তুরস্কে জীবন যেমন (শেষ পর্ব)
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ডিসেম্বর ২০১৮
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ড. এম এ আজিজ:
সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদ: তুরস্কের সবচেয়ে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ মসজিদ হচ্ছে সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদ। এই মসজিদ ১৬০৯ হতে ১৬১৬ সালের মধ্যে তৈরি করা হয়। সুলতানের বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর ছিল। মসজিদের সুউঁচ্চ গম্বুজের উচ্চতা ১৪১ ফুট এবং ৬টি মিনারেট যার প্রতিটির উচ্চতা ২১০ ফুট। এই মসজিদের আভ্যন্তরিন কারুকার্য্য নীল রঙের এবং কয়েক হাজার মার্বেল নীল রঙের হওয়াতে ব্লু মসজিদ নামেও প্রসিদ্ধ। বিশাল মসজিদে অভ্যন্তরিন গম্ভুজ ও দেয়ালে কুরআনের আয়াতসম্বলিত কারুকার্য দেখার মত একটি ঐতিহাসিক স্থান। হাজার হাজার মুসলিম ও অমুসলিম পুরুষ মহিলা লাইন ধরে মসজিদে একদিকে প্রবেশ করছে এবং অন্যদিক দিয়ে বের হচ্ছে। প্রত্যেককে জুতো রাখার জন্যে প্লাস্টিকের বেগ সরবরাহ করা হচ্ছে। মহিলাদেরকে হিজাব পরে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। তাই তাদেরকে ফ্রি স্কার্ফ দেয়া হচ্ছে। অজুর জায়গা ও টয়লেট অত্যন্ত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও রুচি সম্মত।
এখানে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের হিসাব মতে তুরস্কে অতীতের প্রায় ৮২ হাজারের বেশি মসজিদ রয়েছে, তন্মধ্যে তিন হাজারেরও বেশি মসজিদ রয়েছে শুধু ইস্তাম্বুল শহরেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ১৫ বছর শাসনামলে আরও দশ হাজার নুতন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। একটি মসজিদ উদ্বোধনকালে প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, যে মসজিদ সমাজের তথা এলাকার মানুষের কোনও সামাজিক কাজে আসেনা সেই মসজিদ তৈরির স্বার্থকতা নাই। অর্থাৎ নবী কারীম (সাঃ) এই মসজিদের মাধ্যমেই সামাজের তথা দেশের সকল কাজকর্র পরিচালনা করতেন। সকলের সুখ দুঃখের কথা, সমস্যার কথা শুনতেন ও সমাধান করতেন। সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম মসজিদে নববী থেকেই পরিচালনা করতেন।
আয়া সুফিয়া মসজিদ বা হাজী সুফিয়া চার্চ : বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শাসনামলে এটি একটি ষষ্ঠ শতাব্দির গ্রীক অর্থডক্সদের প্রসিদ্ধ চার্চ ছিল। এই চার্চ ৫৩৭ খ্রীস্টাব্দে তৈরি করা হয়। এটি ডিজাইন কাজ ও উঁচু গম্ভুজের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। মুসলিমদের ইস্তাম্বুল জয়ের পর এটাকে মসজিদ তথা নামাজের স্থানে পরিবর্তন করা হয়। যেভাবে আজ পশ্চিমা দেশগুলোতে শত শত চার্চকে ক্রয় করে মসজিদে রুপান্তরিত করা হচ্ছে। এই চার্চ বা মসজিদের অনতিদূরেই সুলতান আহমেদ মসজিদ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে কামাল পাশার শাসনামলে এই মসজিদকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করে পশ্চিমা প্রভুদেরকে খুশী করে ধর্ম নিরেপক্ষ রাস্ট্রের ব্যর্থ প্রমান দেয়ার চেস্টা করা হয়। ইতোমধ্যেই এখানে আবার নামাজ পড়া শুরু হয়েছে। অর্থাৎ মসজিদ হিসাবে চালু হয়েছে। যেখানে আবার স্রস্টার প্রার্থনা চলে। তোপাক (রাসুলে কারীম (সাঃ) ও পরিবারের ব্যবহৃত কিছু আলামত ও ব্যবহৃত জিনিষপত্র) : এটাকে একটি মিউজিয়াম বলা চলে। যেখানে নবী কারীম (সাঃ) এর পায়ের চি? ও ব্যবহৃত কিছু জিনিস এবং বিভিন্ন সাহাবীর (রাঃ) ব্যবহৃত তলোয়ার, সেই যুগের যুদ্ধে ব্যবহৃত বল্লম, ঢাল ও চাকু সংরক্ষিত আছে। হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও হযরত হোসাইন (রাঃ) এর একটি জামা সংরক্ষিত আছে। আমার মনে হয় পৃথিবীর আর কোথাও এই জাতিয় ঐতিহাসিক জিনিষ সংরক্ষিত পাওয়া মুশকিল। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের সুবিশাল তলোয়ারসহ আরো ক’জন সাহাবীর তলোয়ার সেখানে শোভা পাচ্ছে। পাশেই তুরস্কের সুলতানদের যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্রের বিভিন্ন জিনিষপত্র রাখা হয়েছে। যা অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর (রাঃ) কবর: হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) যিনি তুরস্কে সুলতান আইয়ূব বলেই খ্যাত। তিনি হলেন সেই সাহাবী, নবী কারীম (সাঃ) হিজরত করে মদীনা বা ইয়াস্রিব শহরে তাঁর ঘরেই প্রথম উঠেছিলেন। বার্ধক্য বয়সে রাসুলের (সাঃ) হাদীসের ভবিষ্যত বানী অনুযায়ী বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে কনস্টানটিনপল জয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে শহরে পৌঁছার পূর্বেই ইন্তেকাল করেন। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী সেখানে কবর দেয়া হয়। আজ সেই শহরে তথা সমগ্র তুরস্কে শতভাগ মানুষ মুসলমান। আল্লাহ পাক তাঁদের ত্যাগ ও দোয়ার ফল এভাবেই প্রতিফলিত করেছেন। আবু আইয়ুব আনসারীর কবরটি একটি সুবিশাল কমপ্লেক্স। হাজার হাজার মুসলমান একদিক দিয়ে ঢুকে জিয়ারত করে অন্যদিকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কোনো চিৎকার, কান্নাকাটি, গান বাজনা- কিছুই নেই, যা কোনও কোনও মুসলিম দেশে সচরাচর দেখা যায়। যা কোনও কোনও পর্যায় শিরকের পর্যায় পড়ে অথচ আল্লাহর ওলীগণ নাবী-রাসুলদের পথ অনুসরণ করে পৃথিবী হতে শিরক দূর করার জন্যেই নিজের জন্মভূমি ছেড়ে দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আমরা জিয়ারত করে অন্যদিকে বেরিয়ে পড়লাম।
প্যানোরামা: এই জায়গাটি আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে সর্বশ্রেনীর ও সব বয়সের মানুষের তুরস্ক সাম্রাজ্যে সুলতানদের ছবি ও স্মৃতি বিভিন্ন জায়গায় ওয়ালের সাথে লাগানো আছে। সর্বশেষ একটু উপরে গিয়ে একটি ঘরের মধ্যে আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে মনে হয় সত্যিকার উচুঁ আকাশের চন্দ্র তারকা ও সেই যুগে অমুসলিমদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখানো হয় যা দেখে সবাই আসল যুদ্ধ মনে করে ভয়াবহ যুদ্ধ ও পরিস্থিতি দেখে কিছুটা ভয় ও কিছুটা আনন্দ উপভোগ করে। অনেকেই আশ্চর্য হয় কিভাবে এমন দৃশ্য বানানো হয়েছে। এটি দেখার মত একটি দৃশ্য যা বাচ্চারা বেশি আনন্দ পায়। গ্রান্ড বাজার: যেখানে একবার না গেলে যেনো তুরস্ক ভ্রমণটাই নিরর্থক হয়ে যায়। সুলতান মসজিদের নিকটেই এর অবস্থান। যা ইস্তাম্বুল ও তুরস্কের প্রসিদ্ধ “গ্রান্ড বাজার” নামে প্রসিদ্ধ। যেখানে সব রকমের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট স্যুটকেস ভরে ক্রয় করছে। তবে এখানে মনে হলো দরাদরি করেই ক্রয় করতে হয়। একমূল্যের দোকানও দেখলাম।
বসপরাস ক্রুইজ: বসপরাস ক্রজ নামে একটি স্থান থেকে জাহাজে করে একঘণ্টায় বসপরাস প্রণালীতে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রণালীর দুপাশের গড়েউঠা বাড়িঘর, মসজিদ ও পাহাড়ের সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই উপভোগ্য। এছাড়া অনেক বড় বড় ট্যাংকার ও মালবাহী যুদ্ধ জাহাজও এই প্রণালী দিয়ে চলে। কারণ এই প্রণালী দুটো সাগরকে (কৃষ্ণ সাগর ও মারমারা) সংযুক্ত করেছে। এই প্রণালী এশিয়া ও ইউরোপের মাঝখানে সীমানাও বটে। অর্থাৎ এক অংশে ইউরোপ ও অন্য অংশে এশিয়া। ইস্তাম্বুলের মাঝ খান দিয়ে মারমারা সাগর হতে কৃষ্ণ সাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে। ইস্তাম্বুলের বড় দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি দেশটির ইউরোপ অংশে এবং অন্যটি এশিয়া অংশে অবস্থিত। ইউরোপ অংশে চালু হওয়া বিমানবন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর। গত অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ এটি চালু হয়েছে। এয়ারপোর্টটি সম্পুর্ণভাবে চালু হলে বছরে ২শ মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। যেখানে কাজ করবে ১ লাখ ২০ হাজার লোক।
বসপরাস প্রণালীর এপার-ওপার ঝুলন্ত ব্রীজের মাধ্যমে সংযোগ:
ইস্তাম্বুল শহর ঘুরে দেখার জন্যে ট্যুর বাস রয়েছে এবং ২ ঘন্টার জন্য জনপ্রতি ৩০-৪০ ইউরো চার্জ করে। ইস্তাম্বুল শহর অনেকটা আমাদের লন্ডনের মত। লন্ডন সিটি টেমস নদীর মাধ্যমে দুই ভাগে বিভক্ত। এবং দুই দিকের সাথে ফেরি ও ৩টি ঝুলন্ত ব্রীজ ও সদ্য করা সুড়ঙ্গ পথে যাতায়াত করতে হয়। পার্থক্য হচ্ছে বসপরাস একটি প্রাকৃতিক প্রণালী যেখানে বড় বড় জাহাজগুলো যাতায়াত করে। আর এ কারণে ওই প্রণালীর উপর দিয়ে ঝুলন্ত ব্রীজ অর্থাৎ দুপাশে উঁচু পিলার এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। মাঝখানে কোনও পিলার রাখা হয়নি। খুবই উঁচু করা হয়েছে। যাতে যে কোনও জাহাজ চলাচলে বিঘœ সৃস্টি না হয়। এই ব্রীজটি পৃথিবীর প্রশস্ত ব্রীজ বলে দাবী করা হয়। যাতে ১০টি লাইনে গাড়ী চলে।
শেষ কথা:
তুরস্কবাসীর প্রায় সকলের মধ্যেই স্বচ্ছলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সবাই কাজে ব্যস্ত। ৮ কোটি স্থানীয় অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৪ কোটিই পর্যটক। তাই ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে তুরস্কবাসী অসম্ভব ব্যস্ত। তুরস্কবাসীর ব্যবহার অমায়িক। ইংরেজী জানেনা তবুও চেষ্টা করে ভিন্নভাষী পর্যটকদের সাহায্য করার জন্য। যত ব্যস্ত থাকুক যদি আপনি কোনো বিষয় জানতে চান, নিজের সবকিছু ফেলে রেখে যথাসাধ্য সাহায্য করবেই। আমি যা পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম তার চাইতে কোনদিক দিয়ে কমতি ছিলনা। আরও থাকতে মন ছেয়েছিল কিন্তু টিকেট পরিবর্তন করা যাবেনা তাই লন্ডনের পথে রওয়ানা দিলাম। (সমাপ্ত)