মনোয়ার বদরুদ্দোজাকে যেমন দেখেছি
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ ডিসেম্বর ২০১৮
এমজি কিবরিয়া:
মনোয়ার ভাইয়ের সাথে পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তাঁর সুচিন্তিত মতামত, মানবাধিকার ও ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালেখির গুণমুগ্ধ পাঠক এবং এক পর্যায়ে ভক্ত হয়ে যাই নিজের অজান্তে। তাঁর চিন্তাধারা ও চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ছিলো তাঁর গভীর টান। এছাড়া ইসলাম ও মানবতার সেবায় উৎসর্গীত একজন ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। বুঝতে পারছিলাম, আন্তর্জাতিক মানের একজন নেতৃস্থানীয় মানবাধিকারকর্মীও ছিলেন মনোয়ার ভাই। তাঁকে প্রায়ই ইউরোপ ও বিভিন্ন দেশে সফরে যেতে দেখেছি, বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য রাখতে দেখেছি। তাঁর লেখনীতে বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিস্তিন, আরাকান, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে তীব্র প্রতিবাদ দেখেছি। যুক্তিসঙ্গত চিন্তা ভাবনার সাথে অনেক বিষয়ে মতের মিল পেয়ে ভালো লেগেছে। এসব কারণে তাঁর সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হতে আগ্রহ তৈরি হয়। তবে কিছুটা সংকোচ বশতঃ আর ব্যস্ততার কারণে কখনো আগ বাড়িয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। কিন্তু বছর দুয়েক আগে তিনি নিজেই আমাদের পরিচয় পর্বকে সহজ করে দিলেন। ২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে নর্থ ইংল্যান্ডের ওলডহ্যামে প্রবাস বাংলা টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। সম্ভবত ফেসবুকে ওই অনুষ্ঠানের ছবি দেখে মনোয়ার ভাই ম্যাসেঞ্জারে আমাকে একটি বার্তা পাঠালেন। মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে তাঁর একটি সাক্ষাত আয়োজনের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলেন। তাঁর অনুরোধ অনুযায়ী যথাসাধ্য সহযোগিতা করলাম। সেই থেকে তাঁর সাথে একটু আধটু অনলাইনে যোগাযোগ।
সাহস করে জানতে চাইলাম কি অসুখ হয়েছে? রোগের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তবে এও বললেন যে, তার এই অবস্থায়ও তিনি স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ আছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই অসুস্থতা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য এক বিরাট উপহার
গত এপ্রিলের হলিডেতে তুরস্কে ও সৌদি আরবে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য সফরে বের হলাম। তুরস্কে যাওয়ার আগে এ ব্যাপারে মনোয়ার ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করলে ভালো হয় মনে করে তার নাম্বার চাইলাম। কারণ তুরস্ক সফরের তাঁর ভালো অভিজ্ঞতা আছে জানতাম। তিনি তার নাম্বার দিলেন কিন্তু তুরস্কে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তাকে ফোন করার সময় হলো না। তবুও আমি ইস্তাম্বুলে অবস্থানকালে ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি সেখানে খাওয়া দাওয়া সংক্রান্ত মূল্যবান পরামর্শ দিলেন আমাকে। তাঁর প্রতি শোকরিয়া আদায় করলাম ও মনে মনে তাঁর দায়িত্ব বোধের প্রশংসা করলাম।
সৌদিতে পৌঁছে ওমরাহ পালনকালে মনোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে বারবার মেসেজ এবং পরে ফোনে অনুরোধ পেলাম তার জন্য যেনো বেশি বেশি দোয়া করি। দোয়া আরো অনেকেই চেয়েছিলেন কিন্তু মনোয়ার ভাইয়ের মতো এতো আকুতি কারো মাঝে দেখিনি। একটু অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করিনি দোয়া চাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ ছিলো কি-না? পবিত্র কাবা ঘরের সামনে গিয়ে তাঁর নাম ধরে দোয়া করেছি তার সার্বিক কল্যাণের জন্য। গত সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে চোখ রাখতেই দেখলাম মনোয়ার ভাই অসুস্থ। লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটির কিছু বিশিষ্টজন তাঁকে দেখতে তাঁর বাসায় গেছেন। তাঁর রোগমুক্তির জন্য সকলের দোয়া চেয়েছেন। তবে তাঁর ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্ট দেখে অবাক হলাম, এই অসুস্থতার মাঝেও মানবতার জন্য লখালেখি চলছে দেখে। তাই ভাবলাম হয়তো তেমন সিরিয়াস কিছু না। তবুও কি মনে করে এক রাতে তাঁকে ফোন করলাম। আমার ফোন পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। কথা বলছিলেন ঘন ঘন দম নিয়ে আর বারবার দোয়া চাচ্ছিলেন। বললেন, ‘মনে আছে আপনার কাছে বিশেষ দোয়ার অনুরোধ করেছিলাম? -এই হলো কারণ।’ সাহস করে জানতে চাইলাম কি অসুখ হয়েছে? রোগের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তবে এও বললেন যে, তার এই অবস্থায়ও তিনি স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ আছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই অসুস্থতা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য এক বিরাট উপহার। তার ঈমানী শক্তি দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।
তারপর থেকে সময় সুযোগ বের করার চেষ্টা করছিলাম তাঁকে এসে দেখে যাওয়ার জন্য। যেহেতু লন্ডন থেকে অনেক দূরের শহর লিডসে থাকি এবং স্কুলে কাজ করি, তাই টার্ম টাইমে হুট করে আসা সম্ভব হচ্ছিলো না। যাইহোক, অক্টোবরের স্কুল হলিডেতে লন্ডনে এসে মনোয়ার ভাইকে দেখতে গেলাম তাঁর ফ্ল্যাটে বদরুজজামান ভাইয়ের সাথে। এতো অসুস্থতার মাঝেও হাসিমুখে স্বাগত জানালেন। উষ্ণ আলিঙ্গগনে বুুকে জড়িয়ে ধরলেন আপন ভাইয়ের মতো। কথা বলতে গিয়ে ঘন ঘন কাশিতে তাঁর রুগ্ন দেহ বারবার কেঁপে উঠছিলো। তবুও কষ্ট করে দেশ বিদেশ, মানবাধিকার, ধর্মীয় বিষয়াদি ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বললেন। বিদায় নিয়ে আসার সময় বারবার দোয়া চাইলেন।
আমি লিডসে ফেরার পর থেকে বদরুজ্জামান ভাইয়ের কাছে থেকে সব সময় মনোয়ার ভাইয়ের খবরাখবর পাচ্ছিলাম। সপ্তাহ দুয়েক আগে হঠাৎ জানতে পারলাম, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারপর একটি হোয়াটসআপ গ্রুপ আর ফেসবুকের মাধ্যমে তার খবরা-খবর দেখতাম আর মনে মনে দোয়া করতাম, হে আল্লাহ্, মনোয়ার ভাইকে তোমার কুদরতি মদদ দিয়ে সুস্থ করে দাও। তাকে দীর্ঘজীবী করো, কারণ মানবতার এই দুর্দিনে তাঁর মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। যখন জানতে পারলাম ডাক্তাররা তার শেষ যাত্রার সম্ভাব্য সময় অনুমান করে ফেলেছেন, তখন থেকে দোয়া শুরু করলাম, আল্লাহ্, যদি তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাও, তাকে ঈমান ও সম্মানের সাথে নিয়ে যাও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পরম করুণাময় আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাঁর ও আমাদের দোয়া কবুল করেছেন। সুদৃঢ় ঈমান ও সুউচ্চ সম্মানের সাথে তাঁকে নিজের কাছে নিয়েছেন।
মনোয়ার ভাইতো চলে গেলেন। তার মৃত্যু সংবাদ জানার পর থেকে মনে হচ্ছে যেনো এক আপন ভাইকে হারিয়েছি। সত্যি বলতে কি, পরিবারের বাইরের কারো মৃত্যুতে এতো তীব্র অনুভূতি আগে হয়নি। দোয়া করছি দয়াময় আল্লাহ্ যেনো মনোয়ার ভাইকে বেহেশতের মেহমান হিসেবে কবুল করে নেন। আমীন।
এমজি কিবরিয়া : শিক্ষক, সাংবাদিক। (লীডস প্রতিনিধি, চ্যানেল এস)।