নতুন বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্ট
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জানুয়ারি ২০২৩
মাহমুদ আজহার:: আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব দলের জন্যই ২০২৩ সাল একটি টার্নিং পয়েন্ট। ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য ভোটের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে এনে একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোটের আয়োজন করাও বিএনপির সামনে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নের স্লোগান তুলে আওয়ামী লীগ যেনতেন একটি ভোটের আয়োজন করে ক্ষমতায় থাকার ফন্দি করছে। কিন্তু বিএনপি কি সেই ফন্দি আটকে একটি জনগণের অংশীদারমূলক একটি ভোটের আয়োজন করতে পারবে? সেই সক্ষমতা কি তাদের আছে? আবারও কি ২০১৪ সালের মতো কিংবা ২০১৮ সালের মতো এক রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে যাবে দেশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অন্তত সেই আভাসই দিচ্ছেন।
বিএনপির লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৪০ লাখ মামলার খড়গ। দলের প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কার্যত ‘কারাবন্দি’। দলের সেকেন্ডম্যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশের বাইরে। সম্প্রতি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভীসহ চার শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগেও তৃণমূল ও জাতীয় পর্যায়ে অন্তত কয়েক হাজার নেতা-কর্মী বছরের পর বছর কারা ভোগ করে অসছেন। কার্যত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই দেশের বাইরে থেকে টেলিফোনে দিক নির্দেশনা দিয়ে স্থায়ী কমিটির সঙ্গে কথা বলে এখন দল পরিচালনা করছেন।
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দৃশ্যমান উপস্থিত থাকার মধ্যে আলাদা একটি শক্তি কাজ করে। বিএনপিতে এমনও ঘটনা আছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফোনে বা দলীয়ভাবে চিঠি দিয়ে কাউকে একটি কাজের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ভদ্রলোক ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। বেশিরভাগ নেতা-কর্মীকে তোয়াক্কা না করে নিজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য কাজ করেন। এতে দলটি অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে সবক্ষেত্রে যে এমনটি হয়, তাও নয়। বেগম খালেদা জিয়ার দৃশ্যমান অনপুস্থিতিতে দলের পুরো নেতৃত্বের নাটাই এখন তারেক রহমানের হাতে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, শুধুমাত্র ঘুম বাদে বাকি পুরোটা সময় দলের কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারেক রহমান।
এদিকে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে দুই জোটে থাকা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি বাম ও ডান দল বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ছোট বড় ২৬টি দল তাদের যুগপৎ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে বিএনপির আন্দোলনের শরিক বাড়ানোর প্রতিযোগিতা দেখে বসে নেই আওয়ামী লীগও। সম্প্রতি গণবভনে ডেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের ভেতরের খবর, ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক অবস্থাও খুবই নড়বড়ে। ক্ষমতায় থাকার কারণে স্থানীয় প্রশাসন দিয়েই সামাল দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। নামকাওয়াস্তে জাতীয় কাউন্সিল করেও পুরনো নেতৃত্বেই আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে দলটি। শেখ হাসিনাইর দলের প্রধান। আর তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ওবায়দুল কাদের। জেলা পর্যায়েও পুরনো নেতৃত্বই প্রাধান্য পেয়েছে। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা এবারও দলের ভেতর কোনঠাসা। মন্ত্রিসভায়ও নেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা নেতারা। মন্ত্রিসভায় অনেকটা কচিকাচার আসর। শোনা যাচ্ছে, আগামীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কচিকাচার আসরে থাকা মন্ত্রীরাই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবে। দলীয়ভাবে কিংবা সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনাই অল ইন অল। তার বাইরে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। যারা এমনটি করতো তারা এখন দলেও নেই মন্ত্রণালয়েও নেই।
সংসদের প্রধান বিরোধী দল বলে দাবিদার জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পুতুলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা তাদের যেমনি নাচায় তেমনি নাচে! সমালোচকরা বলছেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেবর ভাবির (রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের) মান ভাঙাতে ডাকেন গণভবনে। গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্যমতে, পদ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ না করতে শেখ হাসিনা তাদের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনিত গৃহপালিত বিরোধী দলে রাখার আশ্বাস দেন। এই আশ্ব্সে দেবর ভাবি খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চা পান করে চলে আসেন। মূলত, শেখ হাসিনা যেভাবে চান, জাতীয় পার্টি সেইভাবেই চলছে। নইলে অনেকেরই বিনাভোটে কিংবা আগের রাতে ভোটচুরির মাধ্যমে এমপি হওয়ার স্বাদ মিটে যাবে। তাই এমপিরা শেখ হাসিনার অনুকম্পা নিয়েই গৃহপালিত বিরোধী দল হয়েই থাকতে চান।
এদিকে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টও শেখ হাসিনার অনুকম্পায় টিকে আছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর ছেলে মাহি বি চৌধুরীও শেখ হাসিনার ছায়ায় এমপি হয়েছেন। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে তৃণমূল বিএনপি নামে একটি নাম স্বর্বস্ব দলও আওয়ামী লীগ নেত্রীর অনুকম্পা পেতে দৌড়ঝাপ করছে। কিন্তু এখনও তিনি কোনো সবুজ সংকেত পাননি। এখানে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার চাচা সালমান এফ রহমান। যিনি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
শেখ হাসিনা সরকার যতটা না বিএনপিকে নিয়ে চিন্তিত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের ওপর মার্কিন স্যাংশন আসে। তার কয়েক দিন আগে আমেরিকা প্রায় ১০০টি দেশ নিয়ে গণতন্ত্র সম্মেলন করে। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। কারণ, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এসব নিয়ে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, কানাডা, অস্ট্রোলিয়া অর্থাৎ মার্কিনপন্থী দেশগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বিশাল দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই দূরত্বের কারণেই হোক বা যেকোনো কারণেই হোক, সরকার এখন চীন এবং রাশিয়ার দিকে হেলে পড়েছে।
প্রথম থেকেই এই সরকারকে অন্যেরা বলতো প্রো-ইন্ডিয়ান অর্থাৎ ভারতপন্থী। তবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে নৈকট্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের আধিপত্য কিঞ্চিৎ হ্রাস পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এতে ভারতের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব কিছুটা বেড়েছে। কার্যত, এখন বাংলাদেশ ইস্যুতে তবে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, জাপান প্রভৃতি প্রভাবশালী দেশ একদিকে অন্যদিকে চীন-রাশিয়াসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ? শেখ হাসিনা কোন পথে হাটবেন? তাকে দেশীয় রাজনীতির চেয়ে এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েই টেনশনে থাকতে হচ্ছে।
মেট্রোরেল নিয়ে আজ সরকারের এত হৈচৈ তার অর্থ জোগান দিয়েছে তো জাইকা, অর্থাৎ একটি জাপানি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বৃহত্তম আয় আসে গার্মেন্ট থেকে। আর এই গার্মেন্টের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো আমেরিকা। আমেরিকাকে চটিয়ে বাংলাদেশ কতদূর লাভবান হবে সেটি বলবে সময়। অন্যদিকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় ভারতও ভালো চোখে দেখছে না। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে কূটনৈতিক চাপ ততৈই বেশি বাড়ছে শেখ হাসিনার ওপর।
বাংলাদেশের রাজনীতিও এখন এমন অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীই শুধু নয়, তারা একে অপরের শত্রু। বিয়েশাদী, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেই। এমনকি বিএনপি নেতারা কোনো বিয়েতে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাতে অংশ নেয় না। তাদের মধ্যে নেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহিঞ্চুতা বা বিনয় নম্রতা। জাতীয় রাজনীতিতেও সংলাপ সমঝেতার সম্ভাবণা খুবই ক্ষীণ। ২০১৮ সালের ভোটের আগে যেই সম্ভাবনাও ছিল এখন সেটা আর নেই বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। কারণ, ওই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কোনোটাই রক্ষা করেননি বলে দাবি বিএনপির। লড়াইটা যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতার মালিকানা নিয়ে, সেখানে শরিকানার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সংঘাত সংঘর্ষ অনিবার্য। সংঘাত এড়াতে দুই পক্ষকেই নমনীয় হতে হবে, অথবা এক পক্ষকে অন্য পক্ষের কথা মেনে নিতে হবে। কিন্তু সেই আভাস দেখা যাচ্ছে না। এখানে জনগণ বা ভোটাররা খুবই অসহায় । সুতরাং এটা বলায় যায়, ২০২৩ সালটি হবে খুবই অনিশ্চিত, স্পর্শকাতর ও আতঙ্কের। এই বছরটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট।
লেখক : সাংবাদিক