফিরতে না পারলে চাকরিটাও চলে যাবে। ভাইয়ের চিকিৎসা-ওষুধ ও নিজেদের খাওয়া-দাওয়ায় এরই মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এসব টাকা সবই ধার করে নেওয়া।
হিমেলের মা নাসিমা আক্তার বলেন, শুরুতে যখন ছেলে আন্দোলনে যেত, বাধা দিতাম। বলতাম, আমরা গরিব মানুষ। আন্দোলন করলে কি আমাদের পেট চলবে? হিমেল আমার কথা শুনত না। এই যে আজ দুটি চোখ হারিয়েছে। সরকার কি আমার ছেলের চোখ ফিরিয়ে দেবে? আমার সন্তান কি এই সুন্দর পৃথিবী ফের দেখতে পারবে? যদি সম্ভব হয়, যে কোনো মূল্যে আমার সন্তানের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে সরকার ব্যবস্থা নেবে– এটাই প্রত্যাশা। খবর-সমকাল