স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী : ৫০ বছর পরও জাতি কেন দ্বিধাবিভক্ত ?
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মার্চ ২০২১
আব্দুস সহিদ
বৃটিশরা প্রায় দুই শত বছর ভারত উপমহাদেশে তাদের রাজত্ব কায়েম করে । একটা দেশ যখন বানিজ্যের নামে আরেকটি দেশ দখল করে নেয় তখন তাকে আমরা উপনিবেশবাদ বলে থাকি। বৃটিশ সরকার তাই করেছে । তারা বানিজ্যের অজুহাতে এই উপমহাদেশে নির্বিঘ্নে শোষন চালিয়েছিলো ।বৃটিশ উপনিবেশ আমলে হিন্দু জমিদার ও মুসলিম চাষিদের মধ্যে বিভিন্ন কারণ সামাজিক বৈষম্য তৈরী হয়। কৃষকদের মুক্তির আন্দোলনই কাল পরিক্রমায় পাকিস্তান আন্দোলনে পরিনত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের (টু ন্যাশন থিওরী) ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র । অর্থাৎ, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট। ভারত তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছে ১৫ ই আগস্ট থেকে । পাকিস্তানের জন্ম ছিল মূলত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের চুড়ান্ত রুপ ।এর বীজ বপন করা হয়েছিল মূলত ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে । ওই সম্মেলনে গৃহীত হয় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। যা ছিল ভারতের উত্তর পূর্ব ও উত্তর পশ্চিম অংশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাস্ট্র এবং মধ্য ও দক্ষিনের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে হিন্দু রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৬ সালে সাধারন নির্বাচনে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন আরো বৃদ্ধি পায়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিমলীগ এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় কংগ্রেসের প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে স্বতন্ত্র রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃটিশ গভর্ণর লর্ড মাউন্ট বেটেন ১৯৪৭ সালে জুন মাসেই দেশ বিভাগের নীতি ঘোষণা দেন। যার ফলশ্রুতিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বতন্ত্র জাতি সত্তার অভ্যুদয় ঘটে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকেই (পূর্ব ও পশ্চিম) দুটি অংশের মধ্যে শুরু হয় নানাবিধ বৈষম্য। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে ষড়যন্ত্র।১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকার পৃথক দুটি সমাবেশে বলেন “ উর্দু ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” একথা বলার পর প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে বাংলার ছাত্রসমাজ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আশপাশ এলাকা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে নিহত হন সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর সহ নাম না জানা অনেকে। এর পর ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সহ ২১ দফা দাবী নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়ে সরকার গঠন করে। মূখ্যমন্ত্রী হন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক।
বেশি দিন স্থায়ী না হয়ে অবশেষে ভেঙ্গে যায় যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১৯৬২ সালে শুরু হয় শিক্ষা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালে পেশ করা হয় ঐতিহাসিক ৬ দফা। ছাত্রদের ১১ দফা দাবী সম্বলিত ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। এর পর শুরু হয় ১৯৬৯ সালে দেশজুড়ে গনঅভ্যুত্থান।ওই গণ অভ্যুত্থানের মুখে আয়ুব খানের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসীন হন নব্য স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান। আন্দোলন ও দাবীর মুখে বাধ্য হয়ে ইহাহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণপরিষদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর ও ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাক না দিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন পতাকা উত্তোলনের পর ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষনের মাধ্যমে জনগনকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান। ৭ ই মার্চের ভাষন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ন ছিল এবং ওই ভাষন মুক্তিকামী মানুষকে আরো বেশি অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে। ২৩ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন করার মাধ্যমে হঠাৎ করে ২৫ শে মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকা আক্রমণ করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন সহ অসহায়, ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু করে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযক্ষ। সেই সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। অসহায়, দিশেহারা জাতি কি করবে, এরই মধ্যে মেজর জিয়া ‘উই রিভোলট’ বলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধ যুদ্ধের আহবান জানান।
২৬ শে মার্চ (প্রথম প্রহরে) নিজে ই চট্রগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। পরে অবশ্য পূনরায় সংশোধীত ঘোষনা ২৭ শে মার্চ শেখ মুজিবের পক্ষে প্রদান করেন। তার ঘোষনার পর সামরিক/বেসামরিক মিলে শুরু হয় স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পাই লাল সবুজের পতাকার একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
এখানে বলে রাখা দরকার ‘ স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এবং ‘ মুক্তিযুদ্ধ’ এক জিনিষ নয়, দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। অতএব স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অবশ্যই বড় মাপের নেতা ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসাবে মেজর জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করার উপায় নাই। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় কোনোদিন জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলেননি, উপরুন্ত তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ “বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করেছেন। অপরদিকে জিয়াউর রহমান ও কোনোদিন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেন নি। নিজেকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করা সমিচীন নয়। যার যতটুকু অবদান তা স্বীকার করে সত্য প্রকাশে উদ্যোগী হওয়া দরকার। সুতরাং এই দুই মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ও মেজর জিয়াউর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সিলেটের কৃতিপুরুষ জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী সহ সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।
পরিশেষে এটুকু বলতে চাই, বাংলাদেশ সৃষ্টির আজ ৫০ বছর। জাতি হিসাবে আমরা উদযাপন করছি স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী।একটি জাতির জন্য ৫০ বছর দীর্ঘ না হলেও একজন ব্যক্তির জন্য অনেক বছর। আমরা যে সকল মৌলিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিল- ১।সাম্য, ২।মানবিক মর্যাদা, ৩।সামাজিক ন্যায় বিচার, ৪।বৈষম্যহীন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ নিয়ে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হলাম, সেই লক্ষ্য কতটুকু পূরন করতে পেরেছি? অথবা স্বাধীনতার মর্যাদা কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি ? ৫০ বছর পর এখনও এই প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাছাড়া স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে আর কত বছর আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে ? সুবর্ন জয়ন্তীতে এসে আজও এর উত্তর খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে জাতিকে ।
আব্দুস সহিদ : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী। প্রাক্তণ প্রভাষক, নারীশিক্ষা একাডেমী ডিগ্রী কলেজ, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।