সহপাঠী শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী স্মরণে কিছু কথা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
মোঃ রহমত আলী:
১৯৬৯ সালে আমি আমার স্থানীয় দশঘর এনইউ জুনিয়র হাইস্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৭০ সালে জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হই। তখন যে ক’জন সহপাঠী আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, সদ্য প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী। অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন আকমল হোসেন (জগন্নাথপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান) যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী সাজিদ আলী মেনন, আমিনুর রহমান খান (যুক্তরাজ্যে উদীচী ও সত্যেন সেন স্কুলের সাথে জড়িত) ও আনোয়ার খান। তাদের সবার মধ্যে পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন কুদ্দুছ চৌধুরী। আমরা সহপাঠীরা তাঁকে নিয়ে গর্ব করতাম। এ সময়ের আরো একজনকে নিয়ে আমরা এখনও গর্ব করি তিনি হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আব্দুল হান্নান। তিনি এ স্কুল থেকে সে সময় কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধিনে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম ২০ জনের মধ্যে স্থানলাভ করে নিয়েছিলেন।
কুদ্দুছ চৌধুরী এসএসসি পাশ করার পর সিলেটের মদন মোহন কলেজ থেকে বিকম ও ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স করেন। এরপর গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা-দক্ষিণ ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার চাকরি জীবন শুরু। কয়েক বছর শিক্ষকতার পর ১৯৮৬ ইংরেজীতে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। এখানে আসার পরও তিনি তার শিক্ষকতা পেশা ধরে রাখেন। পিজিসিই করার পর এ শিক্ষকতা পেশাটি পাকাপোক্ত করেন। বেথনাল গ্রীণ টেকনোলজি কলেজ ও ডেনফোর্ড স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। সংযুক্ত থাকেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মাদার টাং সেকশনেও। এভাবেই তিনি তার জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হন। অবশেষে ৬৩ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি সম্প্রতি না ফেরার দেশে চলে যান। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)। তার দেশের বাড়ি ছিল সিলেটের বিশ¡নাথ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নের কচরাকেলী গ্রামে। তবে অনেকে তাকে জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী গ্রামের বলেই জানতেন।
আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার মৃত্যুর পর ইস্ট লন্ডন মসজিদে তার নামাজে জানাজায় মানুষের উপস্থিতি দেখে। এ সময় শেষবারের মতো তাকে একনজর দেখার জন্য দীর্ঘ সময় লাইন ধরে লোকজনকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। তা এত দীর্ঘ ছিল যে অনেকে সে সময় অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তবুও তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন অশ্রুসজল নয়নে। তার সহকর্মী ছাড়াও কমিউনিটির বিভিন্নস্তরের মানুষ এতে অংশ নেন। আক্ষেপ করেন তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে। এ সময় কেউ কেউ আবেগজড়িত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আমি নিজেও তার লাশ দেখে কান্না ধরে রাখতে পারিনি। চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায় আর স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে অনেক কিছু। আমি তখন মহান আল্লাহতালার কাছে তার যেন বেহেস্ত নসীব হয় এ কামনা করি।
প্রিয় সহপাঠী আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরীর অরেক নাম ছিল ‘নানু মিয়া’। বিশেষ করে দেশে অনেকেই তাকে এ নামে সম্বোধন করতেন। এমনকি এদেশেও তাঁর নিজ এলাকার লোকজনের কাছে এ নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি। তার বড় ভাইয়ের ডাক নাম ছিল ‘উনু মিয়া‘ ছোট এক ভাইয়ের নাম হলো ‘ছানু মিয়া‘। যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ সভাপতি আব্দুল হামিদ চৌধুরী তাঁর আপন ছোট ভাই। তার চাচা মরহুম আব্দুল মতিন চৌধুরী ছিলেন এদেশের বাঙালি কমিউনিটির অগ্রজ নেতা। আমাদের কমিউনিটির অনেকেই সে সময় তাঁর সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। একজন সহপাঠী হিসাবে আমার নিকট তাঁর স্মৃতিচারণ কেমন হতে পারে তা বোধ হয় লিখে বুঝানোর প্রয়োজন নয়। অনেক সময় তা আপন ভাইয়ের চাইতেও কাছাকাছি হয়ে যায়। তবে হাই স্কুলে লেখাপড়ার পর কলেজে লেখাপড়ার সময় আমি বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জনতা পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়ি কিন্তু তিনি রীতিমত পাঠ্য বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে কৃতীত্বের সাথে ফলাফল করেন। তাঁর চরিত্রের একটা বিশেষ গুণ ছিলো স্পষ্টবাদিতা। যে কোন বিষয়েই তার অবস্থান ছিল পরিস্কার।
লেখাপড়ার পর শিক্ষকতায় থাকাকালীন তার সাথে আমার তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। তবে লন্ডনে আসার পর আমার সাথে তার যোগাযোগ হলে আমাকে তার ঘরে আমন্ত্রণ জানান। তখন তিনি ইস্ট লন্ডনের ভেলেন্স রোডের কাছে একটি বিলডিংয়ে বসবাস করতেন। এরপর থেকে প্রায়ই সাক্ষাৎ হতো। আমি এক সময় সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকায় চাকরি নিলাম। সে সময় এদেশে বসাবাসের জন্য আমার স্থায়ী পারমিশন লাভের জন্য অন্যদের মতো একটি রেফারেন্স লেটার তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, টিচার্স এসোসিয়েশনসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের দায়িত্ব পালনকালে তাঁর নিজের পাবলিসিটির জন্য কোনও সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য আমাকে কোনও সময়ই অনুরোধ করেননি। বরং সাংবাদিকতার আদর্শবাণী বা নীতিবাক্য শুনিয়েছেন অনেকদিন। আর যখনই দেখা হতো তখনই প্রথমেই বলতেন ‘কিতাবা সাংবাদিক খবর কিতা’।
আমাদের এক সহপাঠীর নাম ছিল ‘কলমধর আলী’। তাঁর বাড়ি ছিল বিশ¡নাথের দৌলতপুর ইউনিয়নের ছত্তিশ গ্রামে। তাঁর কথা সবসময় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন। কিছু আর্থিক সহযোগিতাও আমার মাধ্যমে তাঁকে করেছিলেন। তা ছাড়া অন্য এক সহপাঠী সুশেন রঞ্জন দাসসহ অন্যান্যের অবস্থান জানার জন্য আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন।
গত বছর আমি যখন ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ বই লিখতে শুরু করি তখন শ্রীরামীশিতে পাক বাহিনীর নারকীয় তান্ডবের স্মৃতিচারণমূলক বর্ণনা আমার অন্যান্য সহপাঠীদের মতো তাঁর কাছ থেকেও নিই। এটা আমার বইতে লিপিবদ্ধ আছে। আর এটাই ছিল তাঁর সাথে আমার টেলিফোন আলাপের সর্বশেষ সংযোগ।
এরপর ২০১৮ সালের মধ্যভাগে আমি যখন সে বই প্রকাশনা অনুষ্ঠান করি তখন তাঁকে অনেকবার ফোন করে না পেয়ে মনে মনে বিরক্ত হয়েছিলাম। সাথে সাথে এটাও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আর কোনওদিন ফোন করবো না বা তাঁর সাথে কথাও বলবো না। তখন আমি জানতাম না যে, তিনি এ সময় মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে রয়েছেন। অবশেষে তিনি আমার অভিমানকে ভুল প্রমানিত করে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন, যে খবর আমি কোনো একজনের মোবাইল ম্যাসেজের মাধ্যমে পাই। এমতাবস্থায় আমি তাঁকে আর সে লেখাটি দেখাতে পারলাম না। আমার এ অপেক্ষাপটা রয়েই গেলো।
রহমত আলী : সাংবাদিক লেখক (সম্পাদক- মাসিক দর্পন ম্যাগাজিন)।