চলে গেলেন সবার প্রিয় বাদশা ভাই
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
মোঃ রহমত আলী
গত সোমবার (১০ আগস্ট) সকালে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে প্রথমেই যে টেক্সট ম্যাসেজটি পেলাম তা হলো ‘প্রিয় বাদশা ভাই আর আমাদের মাঝে নেই, অল্প কিছুক্ষণ আগে লন্ডনের সেন্টবাথ হসপিটালে ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউওন)। খুব অল্প কথায় এ ম্যাসেজটি মিসবাহ উদ্দিন পাঠালেও এটা যেন বজ্রপাতের মত আচমকা আমার মাথায় আঘাত হানে। আমি দাঁড়ানো থাকলেও ম্যাসেজটি পড়ার পর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। সাথে সাথে চেয়ারে বসে পড়ি। এক অজানা আশংকায় যেন আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অবচেতনের মত বার বার সে ম্যাসেজটি পড়তে থাকি। আর যতই পড়ি ততই মনের মধ্যে অনেক স্মৃতি ভেসে উঠতে থাকে। আমি তখন অনুভব করতে থাকি স্মৃতি যে কতটুকু বেদনাময় হতে পারে! আমার তখন মনে হয়েছে এ মৃত্যু সংবাদটির রিয়েকশন যেন আমার আপন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদের চাইতে কোন অংশেই কম নয়।
মানুষ তার ব্যবহারের মধ্যেমে অন্যের কাছে শুধু আপন হয়ে উঠে না, কোন সময় বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আপন ভাইয়ের চাইতেও ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। আমার মনে হয় মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন আমাদের কাছে সে রকমই এক আদর্শের প্রতিক। বাদশা ভাই, আমার চাইতে বয়সে অন্তত: দশ বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু তাকে আমি ‘বাদশা ভাই‘ বলে ডাকতাম যেভাবে তার অন্য দুই বড় ভাই তৈমুছ আলী ভাই ও হাছন আলী ভাইকে ডাকি। তিনি তার ব্যবহরের মাধ্যমেই আমাকে এ সম্বোধন করতে বাধ্য করেছিলেন।
মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী মানুষ। একদিকে তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল অন্যদিকে সততা ও ন্যায়পরায়নতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আপোসহীন। কোন অন্যায়-অবিচার দেখলে তিনি সাথে সাথেই এর প্রতিবাদ করতেন। তার মধ্যে সবচাইতে বড় গুন ছিল সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন ও অন্যের অসুবিধায় নিজের কাজ ফেলেও সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন। তবে এটা শুধু তার মধ্যে ছিল যে তা নয়, তাদের অন্যান্য ভাইদের মধ্যেও এসব গু বিদ্যমান রয়েছে।
মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন, যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সভাপতি, বিশ্বনাথ স্পোটিং ক্লাবের সভাপতি, বিশ্বনাথ এইড ইউকের লাইফ মেম্বার, বিশ্বনাথ ইউনিয়ন ট্রাস্টের ট্রাস্টিসহ অনেক সামাজিক সংগঠনের সদস্য। মূলত তিনি ছিলেন ব্যবসায়ি। বিলেতের বাঙালি পাড়ার ‘মধুর কেন্ট্রিন’ হিসাবে পরিচিত ‘আলাদিন’ রেষ্টুরেন্ট থেকে শুরু করে বৈশাখী রেস্টুরেন্ট ও বেথনাল গ্রীণের একটি গ্রোসারী শপ পর্যায়ক্রমে পরিচালনা করেছেন। তবে এ সমস্ত ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সমাজকর্ম ও কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডা প্রায় সময়ই তার এ সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লেগেই থাকতো। শুধু বিলেতে নয়, দেশে গেলেও তিনি বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় সবসময় মেতে থাকতেন । বিভিন্ন সময় তিনি দেশে বিরাট ফুটবল খেলারও আয়োজন করেছেন। যুব সমাজ অপেক্ষায় থাকতো কখন তিনি দেশে যাবেন আর ফুটবল খেলা শুরু হবে। সেই যুব সমাজও আজ তার মৃত্যুতে শোকাহত হবে তাকে আর কোনদিন কাছে না পাওয়ার বেদনায়।
ব্যক্তিগত জীবনে মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন তার ৫ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তৃতীয়। তিনি ৩ মেয়ে ও ২ ছেলের জনক। তারা ইস্ট লন্ডনের ফরেস্ট গেইট এলাকায় থাকতেন। তাদের দেশের বাড়ি বিশ্বনাথ উপজেলায় পাশ্ববর্তী হরিকলস গ্রামে।
তিনি এবার তার স্ত্রীকে নিয়ে পবিত্র হজ্জ পালন করতে গিয়েছিলেন। গত ১১ আগস্ট হজে যাওয়ার পর সেখানে হজ পর্ব শেষে হঠাৎ অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তখন তাকে কিং ফাহাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তাকে হসপিটালে নেয়াসহ দেশে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রেখেছিলেন একই গ্রুপে হজে যাওয়া বিশ্বনাথ প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্টের সেক্রেটারী মিসবাহ উদ্দিন। তার মাধ্যমই অসুস্থতার খবরটি ছবিসহ টেক্ট ম্যাসেজের মাধ্যমে আমরা পাই। আমরা তখনই আশংকা করছিলাম যে, তিনি কি সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন। অবশেষে প্রায় ছয় দিন সেখানে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হলে গত ৮ সেপ্টেম্বর শনিবার যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। আমরা তখন কিছুটা আশস্ত হয়েছিলাম। তবে এখানে আসার পর আবারো তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হন এবং ১০ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি শেষ বিদায় নেন।
তাঁর এ মৃত্যু আকস্মিক হলেও মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ করুণা লাভ করেছেন বলে সবাই মনে করছেন। কারণ পবিত্র হজ পালন করার সাথে সাথেই তিনি শেষ বিদায় নিয়েছেন। আমরা তার রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।
১২ সেপ্টেম্বর বুধবার ইস্ট লন্ডন মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমানসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। আমি বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তারমত একজন অনন্য মানুষের জানাজায় এমন উপস্থিতি আর লক্ষ্য করিনি। আমার মনে হয়েছে যে, তার পরিচিত মহলের অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে সংবাদ পেয়েছেন সেভাবেই জানাযায় ছুটে এসেছেন। সবার মূখেই বলতে শুনেছি বাদশা ভাইয়ের প্রশংসার কথা। তার বিভিন্ন স্মৃতির কথা। অনেকে এ সময় নীরবে চুখের অশ্রু ফেলেছেন তার জন্য। মহান আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন ও আমাদেরকেও সেভাবে চলার ও মানুষের ভালবাসা অর্জনের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক দর্পণ।