স্মৃতির আয়নায় আমার বাবা
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মার্চ ২০১৮
মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল:
২১ শে ফেব্রুয়ারি মহান বাংলা ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। ১৯৫২ সালে এই দিনে মাতৃভাষা বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য সালাম, জব্বার, বরকত অনেকেই প্রাণ দিয়েছিলেন। এই দিনটি আমার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফেব্রুয়ারি এলেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় অনেক কিছু।
আজ থেকে বিশ বছর আগে মাত্র ৬১ বছর বয়সে ১৯৯৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় লন্ডন সেন্ট বার্থলম হাসপাতালে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করে এই দুনিয়া থেকে আমাদের মায়ার বাঁধন ছিড়ে চলে যান আমার বাবা মোহাম্মদ আব্দুর রহিম জাহেদী। আজ এই শীতের ভোরে আমার বাবার কথা কেনো যেন বারবার মনে পড়ছে। একমাত্র তিনিই ছিলেন আমার রোল মডেল। বাতিল সংগঠন পরিত্যাগ করে দ্বীনি কাজ করার জন্য ইসলামী সংগঠনে ফিরে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, একজন আদর্শ পিতার প্রাণান্তর চেষ্টার ফলে আজ আমি এ পর্যায়ে এসেছি। দ্বীনের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি। আমার বাবা একজন সমাজসেবক হিসাবে শুধু দিয়েই গেলেন, কারো কাছ থেকে কিছু নিতে দেখিনি। সারাজীবন মানুষের উপকার করেছেন, মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইস্ট লন্ডন মসজিদের চেয়ারম্যান, ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ এর কেন্দ্র্রীয় মজলিশে সূরার সদস্য ও ট্রেজারার, স্টেপনি গ্রীন স্কুলের প্যারেন্ট গভর্নরসহ সফলভাবে একাধিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি শুধু আমার পিতা নন, আমাদের আত্মীয় স্বজন, পরিচিত অনেকের পিতার মতো অভিবাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জন্য বাবার জন্য তাঁরা প্রাণভরে দোয়া করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে প্রতিফল দান করবেন এবং জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে সমাসীন করবেন বলে আমরা আশাকরি।
সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের হিলালপুর গ্রামে ১৯৩৭ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাফেজ আব্দুল বারী এবং মাতা ওলিদা খাতুন। বাবাকে নিয়ে হাজারো স্মৃতি আজ মনের আয়নায় ভাসছে। খুব ছোটবেলার অতি সাধারণ অনেক স্মৃতিগুলো আজ বেশি মনে পড়ে। আমার বয়স তখন সাত। আব্বার সাথে আমার প্রথম দেখা। আমি আর আপা। আমরা তখন দুই ভাই বোন। বাবা লন্ডন থেকে আমাদের জন্য লাগেজ ভর্তি কাপড়-চোপড় ও ফুটবলসহ খেলাধুলার সামগ্রী নিয়ে এলেন। তারপর আমাকে নিয়ে ঢাকার চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শিশু পার্কসহ আরো অনেক আকর্ষণীয় স্থান ভ্রমণ করে ভ্রমণ কাহিনী লিখালেন। তখনকার সময়ে আমার জন্য সেটা ছিলো বিরাট ব্যাপার। ছেলের শখ মেটানোর জন্য ঢাকা থেকে সিলেট ফেরার সময় বিমানে নিয়ে এলেন। সেদিন কি যে আনন্দিত হয়েছিলাম। বন্ধুদের বিমান ভ্রমণের গল্প বলার জন্য নিজের অজান্তে সন্ধ্যা বেলায় পাশের প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে দেখি স্কুল বন্ধ। পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে সবাইকে বিমান ও ঢাকায় বেড়ানোর অনেক গল্প শুনালাম। ঢাকায় বাবার সাথে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী সাহেবের বাসায়ও গিয়েছিলাম। আমার চাচাতো ভাই চুনু ভাইয়ের সাথে ওসমানী সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে তাঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়েছিলো। স্বাধীনতার পরপর ওসমানী সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করাটাও অনেক আনন্দের ছিলো। ওই সময় ধানমন্ডিতে অমার চাচার বন্ধু ড. খালেকুজামান চাচার বাসায়, কলাবাগান কুকিলা খালার (জলিদের) বাসায় এবং টঙ্গীতে আব্দুন নূর চাচার (ইমরান ভাই) বাসায়ও বেড়াতে গিয়েছিলাম। আব্দুন নূর চাচা আব্বার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। আমিও চাচাকে খুব পছন্দ করি। উনিও অনেক ভাল গুণের অধিকারী। উনাকে নিয়ে অন্য একদিন লিখবো ইনশা আল্লাহ।
এরপর এক এক করে শুরু হয় আমার জীবনের নতুন অধ্যায়। প্রথম শুরু হয় সাঁতার শিখা। এক সপ্তাহের মাথায় আব্বার কাছ থেকে সাঁতার শিখা হল। অথচ আমার ছেলেকে এখনও সাঁতার শিখাতে পারিনি। একবার তারাবিহের নামাজে সহপাঠীদের সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছিলাম। সালাম শেষে বাবা আমাকে খুব শাসালেন। এরপর আর কখনো নামাজে দুষ্টুমি করিনি। আব্বার খুব ঘনিষ্ঠ একজন ছিলেন মেল্লাগাওর নুর বকশ চাচা। সবসময় আব্বার পাশে থাকতেন। জায়গা জমি কেনার ব্যাপারে আব্বাকে সাহায্য করতেন। একবার উনাকে খাবার দেওয়ার সময় কোনো কারণে একটু রাগ করে প্লেট দিয়েছিলাম। এই জন্য আব্বার কাছ থেকে গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষা পাই, যা আজীবন মনে থাকবে।
মানুষকে ভালোবাসা, সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, অন্যের হক নষ্ট না করা, পরোপকার করা, সমাজসেবা করা ইত্যাদি অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। সুদূর এই লন্ডনেও নিজের ক্ষতি করেও আমাদের বাড়িরসহ সকল আত্বীয়-স্বজনের সবার হক আদায় করার চেষ্টা করে গেছেন, যা অমার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। রমজান মাসে সকল আত“ীয়-স্বজনের বাসায় ইফতারি দিয়ে খুব আনন্দ পেতেন। মেয়ে পক্ষ ছেলের পক্ষ, কোনো পক্ষই বাদ পড়তোনা। প্রতি রমজান মাসে প্রায় ২০-২৫ জন স্বজনের বাসায় আব্বা-আম্মার সাথে আমরা ইফতারি নিয়ে যেতাম দিতাম। দেশে-বিদেশে অনেক মানুষের উপকার করে গেছেন। মানুষকে ভালোবেসে সবার মন জয় করেছেন- যা সদগাহে জারিয়া স্বরূপ আজীবন থাকবে। আল্লাহ তাঁর এই সকল ভাল কাজ কবুল করুন এবং খারাপ কাজগুলোর জন্য যেনো ক্ষমা করে দেন।
আমার পড়ালেখা ও অন্যান্য ব্যাপারে আব্বার চিন্তার কোনো শেষ ছিলো না। সবসময় আমার খবর নিতেন, আমি লন্ডন আসার আগে আব্বা আমার কাছে অনেক দীর্ঘ চিঠি লিখতেন, তাতে খুব সুন্দর সুন্দর পরামর্শ, ভাল কাজের আদেশ থাকতো। বিশেষ করে নিয়মিত পড়াশুনা করা। নামাজ পড়া, দ্বীনি কাজ করা, কুরআন, হাদিস ও ইসলামী বই পড়া ইত্যাদি ছিল চিঠির মূল বিষয়। আমি তার উলটো লন্ডনী বাবার ছেলে, লেখাপড়ার পরিবর্তে শৌখিনতা আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।
অল্প বয়সে ছাত্র রাজনীতিতে (তাও বাবার চিন্তার বিপরীত) জড়িত হওয়ায় আব্বাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছিলাম। একবার এক চিঠিতে আব্বা লিখেছিলেন ‘তোমার বয়সী অনেক ছেলেদের দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে লন্ডনের মতো জায়গায় ইসলামের ছাঁয়াতলে নিয়ে এসেছি, আর আমার নিজের ছেলে ইসলাম-বিরোধী সংগঠনে। তা কোনো অবস্থায়ই মেনে নেয়া যায়না। আমাকে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা ও তদবির করেছেন। লন্ডনে এসেও প্রথমে কিছু দিন পূর্বের রাজনীতিতে যোগ দেই, এর পর আব্বার অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং কঠোর পাহারাদারীর মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ইয়ুথ সংগঠন ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশন ইউকেতে যোগ দিই। আমার পরিবর্তনে আব্বা খুবই খুি হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ লন্ডনের মজলিশে সূরার সদস্য ছিলাম এবং তিনি কেন্দ্রীয় মজলিশে সূরার সদস্য ছিলেন। আমার এ অবস্থানে আব্বা খুবই খুশি ছিলেন। আজ আমিও সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমার সন্তানগুলোকে সেই শিক্ষা দিতে কোনো ত্রুটি করছিনা। আমার মেয়েও এখন ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত, বিভিন্ন স্থানে ইসলামিক বক্তব্য উপস্থাপন করে। তা দেখে নিজের মন ভরে যায় এবং আব্বার সেই সব স্মৃতি ও চিঠির কথা মনে পড়ে। আমার সন্তানরাও হয়তো একদিন তাঁদের বাবার স্মৃতিগুলো মনে করবে। সবার জীবনেই বাবা এবং মায়ের কোনো না কোন স্মৃতি থাকবেই। চিঠির স্মৃতি না থাকলেও হয়তো আছে ভিন্ন ধরনের কোন স্মৃতি।
এখন আমি একজন বাবা। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আমি চলে গেলে তাদের জন্য টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি জমা থাকবে। যেমনটি আছে আমার। আজ বাবা-মা, শশুর-শাশুড়ি সকল ভালোবাসার মানুষ দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আগামী হলিডেতে (সামার টাইমে) আমার বড় মেয়ে রেফার বিয়ে। মেয়ের দাদা দাদি এবং নানা নানি উভয়ের প্রথম নাতিনের বিয়ে। কিন্তু আজ তারা অনুপস্থিত, মুরব্বিরা জীবিত থাকলে কত আনন্দিত হতেন এবং আমরাও অনেকটা ঝামেলামুক্ত থাকতাম।
শুধু তাদের স্মৃতিগুলো আজ স্মরণ করছি। বাবা-মা দু’জনের ক্যান্সারে অকাল মৃত্যু আমার ভেতরে এখনও রক্তক্ষরণ হয়। বড় ছেলে হিসাবে জীবনে যা চেয়েছি তা পেয়েছি। আমার আব্বা একজন শৌখিন মানুষ ছিলেন। সত্তর দশকে বিলেতে খুব কম মানুষের নিজের গাড়ি ছিল। তখন আমার আব্বার গাড়ি ছিল এবং এই একমাত্র গাড়ি দিয়ে ইসলামী সংগঠনের দাওয়াতী কাজ করেছেন এবং আত্বীয় স্বজনের হক আদায় করেছেন। আমরা লন্ডন আসার পর বৃটেনসহ ইউরোপের অনেক দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঘুরে আমাদেরকে আনন্দ দিয়েছেন। সেই থেকে আজ অবদি দেশ বিদেশ ঘুরছি। আমার সকল শখ আব্বা পূরণ গেছেন। দুনিয়ার সেরা স্থান মক্কা মদীনাও আমাকে নিয়ে জিয়ারত করেছেন। আমার বিয়ের আগেই গাড়ি-বাড়িসহ সব কিছুর শখ পূরণ করে দেন।
আমার জীবনের সকল আশা পূরণ করলেন অথচ তাকে আমি কিছুই দিতে পারলাম না। আমি তোমার খুব প্রিয় ছিলাম। বাবা সব কিছুই দিলেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর জন্য কিছুই করতে পারিনি। এখন শুধু দোয়া করছি- ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ঈয়ানী সাগিরা’। হে আল্লাহ তুমি আমার আব্বাকে জান্নাতবাসী করো এবং সকল গুনাহ ক্ষমা করে দাও। আমিন। এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী ছেড়ে আমার মা-বাবা, শশুর-শাশুড়ি সকল মুরব্বি দোয়ার পথ বন্ধ করে চলে গেছেন। আর ফিরবে না কোনো দিন, এখন শুধু স্মৃতির আয়নায় সবাইকে দেখছি । হাজারো স্মৃতি আজ চোখে ভাসছে। জান্নাতে ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন। দেখা হবে অনন্ত এই ভুবনে।
লেখক : সাংবাদিক, সংগঠক। (সম্পাদক, অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ইউরোবাংলা)।