বৃটিশ নাগরিকত্ব: ইইউ ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশের অভিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে এত বৈষম্য কেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
রাজু আহমদ:
আইন সকলের জন্য সমান। অনেকটা খোলা আকাশের নিচে স্বাধীনভাবে বসবাসের মতোই। তবে দুর্বল ও অসহায় মানুষের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই এই আইন মাকড়সার জালের মতো। এ দুটো কথার সাথে যুক্তরাজ্যে অনিয়মিতভাবে বসবাসকারী অভিবাসীদের জীবনের বিরাট একটা মিল রয়েছে। কারণ তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসীদের জন্য আইনের সব রাস্তাই খোলা। চলতি বছরের ২৯ মার্চ ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ ব্রেক্সিট হয়ে যাওয়ার কথা। যদি ব্রেক্সিট হয়ে যায়, তাহলে যে সকল ইইউ নাগরিক যুক্তরাজ্যে পাঁচ বছরের কম সময় ধরে বসবাস করছেন তাদের এ দেশ ছাড়ার কথা। অথচ ইতিমধ্যে বিশেষ আইন করে তাদের জন্য আরও দুই বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। যাতে তারা ভবিষ্যতে সহজে ব্রিটিশ নাগরিক হতে পারে। মাত্র ক’বছর যুক্তরাজ্যে বসবাস করে নানা বেনিফিট সুবিধা নিয়ে, কোনো প্রকার ফি না দিয়ে, ইংলিশ ভাষাগত যোগ্যতা ছাড়াই তারা যুক্তরাজ্যের নাগরিক হয়ে যেতে পারেন। অপরদিকে বৈধভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করে নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অবৈধ হয়েপড়া কমনওয়েলথভুক্ত দেশের নাগরিক বৈধ হতে পারে না। তাঁদের অনেকেই দশ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। ইংলিশ ভাষাগত যোগ্যতাও তাঁদের আছে। সরকার থেকে কোনো ধরনের বেনিফিট গ্রহণ করছেনা। বসবাসের বৈধতা পেলে ট্যাক্স দিতে রাজি আছে। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশসহ কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের অভিবাসীরা অবহেলিত থেকে যায়। নাগরিকত্ব না পেয়ে অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে বসবাস করে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। কারণ তারা দুর্বল ও অসহায়। তাই তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নাই। এই ক্ষেত্রে মানবাধিকার বা সমঅধিকার তাদের বেলায় উপেক্ষিত।
অথচ একটি বিষয় এখানে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধস্থ যুক্তরাজ্য পুনর্গঠনে বাংলাদেশিসহ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। আশাকরি এখন তাদের মূল্যায়নের সময় এসেছে। যখনই অবৈধ অভিবাসীদের সাহায্য করার কথা উঠে, তখনই নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যায় বৃটিশ সরকার। অভিবাসী কমাতে নিত্যনতুন আইন করা হয়। অথচ তাঁদেরকে এদেশে বৈধতা দিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা করা হয়না। কমিউনিটিতে নানা ইস্যু আছে কিন্তু ওইদিকে তেমন দৃষ্টিপাত না করে অবৈধ অভিবাসী তাড়াতেই সরকার বেশি ব্যস্ত।
যুক্তরাজ্যে প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালি বসবাস করেন। এখানে তিনজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রয়েছেন। রুশনারা আলী, রুপা হক এবং টিউলিপ সিদ্দিক। তিনজন এমপি থাকার পরও কেউই তেমন অসহায় মানুষের পক্ষে কথা বলেন না।
অথচ সম্প্রতি উইন্ডরাশ ট্রাজেটির ব্যাপারে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ছায়া হোম সেক্রেটারি ডায়ান অ্যাবোট এমপি, ডেভিড ল্যামী এমপিসহ অন্যান্য আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এমপি ও তাদের কমিউনিটির সোচ্চার ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। যার ফলে এটি সফলতার মুখ দেখেছে।
যুক্তরাজ্যে দশ বছরের বেশি সময় ধরে যারা অবৈধ বা অনিয়মিতভাবে বসবাস করছেন তাদের নিয়মিত করার দাবিটি সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন দীর্ঘদিন সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আমাদের বাঙালি এমপিদের বেলায় এই দাবীর পক্ষে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। আমাদের বাঙালি এমপি ও কমিউনিটি যদি এই ইস্যুতে সোচ্চার হতেন তাহলে এই ব্যাপারে সফলতা অর্জন খুব কঠিন ছিলো না। তারা কেন ভুলে যাচ্ছেন এই অসহায় মানুষগুলোও মানুষ। এরা পরিস্থিতির শিকার। তারা কারও সন্তান, কারও ভাই বোন, কারও স্বামী, বাবা। তাদের উপর তাদের অনেকের পরিবার নির্ভরশীল। তাঁরা বৈধতা পেলে যেমন নিজে উপকৃত হবে তেমনি যুক্তরাজ্যেরও লাভ হবে। কারণ যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন সেক্টরে বর্তমানে দক্ষ জনবলের তীব্র অভাব রয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ট্যাক্সও বাড়বে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে দশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসকল অভিবাসী অনিয়মিতভাবে বসবাস করছেন তাদের বৈধতা দেওয়ার দাবিতে একটি পিটিশনে প্রায় ৫০ হাজার লোক স্বাক্ষর করেছেন। তাছাড়া একই দাবিতে আরেকটি পিটিশনে স্বাক্ষর পড়েছে লক্ষাধিক। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এটি একটি জনগুরুত্বপূর্ণ দাবি। এই বিষয়ে জনসমর্থন রয়েছে। তাই আসুন, আমরা অসহায় মানুষগুলোকে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে নিজের ঘর থেকেই মানবতার সেবা শুরু করি। কারণ রোহিঙ্গা ও অন্যান্য শরণার্থীর মতো এরাও বড় অসহায়। তাই ঘরের মানুষ হিসেবে এরা মানবিক সাহায্য পাওয়ার প্রথম দাবিদার।
তাই আশা করছি, তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ এমপি রুশনারা আলী, রূপা হক এবং টিউলিপ সিদ্দিকসহ কমিউনিটির সকলে এ ব্যাপারে দ্রুত এগিয়ে আসবেন।
আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে, একই প্লাটফর্মে থেকে যুক্তরাজ্যে দশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও অন্যান্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশের যেসকল অভিবাসী অনিয়মিতভাবে বসবাস করছেন তাদেরকে নিয়মিত করার দাবিতে সোচ্চার হই। রাজু আহমদ : বার্মিংহ্যাম প্রতিনিধি, বাংলা কাগজ, বার্মিংহ্যাম, যুক্তরাজ্য ।