আপনার কি ডায়বেটিস আছে- কীভাবে শরীরের যত্ন নেবেন জেনে নিন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ এপ্রিল ২০২৪
আপনি কি জানেন ডায়াবেটিসের কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়? লন্ডন নর্থ ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি হেলথকেয়ার এনএইচএস ট্রাস্টের ক্লিনিক্যাল লিড ফর অফথালমোলজির ডা. ইভলিন মেনসাহ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে আপনি চক্ষু রোগ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।‘
পরীক্ষায় সুরক্ষা পাবে আপনার চোখ
ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে চিনির মাত্রা, আমরা যাকে ব্লাড শুগার বলি সেটা বেড়ে যায়। ডা. মেনসাহ বলেন, ‘দীর্ঘদিন উচ্চ মাত্রার ব্লাড শুগার থাকলে তা রক্তের শিরা, ধমণী, অঙ্গপ্রতঙ্গ ও টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে চোখের পেছনে যে রেটিনা থাকে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের চোখের রক্তনালী আক্রান্ত হলে এর কারণে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমাদের দেখার জন্য রেটিনায় স্বাস্থ্যকর রক্ত প্রবাহ অত্যন্ত জরুরি।”
‘ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সবাই এই সমস্যার মুখোমুখি হবেন-এমন কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই। তবে এর যদি চিকিৎসা না করা হয় তাহলে দৃষ্টিশক্তি হারাতে হতে পারে। এনএইচএস থেকে বিনামূল্যে এর পরীক্ষার সুযোগের অর্থ হচ্ছে, এই সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তির সুরক্ষা বা আরো ক্ষতি হওয়ার গতিপ্রক্রিয়াকে শ্লথ করা সম্ভব।”
ডায়াবেটিসর লক্ষণ ও উপসর্গ কী আপনি কি তা জানেন?
‘আমার ধারণা ছিল, আমার নতুন চশমা নিতে হবে’- সারে এলাকার বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী বার্নাডেট ওয়ারেন ২০১৬ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে নাম রেজিস্ট্রি করেন । এর ২০ বছর আগে তার টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস ধরা পড়ে । বার্নাডেট বলছিলেন, ‘ডায়াবেটিসে চোখ পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কারণ এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, আপনি বুঝতেও পারবেন না।”
বামের ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে তিনি হচ্ছেন বার্নাডেট ওয়ারেন। দুই সন্তানের মা । তার চোখ এরই মধ্যে ফার্স্ট স্টেজ ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত হয়ে গেছে । পড়তে সমস্য হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বিষয়টি চিকিৎসা করানোর কথা ভাবেননি। তার ধারণা ছিল, তার চশমা নেয়ার সময় হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি চোখ পরীক্ষার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন। তবে চোখের ডাক্তার তার শারীরিক অবস্থায় কিছু পরিবর্তন শনাক্ত করেন। জরুরিভিত্তিতে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করেন। বিশেষজ্ঞ তার চোখে গুরুতর জটিলতা শনাক্ত করেন। যার নাম ডায়াবেটিক ম্যাকুলার ওয়েডেমা।
বার্নাডেট বলেন, ‘আমার রক্তে শর্করার (চিনি) মাত্রা তখন সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল। তবে আমি এখন খুব একটা ভালো দেখতে পাই না। আমার মনে হচ্ছিল, নতুন চশমা নিতে হবে।”
‘চোখে কম দেখার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আমার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ দৃষ্টিশক্তি হারাতে চায় না। পরের ছয় মাস আমি এ নিয়ে কষ্ট পেয়েছি, কেঁদেছি। আমার নিজের জন্য, আমার স্বামীর জন্য, সন্তানদের জন্য এবং আমার আশপাশে যারা আছে তাদের জন্য আমি ইতিবাচক ভাবনায় ফিরতে বাধ্য হয়েছি । তবে কাজটি সহজ ছিল না। তবে চারপাশ থেকে সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে।”
কারা পরীক্ষা করবেন?
যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং বয়স ১২ বছরের বেশি তাদের সবাইকেই প্রতি এক বা দুই বছর পর পর চোখ পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় । কাকে কোন সময় ডাকা হবে তা নির্ধারণ করা হয়, তার আগের অন্তত দুটি পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনা করা হয়।
ডা. মানসেহ বলেন, ‘নিয়মিত ব্যয়াম করা, ধূমপান ত্যাগ করা এবং ব্লাড প্রেসার ও কোলস্টোরেল নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত চোখের অসুখ এবং অন্য সমস্যা থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব । ডায়াবেটিস চোখের পরীক্ষা ১২ বছর বয়স থেকে শুরু করতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে আপনার ডায়াবেটিস আছে কিনা তা বিবেচ্য নয়।”
‘দক্ষিণ এশিয়া ও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় ঐতিহ্যের মানুষের মধ্যে কম বয়সেই টাইপ টু ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এর অর্থ হচ্ছে তারা এই পরিস্থিতি ও ভোগান্তি নিয়ে তাদের জীবনের দীর্ঘ সময় পার করে।”
‘এমন বহু তথ্য রয়েছে যা থেকে ধারণা করা হয়, এদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এই পার্থক্যগুলোর কারণ বেশ জটিল। কাজেই আপনি যদি ডায়াবেটিকের চক্ষু পরীক্ষার জন্য ডাক পান তাহলে আসুন। এটা আপনার দৃষ্টিশক্তিকে সুরক্ষা দেবে।”
এছাড়াও NHS.uk ওয়েসাইট ভিজিট করে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে ।
‘ভালোভাবে চোখের যত্ন নেয়ার মধ্যে নিয়মিত চোখের ডাক্তার দেখানোও অন্যতম । আপনি যদি আপনার ডায়াবেটিক চক্ষু পরীক্ষার অ্যাপয়েন্টমেন্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন তাহলে চোখের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন অথবা সরাসরি চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
চান।”
ডায়াবেটিস নিয়েই ভালোভাবে বাঁচুন
বার্নাডেট এক সময় শিক্ষকতা করতেন। এখন তিনি একটি সাপোর্ট গ্রুপ পরিচালনা কররেন। এই গ্রুপটি ডায়াবেটিকে চোখের সমস্যা নিয়ে কাজ করে । তিনি বলেন, আমদের যখন ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়, তখন আমাদের বহু জটিলতার কথা বলা হয়। যা ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো। এগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কী কী করা উচিত সে সম্পর্কেও আমাদের পরামর্শ দেয়া হয়। অনেক সময় মনে হয়, নিজেই যেন নিজের জন্য এগুলো তৈরি করেছি। তবে আমাদের এই মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে।”
বার্কশায়ারের স্লগে কাজ করেন ডাঃ ভারুন কুমান। তিনিও বিষয়টির সঙ্গে একমত হন। ডায়াবেটিক হওয়ার অনুভূতিটা বিহ্বল করে দিতে পারে । যা আপনার ভালো থাকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে । বিশেষ করে যখন কোনো ধরনের জটিলতা থাকে। কাজেই কোনো কিছু নিয়ে ভারাক্রান্ত অনুভব করলে বলুন । ভয় পাবেন না।”
‘আমরা আপনাদের সাহায্য করার জন্যই আছি। পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়া এবং ব্লাড শুগার পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। যা আপনাকে নিরাপদ, রক্তে সামঞ্জস্যপূর্ণ মাত্রা বজায় রেখে জটিলতার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।”
বার্নাডেট আরো বলেন, ‘মানুষ খারাপ খবর শুনতে ভয় পায়। তবে পরীক্ষা করা এবং ডায়াবেটিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ইতিবাচক বিষয় । যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে আপনি চিকিৎসা পেতে পারেন এবং বর্তমান সময়ে বহু নতুন চিকিৎসা ও ওষুধ পাওয়া যায়।”
টাইপ ওয়ান ও টাইপ টু ডায়াবেটিকের জন্য যেসব পরীক্ষা করতে হবে:
ডায়বেটিক চোখের পরীক্ষা
• প্রতি তিন থেকে ছয় মাস অন্তর চোখের পরীক্ষা, এর মাধ্যমেই বোঝা যাবে রক্তের শর্করা লেভেল কী অবস্থায় আছে।
• বছরে একবার পায়ের পরীক্ষা, এতে করে পা ভালো থাকবে
• বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এর মধ্যে থাকবে ওজন, রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিক সংশ্লিষ্ট অন্য অসুস্থতার ঝুঁকি পরীক্ষা করে দেখা।
ডা. কুমার বলেন, ‘পরীক্ষা এবং এই নিয়মিত চেকআপে অংশ নেয়ার মাধ্যমে জটিলতা সম্পর্কে প্রাথমিক অবস্থাতেই তথ্য পাওয়া সম্ভব হবে । তাহলে এসব বিষয়ে ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে। তবে এই পরীক্ষাগুলোর মধ্যে অসুস্থ হয়ে গেলে, আঘাত পাওয়ার পর যদি ক্ষত না শুকায় বা বার বার সংক্রমণ দেখা দেয় তাহলে নিয়মিত চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা না করে আপনার জিপি প্র্যাকটিস বা বিশেষজ্ঞ টিমের সঙ্গে কথা বলুন।
আরো সহায়তা:
• আপনি যদি ডায়াবেটিসের জন্য ওষুধ গ্রহণ করেন তাহলে medical exemption certificate থেকে আপনি বিনা মূল্যে প্রেসক্রিপশন পেতে পারেন। এনএইচএস হেল্পের সঙ্গে যোগযোগ করুন। হেল্প লাইন 0300 330 134.
• দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হলে যোগযোগ করুন RNIB হেল্পলাইন 0303 123 9999 অথবা ইমেইল করুন helpline@rnib.org.uk অথবা স্থানীয়ভাবে সহায়তার জন্য যোগাযোগ করুন RNIB’s Sightline Directory.
• ডায়াবেটিক ম্যাকুলার ওয়েডেমায় আক্রান্ত হলে কল করুন The Macular Society হেল্পলাইন 0300 303 0111
• যোগাযোগ করুন Diabetes UK. ডায়াবেটিসে সহায়তা বা পরামর্শের জন্য হেল্পলাইন 0345 123 2399 বা মেইল করুন info@diabetes.org.uk
• দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া বা হারানোর জন্য বা চোখ পরীক্ষার জন্য, ধূমপান ছাড়ার জন্য বা অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকার জন্য ভিজিট করুন NHS.uk
আপনি কি জানেন?
ডায়াবেটিক ইউকের তথ্যানুসারে, যুক্তরাজ্যে অন্তত ৮ লাখ ৫০ হাজার মানুষ আছেন ডায়াবেটিক আক্রান্ত। তবে তারা বিষয়টি জানেন না। অনেক সময়ই এর কোনো উপসর্গ থাকে না।
ডায়াবেটিকের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে :
• তৃষ্ণা লাগা
• ঘন ঘন প্রস্রাব, বিশেষ করে রাতে
• ক্লান্ত বোধ করা
• ওজন ও পেশি হ্রাস
• আঘাত বা সংক্রমণ থেকে সহজে সেরে উঠতে না পারা বা ঘন ঘন গলার রোগে আক্রান্ত হওয়া
• ঝাপসা দৃষ্টি
যদি আপনি (বা আপনি চেনেন এমন কেউ) এসব লক্ষণে আক্রান্ত হন বা আপনি জানেন যে আপনার ডায়াবেটিকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে শরীর নিজ থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না । ইনসুলিন একটি হরমান যা শরীরের গ্লুকোজের স্তর নিয়ন্ত্রণ করে । সাধারণত মানুষ এতে শিশু বয়সেই আক্রান্ত হয় । তবে যে কোনো বয়সী মানুষই এতে আক্রান্ত হতে পারে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে শরীর পর্যাপ্ত মাত্রায় ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারেনা বা ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারে। এটা আমাদের জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং প্রতিরোধযোগ্য।
গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিক মেলিটাস সাধারণত গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে। এসময় শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর এটা নিজ থেকেই সেরে যায় । তবে ওই নারী পরবর্তীতে গর্ভবতী হলে আবারো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তার টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে।
আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন কিনা জানতে Diabetes UK’s Know your Risk tool ভিজিট করুন।