সাংবাদিকরা কেন এভাবে মার খাচ্ছেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ আগস্ট ২০১৮
মোহাম্মদ শাকিল উদ্দিন:
টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুরুর পুরোটা সময়ই স্পষ্ট দেখেছি কিভাবে জাতি বিভক্তির চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। শাহবাগ আন্দোলনের পর দিগন্ত টিভির অনেকেই সরকারিদলের কর্মীদের হাতে নির্যাতন, হামলা, লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। তারপরেও অনেক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় সংবাদ সংগ্রহ করছি। এই বিপদসংকুল পরিবেশে সংবাদ সংগ্রহ করলেও খারাপ না লাগার ক্ষেত্রে যে শক্তিটি সবচেয়ে বেশ কাজ করেছে তা হলো দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষের ভালোবাসা। দিগন্ত টেলিভিশনের রিপোর্টার পরিচয় পেলেই সাধারণ মানুষ মনের সকল কষ্ট খুলে বলতে শুরু করতো, বলতো সব টিভির খবর দেখার পর সত্যতা জানতে দিগন্ত দেখেন। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেবার পরে মূলত দেশের টেলিভিশনগুলো বিটিভিতে পরিণত হয়েছে, কেউ সরকারের পারপাস সার্ভ করতে আর কেউ ভয়ে। ইতোমধ্যে জল অনেক গড়িয়েছে। দীর্ঘ ৫ বছর পর এখন দেশের মানুষের একবিন্দু বিশ্বাসও নেই টেলিভিশনগুলোর উপর। যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই এখন টেলিভিশনের খবরের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবর। আর এক্ষেত্রে অনেকে ক্ষতিগ্রস্তও হন ভুল এবং সুত্রবিহীন খবর জেনে।
যে জলাশয়ে পানি প্রবাহিত হয় তার পানি পচে না। কিন্তু যে জলাশয়ে পানি প্রবাহিত হবার সুযোগ পায়না সে স্থানের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। আজকের সমাজের অবস্থাও তাই হয়েছে। যে টিভি চ্যানেলগুলো গণজাগরণ মঞ্চ দিনরাত লাইভ দেখিয়ে, চাঙ্গা রেখেছে, শত মানুষের জটলাকে জুম এঙ্গেলে দেখিয়ে হাজার হাজার জমায়েত বলে প্রচার করেছে। শাহবাগ বন্ধ থাকায় নগরের ভুগান্তি প্রচার না করে এখানে গনমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বারবার বলে ফেনা তুলেছে, বিরিয়ানি, ভ্রাম্যমাণ টয়লেট বাবস্থাপনা থেকে শুরু করে মাসের পর মাস এই আন্দোলন চাঙ্গা দেখিয়ে একটি সরকারি দলের পারপাস সার্ভ করতে সহায়তা করেছে। একই মিডিয়া হাউসগুলো এখন পুরো উলটো বক্তব্য দিচ্ছে। বলছে পাবলিক ভোগান্তি, তৃতীয় শক্তির আশকারা। সাম্প্রতিক সময়ে টিভি সাংবাদিকেরা যাচ্ছে তাই ভাবে মার খাচ্ছে, আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষের মানুষের কাছ থেকে। সরকারি দলের কর্মীরা নিজের ঘরের বউ মনে করে যেন পিটাচ্ছে, কারণ তারা হয়তো মনে করে এদের যতই পিটাই এরা আমাদের অনুষঙ্গ। আর বিপক্ষ দলের কর্মীরাও পিটাচ্ছে কারণ তাদের সংবাদ নিরপেক্ষভাবে চ্যানেলগুলো দিচ্ছেনা। সাংবাদিকের এহেন অবস্থা দেখে নিজেকে এই পেশার একজন পরিচয়দানকারী মানুষ হিসেবে লজ্জা লাগছে কিন্তু মনের মধ্যে তেমন কষ্টের সৃষ্টি হচ্ছেনা। কারণ সাংবাদিকতার নামে যা তারা করে বেড়াচ্ছেন তা আর যাই হোক নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বলা যায় না। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরা চাকরি বাঁচাতে সেলফ সেন্সরশিপ করেন আর কেউ কেউ করেন নিজেকে সকারের প্রিয়ভাজন প্রমাণ করতে।
তবে হ্যাঁ, যে সকল সাংবাদিক মার খাচ্ছেন তাদের অধিকাংশ টিভি চ্যানেলের জুনিয়র পোস্টে কাজ করেন বিধায় অফিসের এডিটরিয়াল পলিসিতে কোন পরিবর্তন আনতে পারেন না। অফিস থেকে যে এঙ্গেলে নিউজ করতে বা বলতে বলা হয় তারা শুধুমাত্র মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। এর মাঝে কেউ কেউ কৌশলে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন কিন্তু অধিকাংশ দেন গাঁ ভাসিয়ে। কিন্তু কেন করেন তাঁরা এমন? এত কম্প্রোমাইজ করেও কি এই পেশায় থাকতে হবে? সাংবাদিকেরা কি এতই অযোগ্য? না তা নয়। যে কোনো চ্যানেলে কাজ করার মৌলিক শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, এর পর সংবাদ তৈরি থেকে শুরু করে ব্যাপক যোগ্যতা যাচাই বাছাই করা হয়। টেলিভিশন সাংবাদিকতার মূল কাজ যেহেতু মানুষের সাথে যোগাযোগ তাই মাস-কমিউনিকেশনের উপর দক্ষতা গুরুত্ব পায়। এত যোগ্যতা থাকার পরেও অন্যের অধীনে, নিজের স্বাধীনতা খর্ব করে, রাস্তায় মার খেয়ে, যার বিচার পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে কাজ করার থেকে গ্রামে গিয়ে আলো পটল বেচা অনেকাংশে ভালো মনে করি।
গত কয়েকদিনে প্রায় ১৫-২০ জন সাংবাদিক মারাত্মকভাবে সরকারি দলের পোষা বাহিনীর দ্বারা হামলার শিকার হয়েছেন যার জন্য গত মঙ্গলবার দেখলাম সরকারি দলের ব্যবসায়ীদের চ্যানেলের অনেক সাংবাদিক পথে নেমেছে, দাবি জানাচ্ছে অবিলম্বে ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শাস্তি দিতে। তাদের উদ্দেশে শুধু এটুকু মনে করিয়ে দিতে চাই, সাগর-রুনি হত্যার অপরাধী ৪৮/৭২ ঘণ্টার মধ্যের ধরার কথা ছিল। আজ কতো বছর একটু হিসেব করে দেখুন প্লিজ…।
মোহাম্মদ শাকিল উদ্দিন
লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক।