‘চ্যানেল এস স্কয়ার’ হোক বাংলা সংস্কৃতি চর্চার নতুন অধ্যায়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
মোঃ রহমত আলী :: ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা বিজয়ের মাস। ১৯৫২ সালের এই মাসে নিজ দেশে নিজ ভাষার জন্য রক্ত দিতে হয়েছিল আমাদেরকে। তাই এর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির পরম আবেগ-অনুভূতি। সুতরাং এ মাসে যেখানে ভাষার কথা আলোচিত হয়েছে সেখানেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটেছে অনায়াসেই। সে হিসেবে গত সপ্তাহে কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমি যোগদান করেছিলাম। এতে দেখতে পেয়েছি এসমস্ত অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা, গান, কবিতা আবৃত্তি এবং সর্বোপরি শহীদ মিনারে পুষপস্তক অর্পিত হয়েছে। তবে এ সকল অনুষ্ঠানে প্রসঙ্গ ক্রমে অন্য যে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে তা হচ্ছে, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল কর্তৃক কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিসকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা।
১৯ ফেব্রুয়ারি যোগ দিয়েছিলাম টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একটি বিশেষ অধিবেশনে, যেখানে বাংলা সার্ভিস বহাল থাকবে কি না এ নিয়ে যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর এর জন্য কাউন্সিলে দু’টি পিটিশন দাখিল করেছিলেন এ সার্ভিস বহাল রাখার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দু’টি কমিউনিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে যথাক্রমে অ্যালায়েন্স অব টাওয়ার হ্যামলেটস কমিউনিটি অর্গানাইজেশন্স ও বাংলাদেশী টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন্স ইউকে। সাধারণত কাউন্সিলের কোনও অধিবেশনে কাউন্সিলার ও দায়িত্বশীলরাই উপস্থিত থাকেন। কিন্তু এ অধিবেশনের একটি বিশেষ দিক ছিল সাংবাদিক ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি। সাথে সাথে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে হলের বাইরে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলে কাউন্সিলের অন্যান্য এজেন্ডার মধ্যে প্রথমেই এই বিষয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেখা গেল এ কাউন্সিলের প্রায় অর্ধেক বাঙালি কাউন্সিলারের মধ্যে মাত্র দুই বা তিন জনই এটা বহাল রাখার পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। অন্যরা হয় নীরব থেকেছেন নতুবা অনুপস্থিত থেকেছেন। এর ফলে কাউন্সিল তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী যুক্তরাজ্যের অন্যতম স্মৃতি বিজড়িত স্থান বাংলাদেশ সেন্টার এর উদ্যোগে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেন্টার ভবনের মেরামত কাজ চলার কারণে ইস্ট লন্ডনের নিডা কমিউনিটি সেন্টারের আয়োজিত এ সভায় ম্যানেজমেন্ট কমিটির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান মুহিব’র সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হাইকমিশন লন্ডনস্থ হাইকমিশনার ও পদাধিকার বলে সেন্টারের সভাপতি সাঈদা মুনা তাসনিমসহ কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ। এখানে আমার সাথে যোগ দিয়েছিলেন, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মজুমদার আলী। সেখানেও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বাজেট কাটের প্রসঙ্গটি চলে আসে। বিভিন্ন বক্তা এ ব্যাপারে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রাখেন। তবে লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম তাঁর বক্তব্যে এ ব্যাপারে একটি বিকল্প প্রস্তাব এর কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন, যদি কাউন্সিল রাজি হয় তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ফান্ড সরবরাহ করা যেতে পারে।
এ অনুষ্ঠান থেকে সরাসরি যোগদান করি আলতাব আলী পার্কে যেখানে শহীদ দিবসের মূল কর্মসূচি পালন করা হয়। সেখানে ১২টা ১মিনিটের সময় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষপস্তক অর্পণের মধ্য দিয়ে এ দিনের মূল কার্যক্রম শুরু হয় এবং তারপর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তাতে যোগ দেয়। শ্রদ্ধা নিবেদন কার্যক্রমের এক পর্যায়ে দেখা হলো পপলার ও লাইম হাউজ আসনের নব নির্বাচিত এমপি আপসানা বেগমের সাথে। দেখলাম খুবই তৎপর এ কর্মসূচিতে যোগদান করা উপলক্ষে। কিন্তু তাঁর সাথে অন্যান্য কয়েকজনকে দেখতে পেলেও স্থানীয় অন্য কোন এমপিকে সেখানে দেখতে পেলাম না, যদিও বাঙালি ছাড়া অনেক অবাঙালি জনপ্রতিনিধিকে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখেছি।
একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ‘চ্যানেল এস’ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। হেড অব প্রোগ্রাম ফারহান মাসুদ খানের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ‘একুশ আমার অহংকার’ নামে এ অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে হেড অব নিউজ কামাল মেহেদির উপস্থাপনায় অংশগ্রহণকারী অতিথিদের লাইভ ইন্টারভিউ এর সময় আমিও অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাই। চ্যানেল এর প্রতিষ্ঠাতা মাহি ফেরদৌস জলিলের উপস্থাপনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেন কমিউনিটির বিভিন্নস্তরের নেতৃবৃন্দ। সেখানে ঘুরে ফিরে আবারও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল কর্তৃক বাংলা ভাষা নির্বাসনে পাঠানোর প্রসঙ্গটি চলে আসে। কারণ সেখানেও অন্যান্য আলোচকদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের এক কাউন্সিলার যিনি কাউন্সিল অধিবেশনে মেয়রের প্রস্তাবকে সমর্থনকারীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। আলোচকবৃন্দ তাদের মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন। এক পর্যায়ে দেখলাম যে, কেউ কেউ এটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যা ছিল অনেকটা “উদোর পিন্ডি বুদুর ঘাড়ে” চাপানোর মত। অর্থাৎ তারা বলছেন, শুধু টাওয়ার হ্যামলেটসে কেন এ সার্ভিসের কথা বলা হচ্ছে, অন্যান্য কাউন্সিলে কেন এটা অর্ন্তভুক্ত করার দাবি করা হচ্ছে না।
তখন আমি আর নীরব থাকতে পারলাম না। উপস্থাপক আমাকে সুযোগ দিলে অনেকটা আবেগতাড়িত হতে গিয়ে কিছুটা বলতে পারলেও যা বলতে পারি নাই তা হল- বাংলা চর্চা বা বাংলা সংস্কৃতি রক্ষার জন্য অন্য কোনও কাউন্সিলকে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাথে তুলনা করা বা টেক্কা মারা ঠিক হবে না। কারণ এখানে রয়েছে বাংলা ভাষাভাষি এক বিপুল জনগোষ্ঠী যারা এ কাউন্সিলে কন্ট্রিবিউট করছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রয়েছে তাদের ব্যাপক অবদান। শুধু এমপি, মেয়র, স্পিকার বা কাউন্সিলার নয় এখানে লেখাপড়া করছে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী। এখানে রয়েছে কবি নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও ওসমানী স্কুল। রয়েছে বাংলা টাউন, আলতাব আলী পার্ক, শহীদ মিনার ও বিভিন্ন রাস্তার বাংলা সাইন। অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা। পালন করা হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস। সুতরাং এখানে যদি বাংলা চর্চার নির্বাসন ঘটিয়ে অন্যখানে চালু করার দাবি তোলার কথা বলা হয় তা হলে তা বুঝতে হবে এটার মধ্যে বিরাট দুরভিসন্ধি রয়েছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সেক্রেটারি কামরান বাসিত চৌধুরী এর পক্ষে তাঁর বক্তব্য রাখেন। প্যানেল মেম্বার সাবেক কাউন্সিলার ও ডেপুটি লিডার রাজন উদ্দিন জালাল তাঁর বক্তব্যে বর্তমান কাউন্সিলার ও সে সময়ের বাঙালি কাউন্সিলরদের ভূমিকার তারতম্যের কথা তুলে ধরেন। সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদক নবাব উদ্দিন ভাইও সেই সময়ের কাউন্সিলারদের তেজদিপ্ততা এবং বর্তমান কাউন্সিলারদের নির্লিপ্ততার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কবি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহও এ ব্যাপারে তার মতামত তুলে ধরেন। তা ছাড়া কয়েকজন মহিলাও এ সময় দর্শক গ্যালারি থেকে তাদের নিজেদের অনুভূতির কথা জানান। তবে চ্যানেল এস বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি রক্ষায় যে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে তার জন্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন, কমিউনিটি নেতা নুরুল ইসলাম, কবি ছড়াকার দিলু নাসের, লেখক গবেষক ফারুক আহমদসহ সবাই প্রশংসা করেন। এ ব্যাপারে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক চ্যানেল এস-এর ফাউন্ডার মাহি ফেরদৌস জলিল তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, তিনি যে কোনো সময় চ্যানেল এস কার্যালয়ে বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে প্রস্তুত আছেন। যদি কেউ আগ্রহী থাকেন তবে যোগাযোগের পরের দিন থেকেই তিনি এ কার্যক্রম চালু করতে পারেন। উল্লেখ্য, সম্প্রতি চ্যানেল এস টেলিভিশন কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘চ্যানেল এস স্কয়ার’। এতে স্থান পেয়েছে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা। এই স্কয়ার এদেশের নতুন প্রজন্মের জন্য বাংলা সংস্কৃতি চর্চার এক নতুন অধ্যায় হবে বলে মনে করি। যারাই চ্যানেল এস কার্যালয়ে আসেন, প্রত্যেকেই একবার যেন ঘুরে দেখেন এ নান্দনিক স্কয়ার।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, লন্ডন।