বিমান কেন তা পারে না?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
তাইসির মাহমুদ :: দিন তারিখ মনে নেই। তবে সালটি ছিলো ২০১২। দেশে স্বজনদের সাথে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে লন্ডন ফিরছিলাম। টিকিট ছিলো কাতার এয়ারওয়েজের। ঢাকা থেকে ফিরতি ফ্লাইট ভোর ৪টায়। তাই আগের দিন বিকেলে ডমেস্ট্রিক ফ্লাইট ধরে সিলেট থেকে ঢাকায় পৌঁছে হোটেলে উঠি। যেহেতু ভোর ৫টায় ফ্লাইট তাই রাত ৩টার আগেই আমার এয়ারপোর্টে পৌঁছার কথা। কিন্তু ঘুম থেকে জেগে দেখি হোটেলেই ৩টা বেজে গেছে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে রেডি হয়ে হোটেলের গাড়িতে করে শাহজালাল এয়ারপোর্টের পথে রওয়ানা দিলাম। পৌঁছে দেখলাম ঘড়িতে তখন ৪টা। লাগেজ টেনে দৌঁড়ে পৌঁছলাম চেক-ইন-কাউন্টারে।
কিন্তু ততক্ষনে যাত্রীদের বোর্ডিং শেষ করে কাউন্টারের কর্মকর্তারা ভেতরে চলে গেছেন। পুরো কাউন্টারই খালি। শুধু একজন মহিলা কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম- আমি তো ৫টার ফ্লাইটের যাত্রি। মহিলা বললেন, আপনি তো দেরি করে ফেলেছেন। কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। এখন করার কিছু নেই।
বললাম, কিছু একটা করুন প্লিজ। আমাকে এই ফ্লাইটে যেতেই হবে। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে জানতে চাইলাম ম্যানেজারের (কাতার এয়ারওয়েজের) কার্যালয় কোন দিকে। তিনি রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, দোতলায় চলে যান। আমি দ্রুত ম্যানেজারের রুমে পৌঁছে বললাম, ‘‘স্যার, আই অ্যাম লেট । ক্যান ইউ হেলপ মি প্লিজ’’। তিনি বললেন, ইউ আর টু লেট। হোয়াট ক্যান আই ডু। বলেই ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে বললেন, মিঃ সালাম ক্যান ইউ এলাও ওয়ান মৌর প্যাসেঞ্জার প্লিজ। ওপাশ থেকে সালাম সাহেব উত্তর দিলেন- সেন্ড হিম স্যার। ওয়াকিটকি রেখেই ম্যানেজার বললেন, দ্রুত কাউন্টারে চলে যান প্লিজ। আমি দ্রুত ছুটলাম। কিন্তু এতো দ্রুত ছুটলাম যে, তাড়াহুড়োর কারণে ডিপার্চারের লিফট না ধরে এরাইভালের লিফটে ওঠে পড়লাম। লিফটটি যখন খুললো তখন টের পেলাম আমি এরাইভাল (অবতরন) সেকশনে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীরা বেরিয়ে যাচ্ছেন।
দ্রুত আবার লিফটে চড়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে চেক-ইন কাউন্টারে পৌঁছলাম। দেখলাম, সেই নারীই ডেস্কে বসে আছেন । আমাকে দেখেই বললেন, সালাম সাহেব এসে অপেক্ষা করে চলে গেছেন। আপনি আবারও লেট। বললাম, কিছু একটা করুন প্লিজ। মহিলা বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করলেন। নিরুপায় হয়ে আবারও ম্যানেজারের রুমে ফিরে গেলাম। আমার হন্তদন্ত অবস্থা। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার চাপ। বললাম- ‘ম্যানেজার সাহেব, প্লিজ একটু চেষ্টা করুন। আমি ভুল করে এরাইভালে চলে যাওয়ায় সালাম সাহেবকে গিয়ে পাইনি।
তিনি বললেন, এতো চিন্তা করছেন কেন? আঙুল ইশারায় সোফাসেট দেখিয়ে বললেন, এখানে বসুন । কফি খান। রিলাক্স করুন। পিয়নকে বললেন, উনাকে এক-কাপ কফি দাও। কফি খেতে খেতে বললেন, ৮ টায় আরো একটি ফ্লাইট আছে। চিন্তা করবেন না। ওই ফ্লাইটে আপনার টিকিট আপগ্রেড করে দেবো। তাঁর কথা শুনে স্বস্তি পেলাম। তাহলে ৮টায় আরো একটি ফ্লাইট আছে। আজকের মধ্যেই ফ্লাই করতে পারবো।
কফি খাওয়া শেষ হলে ম্যানেজার বললেন, ৬টার দিকে পরবর্তী ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টার খুলবে। এখনও ঘণ্টা খানেক সময় বাকি আছে। লাগেজ এখানে থাক। আপনি চাইলে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঘুরাঘুরি করে ৬টার দিকে ফিরে আসতে পারেন। তাঁর কথা মতো ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে ৬টার দিকে ফিরে এলাম। রুমে পৌঁছতেই বললেন, ওহ আপনি এসেছেন? রোজিনা- উনার টিকিটটি ৮টার ফ্লাইটের জন্য আপগ্রেড করে দাও।
কম্পিউটার অপারেটর রোজিনা ইসলাম আমার কাছ থেকে টিকিটটি নিয়ে আপগ্রেড করে দিলেন। ভাবছিলাম, শ’দুয়েক পাউন্ড তো দিতেই হবে। কিন্তু আশ্চর্য হলাম। তাঁরা টিকিট আপগ্রেড বাবদ কোনো টাকাই চাইলেন না। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যানেজার ও রোজিনা ইসলামের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চেক-ইন কাউন্টারে চলে এলাম ।
লাগেজ বেলটে দিয়ে প্রয়োজনীয় চেকিং শেষ হওয়ার পর কনকোর্স হলে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে বসে ফ্লাইটের অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেনে উঠবো। এমন সময় কম্পিউটার অপারেটর রোজিনা ইসলামের কণ্ঠ কানে বাজলো: ‘‘মিঃ তাইসির মাহমুদ, মিঃ তাইসির মাহমুদ। তিনি আমার নাম ধরে ডাকছেন। হাত তুলে আমার উপস্থিতি জানান দিলে তিনি কাছে দাঁড়ালেন। বললাম, কোনো সমস্যা? বললেন, নাহ, কোনো সমস্যা নেই। আপনার টিকিটটা একটু দিন। এরপর তিনি টিকিট থেকে একটি পাতা ছিড়ে নিয়ে আরো একটি পাতা দিয়ে গেলেন। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারিনি। ভাবলাম, বোধহয় আগে টিকিট আপগ্রেড করতে কোনো ভুল-টুল হয়ে থাকতে পারে।
এবার ডাক পড়লো প্লেনে ওঠার। যেহেতু আমার ইকোনামিক ক্লাসের টিকিট তাই ইকোনোমিক সেকশনেই সীট খুঁজছিলাম। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে এয়ারহোস্টেজকে বোর্ডিং কার্ডটি দেখালাম। তিনি কার্ডে চোখ বুলিয়েই আমাকে নিয়ে গেলেন বিজনেস ক্লাসে। সীট নাম্বার দেখিয়ে দিয়ে বললেন এটাই আপনার আসন। এরপর নিজ হাতে লাগেজটি বাংকারে তুলে রেখে বিদায় নিলেন। আমি তখনই রোজিনা ইসলামের টিকিটের পাতা ছিড়ে নেয়া ও নতুন পাতা দেয়ার মাহাত্ম্য বুঝতে পারলাম। সম্ভবত তিনি শেষ বেলায় দেখেছেন, বিজনেস ক্লাসে একটি সীট খালি যাচ্ছে তাই আমার কথাটি তাঁর মনে হয়েছে। তাই তিনি নিজ দায়িত্বে টিকিটটি আপগ্রেড করে অফিস থেকে অনেকদূর পায়ে হেঁটে এসে কনকোর্স হলে দিয়ে যান।
এরপর বিজনেস ক্লাসের সেই আরামদায়ক চেয়ারে বসে উন্নত নাস্তা ও খাবার খেতে খেতে পরদিন সকালে কাতার এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। কাতারে ১৫ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম। সেখানে কিছু প্রবাসী-স্বজনের সাথে সময় কাটিয়ে রাত ১টায় আবার লন্ডনমুখী ফ্লাইটে চড়লাম। পরদিন সকালে পৌঁছলাম হিথ্রো বিমানবন্দরে।
এ-তো গেলো কাতার এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের সুখকর কাহিনী। ২০১৪ সালে স্বপরিবারে সৌদি এয়ারলাইন্সে মক্কায় গেলাম ওমরা পালন করতে। ছোট ছেলে মিকাইল মাহমুদের বয়স তখন ৩ বছর। ওর পুশ চেয়ার লাগে। ওমরাহ শেষে ফেরার সময় জেদ্দা এয়ারপোর্টে পুশ চেয়ার থেকে মিকাইলকে নামিয়ে আমরা প্লেনের ভেতরে ঢুকে যাই। কর্তব্যরত কর্মকর্তারা পুশচেয়ারটি তাদের কাছে রেখে দিয়ে বললেন, তারা সেটি প্লেনের স্টোরে রাখবেন। এই ফ্লাইটেই হিথ্রোতে পৌঁছবে।
পরদিন সকালে এসে পৌঁছি হিথ্রো এয়ারপোর্টে। প্লেন থেকে নেমে ব্যাগেজ সেকশনে গিয়ে দেখি লাগেজ এসেছে, কিন্তু পুশ চেয়ার নেই। গেলাম লস্ট এন্ড মিসিং সেকশনে। বললাম, আমাদের পুশচেয়ার পাইনি। কর্তব্যরত মহিলা টিকিট নাম্বার কম্পিউটার সিস্টেমে চেক করে বললেন, স্যরি আপনাদের পুশ-চেয়ার জেদ্দা এয়ারপোর্টে রয়ে গেছে। চিন্তার কারণ নেই। আগামীকাল ১২টার মধ্যে আপনার ঘরে পৌঁছবে। ঘরে পৌঁছে ভাবছি, আদৌ কি পুশচেয়ারটি ফিরে পাবো? জেদ্দা থেকে ঘরে ফিরে আসবে?
কিন্তু যেই কথা সেই কাজ। পরদিন সকাল সাড়ে ১১টায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুলে দেখি ডেলিভারিম্যান পুশচেয়ার নিয়ে দরজার সম্মুখে দণ্ডায়মান। প্রাপ্তিস্বীকার স্বাক্ষর গ্রহণ শেষে চেয়ারটি বুঝিয়ে দিতে বিদায় নিলেন তিনি। ২০১০ সালে আমি ও আমার ছোট ভাই মুহাম্মদ রাহিম হজ্জে গেলাম। হিথ্রোতে পৌঁছে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি প্লেনে ওঠবো। কেউ একজন বললো ‘ফ্লাইট ওভারলোডেড। আপনারা এই ফ্লাইটে যেতে পারবেন না। আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাদের সম্মুখের সকল যাত্রী ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। এখন আমাদের ডাক আসার পালা। কিন্তু আসে-কিনা দোদল্যমান অবস্থা। হঠাৎ ভেতর থেকে ডাক- ‘‘টু মৌর প্যাসেঞ্জার প্লিজ’’ (আরো দুইজন যাত্রী প্লিজ)। আমরা দ্রুতপায়ে প্লেনে ঢুকে গেলাম।
ভেতরে ঢুকে সেই একই অবস্থা। সীট খুঁজছি ইকোনোমিক ক্লাসে। বোর্ডিং কার্ড দেখালে এয়ারহোস্টেজ নিয়ে গেলেন বিজনেস ক্লাসে। খুবই আরামে সাড়ে ৬ ঘণ্টা সৌদি এয়ারে চড়ে পৌঁছলাম জেদ্দা এয়ারপোর্টে। এই গল্পগুলো আজ হঠাৎ করে স্মরণ হওয়ার কারণ বাংলাদেশ বিমানের যাত্রীসেবার নমুনা। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে লন্ডনগামী বিমানযাত্রী জামিলা চৌধুরীর সাথে সংঘটিত ঘটনাই বিদেশী এয়ারলাইন্সের যাত্রীসেবার কথা মনে করিয়ে দিলো।
আচ্ছা, কাতার এয়ারলাইন্স যা পারে, সৌদি এয়ারলাইন্স যে সেবা দিতে পারে-বাংলাদেশ বিমান কেন তা দিতে পারে না? সমস্যাটা কোথায়?
লেখক: তাইসির মাহমুদ,
সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন।
২০ আগস্ট ২০২১।