ভ্রমণ কাহিনী: লন্ডন টু লিথুয়ানিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২০
আকবর হোসেন :: হঠাৎ করেই লিথুয়ানিয়া যাবার প্রস্তুতি। প্রস্তাব পেয়ে আর দেরি করিনি। সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদের সাথে হোয়াইটচ্যাপেলের একটি দেশি রেষ্টুরেন্টে বসে বিকেলের ট্রেডিশনাল খাবার ছানা পিঁয়াজু খাচ্ছিলাম। সাথে সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং কবি আব্দুল কাইয়ূম। ওয়েস্ট লন্ডনে বসবাস কিন্তু নাড়ীর টান ইস্ট লন্ডনে। উইকএন্ডে ইস্ট লন্ডনের দিকে গেলে মাঝেমধ্যে সাংবাদিক কবি লেখক বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডায় জড়িয়ে পড়তে হয়। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাইসির ভাইয়ের সাথে দেখা। আর যায় কোথায়। এদিক সেদিক ফোন শুরু হলো। মতিউর ভাই এলেন তারপর কাইয়ূম ভাইও। সুস্বাদু পিঁয়াজুটা মুখে নিতেই তাইসির ভাই বললেন, যাবেন নাকি লিথুয়ানিয়ায়? সঙ্গে সঙ্গে মতিউর ভাই বললেন তিনিও যাচ্ছেন। আমি বললাম ভিলনিয়াসে (লিথুয়ানিয়ার রাজধানী? বললেন না, কাউনাসে। কেউ কেউ বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল ২০১৭) এবং বাকীরা শুক্রবার (২১ এপ্রিল ২০১৭) যাবেন। রায়ান এয়ারে বৃহস্পতিবার আর উইজ এয়ারে শুক্রবারে লুটন থেকে যেতে হবে। এরই মধ্যে দেলোয়ার ভাইয়ের (দেলোয়ার হোসেন খান, এলএমসি ডাইরেক্টর) ফোন এলো। তিনিই হচ্ছেন মূল অর্গেনাইজার। সাথে সাথেই এক ধরণের সম্মতি দিলাম আর বললাম রোববার কনফার্ম করবো। ভাবলাম অফিস থেকে একদিন ছুটি নিলেই হবে রোববারেতো চলেই আসবো। কথা হচ্ছিলো শনিবার অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল। এক পর্যায়ে আড্ডার পরিসমাপ্তি টেনে বাসায় ফিরলাম।
যাত্রার প্রস্তুতি :
স্ত্রীকে বললাম, দু’দিনের সফরে লিথুয়ানিয়া ২১ এপ্রিল যাবার কথা। জিজ্ঞেস করলাম যাবো কি-না। সিদ্ধান্ততো এক ধরণের নেয়াই তারপরও জিজ্ঞেস করা আর কি! তিনি বললেন, আর কোনও দেশ পাওনি যাবার, লিথুয়ানিয়া! হয়তো ভাবছিলো এটা আবার কোথায়? বললাম, এটি ইউরোপেই, পোলান্ডের পাশের একটি দেশ। তাদের জীবনযাত্রা দেখতে যাবো। বেড়ানোও হবে সাথে অনেক অজানা বিষয়ও জানা হবে। হলিডেতো একটি ফান। কিন্তু এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী হলিডে। এই গ্রুপে বিভিন্ন প্রফেশনালস্ বিশিষ্টজন আছেন। তাদের সাথে যাওয়াটাও একটি সৌভাগ্যের ব্যাপার। রথ দেখা হবে, কলাও বিক্রি করা যাবে! এবার শুরু হলো উইজ এয়ারে টিকেট সার্চ। রোববারেই দেলোয়ার ভাইকে কনফার্ম করলাম এবং তার আগেই অফিসে বার্তা দিয়ে শুক্রবারের ছুটি নিশ্চিত করলাম। টিকিট তো পেলাম কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে। এমন এক সাইজ যা’ যোগাড় করা দুস্কর। ওয়েবসাইটে যে সাইজ দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী ঘরে কোনও হ্যান্ড লাগেজ পেলাম না আবার নতুন কোন হ্যান্ড ল্যাগেজ কিনতেও চাচ্ছি না। এ নিয়ে আমাদের লিথুয়ানিয়া হোয়াটসআপ গ্রুপে আলোচনা বেশ জমে উঠলো। বুঝলাম সবাই হ্যান্ড লাগেজের সাইজ নিয়ে বেকায়দায় আছেন। অবশেষে আমার স্ত্রী মোটামুটি এয়ারলাইনের দেয়া সাইজ অনুযায়ী একটি হ্যান্ড লাগেজ আমার জন্য ঠিক করলেন। তারপর সংক্ষিপ্ত সফরের জন্য যা’ যা’ দরকার সেগুলো গোছগাছ করা হলো। সংক্ষিপ্ত সফরে একটি লাগেজই যথেষ্ট। এবার শুধু অপেক্ষা গভীর রাতের। কারণ ভোরের ফ্লাইট ধরতে রাতেই রওয়ানা দিতে হবে।
লুটন টু কাউনাস :
লুটন এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইট সকাল পৌনে আটটায়। সঙ্গী আরো চারজন। আমরা গাড়িটি নিয়ে এয়ারপোর্ট যাবার সিদ্ধান্ত হলো। ক্যারল ভাই (আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল, সাবেক সম্পাদক, ইউরোবাংলা) এয়ারপোর্ট কার পার্ক বুক করলেন এবং তিনিই ড্রাইভ করবেন সেটা নিশ্চিত করলেন। আমি শুধু ইস্ট লন্ডনে তার বাসা পর্যন্ত যাবো তারপর ষ্টিয়ারিং হুইল তিনিই ধরবেন। রাত ৩টার দিকে হাউন্সলো থেকে রিচমন্ড হয়ে চিজিক, আর্লস্কোর্ট, পার্লামেন্ট, বিগবেন, লন্ডন আই ও টেমস নদীর তীর ঘেঁষে ইস্ট লন্ডন যাচ্ছি। সাথে নিজের হাতের বানানো কফি। বলতে গেলে কফি খেতে খেতেই যেনো ক্যারল ভাইয়ের বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। রাস্তায় কোনও ট্রাফিক পেলাম না। এই লন্ডন জীবনে অতীতে আর কখনো এতো তাড়াতাড়ি ইস্ট লন্ডনে পৌঁছতে পারিনি। প্রায় জনমানবশুন্য খালি রাস্তায় যেনো গভীর রাতের হরতালের দৃশ্য। গাড়িঘোড়া নেই বললেই চলে। আনুমানিক চল্লিশ মিনিট পর ক্যারল ভাইয়ের বাসার সামনে হাজির। এবার তার পালা। পরের ষ্টেশন জুবায়ের ভাই (মুহাম্মদ জুবায়ের, চ্যানেল এস-এর চীফ রিপোর্টার), তারপর নাজির ভাই (ব্যারিস্টার নাজির আহমদ)। সেখানেই ফজর নামাজ আদায় করা হলো। সর্বশেষ হাবিব ভাইকে (মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান – চেয়ারম্যান, ইস্ট লন্ডন মস্ক) পিকআপ করে লুটন এয়ারপোর্টে গিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছলাম।
সঙ্গী সাথী কারো কারো হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে উদ্বিগ্নতা ছিলো বটে তবে একজনকেই শুধু টিকিট প্রিন্ট না করা এবং হ্যান্ড লাগেজটা একটু বড় হবার কারণে আক্কেল সেলামী দিতে হলো। নাস্তা তো আগেই সেরে নিয়েছিলাম এবং কিছু খাবার স্নাক্স সাথেও নিলাম কারণ প্লেন থেকে যাতে কিছু কিনতে না হয়। এসকল বাজেট এয়ারলাইনে ফ্রি খাওয়া নেই, কিনে খাওয়া লাগে।
যাই হোক প্রায় পৌনে তিন ঘন্টা পর আমাদের প্লেন লিথুয়ানিয়ার কাউনাসে অবতরণ করলো। বলা যায় গল্প শেষ হতে না হতেই যেনো প্লেন থেকে নেমে পড়তে হলো। কেউ কেউ ঘুমিয়েছেন আবার কেউ হয়তো চোখ বুজে লন্ডন কাউনাস স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।
কাউনাস শহর ও মসজিদ :
খুবই ছোট্ট এয়ারপোর্ট; সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর থেকেও আরো ছোট মনে হলো। তেমন কেউ নেই। ইমিগ্রেশন ক্রস করে সহজেই বের হলাম। ট্যাক্সি ডাকা হলো। আমরা একসাথে ছিলাম পাঁচজন। হাবিব ভাই দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে যোগোযোগ করে গন্তব্যের ডাইরেকশন দিলেন। কিছু সময় পরই কাউনাস মসজিদের পাশে আমাদের ট্যাক্সি থামলো। পার্কের ভেতরেই মসজিদটি অবস্থিত। দিনটি ছিলো জুমুআবার। ভাগ্যিস জুমুআ ধরতে পারলাম। আমাদের হোস্ট মুফতি রামাদ্বান খুতবা দিলেন। আগেরদিন যারা গিয়েছিলেন তারাও সেখানে জুমুআর নামাজ আদায় করলেন। এখন আমরা সবাই একসঙ্গে। মসজিদেই দেখা হলো বাংলাদেশী ৩/৪ জন ছাত্রের সাথে। নামাজের পর সেখানে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো। তাজিক খাবার। অনেকটা আমাদের দেশী বিরিয়ানীর মতো। বেশ সুস্বাদু। এবার হোটেলে যাবো। সিদ্ধান্ত হলো হেঁটেই যাবো। তাহলে শহরের একটি দিক দেখা হয়ে যাবে। হোটেল খুব বেশি দুরে নয়। প্রায় পনের মিনিট পর হোটেলে পৌঁছলাম।
লিথুয়ানিয়ায় বর্তমানে মোট ৪টি মসজিদ অবশিষ্ট রয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়া যখন শাসন করছিলো তখন অনেক মসজিদ ও সেন্টার ধ্বংস করে দেয়া হয়। কাউনাস মসজিদ সর্বপ্রথম নির্মিত হয় ১৮৬০ সালে। এটি ছিলো কাঠের তৈরি মসজিদ। তারপর ১৯৩০ সালে লিথুয়ানিয়া সরকারের সহযোগিতায় ইট দ্বারা এটি পূনঃনির্মিত হয়। সোভিয়েত শাসনামলে এই মসজিদটি সার্কাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবশেষে ১৯৯১ সালে মসজিদটি নামাজের জন্য খুলে দেয়া হয়।
এক নজরে আধুনিক লিথুয়ানিয়া :
মোট জনসংখ্যা ২.৮ মিলিয়ন (২০১৭)। ১৯১৫ সালে জার্মানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লিথুয়ানিয়া দখল করে। কিন্তু ১৯১৮ সালের তারা জার্মানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মস্কো চুক্তি অনুযায়ী ১৯২০ সালে রাশিয়া তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। ১৯৩৯ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন লিথুনিয়ানিয়ায় সেনাঘাটি স্থাপনে তাদেরকে বাধ্য করে। ১৯৪০ সালে লিথুয়ানিয়াকে সোভিয়েতের অন্তুর্ভূক্ত করা হয়। ১৯৪১ সালে হাজার হাজার লিথুয়নিয়ানকে সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেয়া হয়। নাৎসী বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে এবং এরই অংশ হিসেবে তারা লিথুয়ানিয়া দখল করে। কিন্তু ১৯৪৪ সালে আবার রাশিয়ান আর্মি লিথুয়ানিয়ায় ফিরে আসে।
১৯৮৯ সালে লিথুয়ানিয়ান পার্লামেন্টে দেশটির সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয়া হয় এবং রাশিয়ান আইনের তুলনায় নিজস্ব আইনের প্রাধান্য দিয়ে আইন পাশ হয়। ১৯৯১ সালে রাশিয়া লিথুয়ানিয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় এবং তারপরই লিথুয়ানিয়া জাতিসংঘে যোগ দেয়। ১৯৯২ সালে দেশটির নতুন সংবিধান প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রবর্তন করে এবং নির্বাচনে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে লিথুয়ানিয়ান ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি সাজুদিস পার্টির চাইতে বেশি সিট পায়। এরই ফলশ্রুতিতে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। ১৯৯৩ সালে লিথুয়ানিয়া কাউন্সিল অব ইউরোপে যোগদান করে। সোভিয়েত বাহিনী পুরোপুরিভাবে চলে যায়। ২০০৪ সালে লিথুয়ানিয়া ইউরোপের আরো ১০টি দেশের সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে স্থান পায় এবং তারা ন্যাটো বাহিনীতেও যোগ দেয়। (তথ্যসূত্রঃ বিবিসি)
লিথুয়ানিয়ায় ইসলাম :
লিথুয়ানিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা খুব নগন্য। মুসলমানদের সংখ্যা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.১ শতাংশ । তারা তাতার মুসলিম নামে পরিচিত। এখানে ইসলামের আগমন ঘটে ১৫ শতাব্দীতে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে অনেক পূর্বেই মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়। লিথুয়ানিয়ার গ্রান্ড ডিউক ভিতাউতাস দ্যা গ্রেট ভিলনিয়াস এর সীমানাকে সুরক্ষার জন্য তাতার মুসলিমদের নিয়ে আসেন। এরপরই তাদের বিস্তৃতি ঘটে। তারা দেশটির বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টার গড়ে তোলেন। এগুলোর মধ্যে চারটি মসজিদ এখনো টিকে আছে।
মুফতি রামাদ্বান ইয়াকুব :
তিনি হলেন লিথুয়ানিয়ার গ্রান্ড মুফতি। বালটিক তাতাররা ট্র্যাডিশনালি দু’টো নাম ধারন করেন। যেমন মুফতি রামাদ্বানের অফিসিয়েল নাম হচ্ছে রমাস জাকুবাউকাস। তার মুসলিম নামটি তিনি তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে ব্যবহার করেন। তার পূর্বপুরুষরা ক্রাইমিয়ান যারা রাজা ভিতাতাউসের সময় এখানে আসেন। তিনি তাদেরই উত্তরসুরী। পুরো সফরে তিনি আমাদের গাইড করেছেন তার জীবনের অনেক না বলা কথা আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন দেখভাল করেছেন হোস্ট হিসেবে। লিথুয়ানিয়ান তাতার মুসলিমদের জীবন ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য দর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টার, শপিং মল, রাজপ্রাসাদ, নদী, ওলট সিটি, বিখ্যাত গির্জা, কবরস্থান সহ নানা আকর্ষনীয় জায়গায় আমাদের নিয়ে গিয়েছেন। তার আতিথেয়তায় আমরা সত্যিই মুগ্ধ।
মুফতি রামাদ্বানের পক্ষে ছোটবেলায় ইসলাম জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন মুসলিম ছাত্ররা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লিথুয়ানিয়ায় আসা শুরু করলো তখন তার সাথে মুসলিমদের যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় এবং তাদের সাহায্যে তিনি লেবানন ও লিবিয়ায় ইসলামী শিক্ষা লাভ করেন। কিভাবে ইউরোপিয়ান মুসলিম কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দেয়া যায় তার দীক্ষা তিনি মালটিকালচারাল লেবানন থেকে লাভ করেন এবং এসব তিনি বর্ণনা করেন আমাদের সাথে সফরকালে। তিনি বলেন, লিথুয়ানিয়ানদের ওপর সবচেয়ে কঠিন সময় গেছে রাশিয়ানদের শাসনকালে। সকল মুসলিম স্কলার এবং জ্ঞানী লোকদের হয় হত্যা করা হয়েছিলো অথবা সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিলো। মসজিদগুলোকে বন্ধ করে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং যতো বইপত্র ও আর্কাইভ সেগুলোও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কমিউনিটির সব ধরণের কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়া হয়। ইসলাম ছিলো সে সময় নিষিদ্ধ।
তিনি আমাদেরকে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কবরস্থান দেখালেন। তখন আমাদের পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের অমর কবর কবিতার কথা মনে পড়লো – এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। তিনি একে একে তার স্বজনদের কবরের নেইমপ্লেট আমাদের দেখাচ্ছিলেন। আমরা তাতার ফ্যামিলির একটি ভিলেজে গেলাম যেটি ‘ফরটি তাতার ভিলেজ’ নামে পরিচিত। এই গ্রামটি ভিলনিয়াসের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত শতাব্দীর অন্যতম পুরনো একটি গ্রাম। ১৩৯৭ সালে এখানে তাতারদের আগমন ঘটে। ভিতাউতাস দ্যা গ্র্রেট যুদ্ধ জয়ের পর এখানে ৪০ তাতার প্রিজনারদের স্থান দেন এবং পরবর্তীতে ফরটি তাতার্স ভিলেজ নামকরণ হয়। কথিত আছে, ভিতাউতাস দ্যা গ্রেট তাতারদের বসবাসের জন্য জমি দান করেন এবং তাদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী জীবনযাপনের সুযোগ সুবিধা দেন এমনকি তারা চার বিয়ে করারও সুযোগ পায় যাতে করে দ্রুত তাদের বংশবৃদ্ধি পায়। এখানে একটি ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে যা’ লিথুয়ানিয়ায় বর্তমানে অবশিষ্ট ৪টি মসজিদের একটি যেটি ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের সুবিধা দেয়া হয়। এখানেও একটি কবরস্থান রয়েছে। মসজিদ থেকে অনতিদুরে রাজা ভিতাউতাসের স্মরনে এবং সম্মানার্থে একটি মনুমেন্ট রয়েছে যা লিথুয়নিয়ায় তাতারদের আগমনের ৬শ’ বছর উপলক্ষ্যে তাতাররা ১৯৯৭ সালে নির্মাণ করে।
আমাদের জন্য স্থানীয় কমিউনিটি হলে আয়োজন হলো দুপুরের খাবার। তারপর আমরা তাদের মসজিদ পরিদর্শন করলাম। ফিরে আসার পথে রাজা ডিউকের প্রাসাদ ঘুরে দেখলাম। এরপর কিছু কেনাকাটা করে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম। হ্যাঁ, শুক্রবার বিকেলে আমরা হোটেলে রেষ্ট নিয়ে ওলড টাউন দেখতে বের হলাম। ভেজিটেবল পিজা খেয়েই সে রাতের ডিনার হলো। কারণ হালাল রেষ্টুরেন্টটি তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আর পরদিন শনিবার রাতের ডিনারের জন্য আমাদের সঙ্গী সাথীরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। অনেক ঘোরাঘুরি করেও কোনও সুইটেবল ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট পেলাম না। ভাতের জন্য কেউ কেউ কী যে অস্থির! অবশেষে একটি রেষ্টুরেন্ট পাওয়া গেলো যার মালিক লন্ডন থেকে গিয়ে সেখানে রেষ্টুরেন্ট চালান। আর আরেক দল তখন সেই পিজা দিয়েই ডিনার সারলেন। হয়তো তারাও আরাবিয়ান হালাল রেষ্টুরেন্টটি খোলা পাননি।
এবার ফিরে আসার পালা :
হোটেলে মুসাদ্দিক ভাই (মুসাদ্দিক আহমদ, সাবেক এডিটর, ইউরোবাংলা) ছিলেন আমার রুমমেট। আর বাকী সবাই ছিলেন অন্য একটি হোটেলে। সবার সাথে সমাপনী আড্ডা শেষে গভীররাতে হোটেলে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুমের রাজ্যে চলে গেলাম নিমিষেই। সকালে নাস্তা সেরে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ইউরোপিয়ান ব্রেকফাষ্ট, হালালের তেমন বালাই নেই। আমরা চিরাচরিত কায়দায় বাটার জাম ব্রেড, ডিম, দই, কফি ইত্যাদি দিয়ে এ পর্ব সারলাম। তারপর রুমে এসে তাড়াতাড়ি সব গোছিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। শায়খ রামাদ্বান আমাদের কাছ থেকে আগেই বিদায় নেন। এয়ারপোর্টে আবার সবাই একসাথে। প্লেনে উঠলাম এবং বিকেল প্রায় ৪টার দিকে সেই লুটন এয়ারপোর্টে ফিরে এলাম। কারপার্ক থেকে গাড়ি নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ক্যারল ভাইই ড্রাইভ করছেন। নাজির ভাই, হাবিব ভাই, জুবায়েরকে দিয়ে ক্যারল ভাইয়ের বাসায় হাজির। আসরের নামাজ শেষে তার বাসায় আপ্যায়িত হলাম। রোববার দিন প্রায় শেষ, পরদিন কাজ। বাসায় ফিরলাম। চোখেমুখে ক্লান্তির চিহ্ন। স্বপ্নের মতো যেনো তিনটি দিন চলে গেলো। তাতারদের জীবনযুদ্ধের কাহিনী জানলাম, স্বচক্ষে তাদের উত্তরসূরীদের দেখলাম, তাদের প্রতিষ্ঠিত ঘরবাড়ি, মসজিদ, কবরস্থান, সেন্টার ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ পেলাম। কমসময়ে এরচেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়! জানিনা তাদের এই সংগ্রাম, বিশ্বাসের ওপর টিকে থাকার লড়াই, কৃষ্টি কালচার ধরে রাখার অবিরাম প্রয়াস আর কতকাল চলবে! তবে দুনিয়ার সকল সংগ্রামী মানুষের মতো তাদের অসীম সাহসিকতা ও সংগ্রামের কথা আমাদের অনেক প্রেরণা যুগিয়েছে।
লেখক: আকবর হোসেন
বৃটিশ-বাংলাদেশী সাংবাদিক ও লেখক
টুইকেনহাম, ওয়েস্ট লন্ডন।