চ্যানেল এস’র তেরোতম জন্মদিনে বিলেতের বাংলা মিডিয়ার ভবিষ্যৎ ভাবনা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭
তাইসির মাহমুদ:
ষোলই ডিসেম্বর ২০১৭। এক সঙ্গে দুটো জন্মদিন উদযাপন করলাম। একটি ৪৬ বছর আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের। অপরটি বাংলাদেশের ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বে লালন করতে ২০০৪ সালে বিলেতে জন্মনেয়া টেলিভিশন চ্যানেল এস-এর। জন্মের পর থেকে চ্যানেল এস- প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটি উদযাপন করে আসছে বেশ ঘটা করে। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি নিজেদের জন্মদিনের নানা আয়োজন থাকে টানা কয়েকদিন ধরে। তবে জমজমাট যে অনুষ্ঠানটি হয় তা হলো কমিউনিটির বিভিন্নস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে কেক কাটার লাইভ অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কুটনীতিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, শিল্পী, কমিউনিটি এক্টিভিস্ট সকলের স্বতস্ফুর্ত সমাগম ঘটে। এ বছরও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজনে তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বিগত বছরগুলোর ন্যায় জাঁকজমক আয়োজনেই সাজানো হয়েছিলো চ্যানেল এস প্রাঙ্গন। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে বলতে পারি, বিগতদিনের সবগুলো অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিলো। শুধু একটি বছর পারিনি। ২০০৭ সালে ডিসেম্বরে স্বপরিবারে বাংলাদেশে ছিলাম।
প্রতি বছর অনুষ্ঠানের দিন তারিখ ঘনিয়ে এলে চ্যানেল এস থেকে ঝড়ো বেগে দাওয়াত আসতে থাকে। প্রথমে টেকস্ট, পরে রিমাইন্ডার এর পর টেলিফোনে মৌখিক অনুরোধ। অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত না হয়ে পারা যায়না। উপস্থিত না হলে মনে হয় কিছু একটা যেনো মিস করছি। কারণ এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সহকর্মী সাংবাদিকদের একটি সম্মিলন হয়ে যায়। কমিউনিটির পরিচিতজনের মিলন ঘটে। একটা উৎসব ভাব থাকে সারাদিন। কমিউনিটি ভিত্তিক টেলিভিশন হিসেবে চ্যানেল এস একটি জনপ্রিয় ও সফল টেলিভিশন এটা নিঃসংকোচেই বলা চলে। তেরোতম জন্মদিনে চ্যানেল এস সম্পর্কে ব্যক্তিগত উপলব্ধি হচ্ছে, এই চ্যানেল কমিউনিটির মানুষের হৃদয়ে নিজেদের স্থান করে নিতে পেরেছে। মানুষ চ্যানেল এসকে ভালোবাসে। এটাই চ্যানেল এস এর সবচেয়ে বড় অর্জন। এটাই বড় প্রাপ্তি। এটাই চ্যানেল এস টিমের সবচেয়ে বড় শান্তনা।
কোনো লেখকের লেখা যদি সুখপাঠ্য না হয়, লেখা যদি পাঠক না পড়ে। তাহলে তার লেখা নিরর্থক। সংবাদপত্রের যদি পাঠক না থাকে তাহলে পত্রিকা বের করে লাভ নেই। রেডিও’র যদি শ্রেুাতা না থাকে তাহলে এই রেডিও অর্থহীন। ঠিক তেমনী কোনো টেলিভিশনের যদি দর্শক না থাকে তাহলে এটা টেলিভিশন নয়। গণমাধ্যম আসলে পাঠক ও দর্শক-শ্রেুাতাদেরই সম্পদ। তাদের ভলোলাগা না লাগার উপরই মিডিয়ার ভবিষ্যত নির্ভর করে। গায়ের জোরে মিডিয়া চালানো যায়, কিন্তু সেটি জনগণের সম্পদ হয় না। চ্যানেল এস একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল। কেন জনপ্রিয়? কারণ এই টেলিভিশনের অগণিত দর্শক আছে। ইউরোপে বাংলা টেলিভিশনের দর্শক কারা? আমরা, অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যারা বড় হয়ে এসেছি। আমরা যারা বাংলা বুঝি, বাংলা চর্চা করি। কিন্তু আমরা কতদিন এই টিভিগুলোর দর্শক থাকতে পারবো? বড়জোর ৩৫ থেকে ৪০ বছর। গড় আয়ু হিসেবে এর মধ্যেই আমাদেরকে বিদায় নিতে হবে।
আমরা চলে যাওয়ার পর বাংলা টিভিগুলোর দর্শক কারা হবে? বাংলা সংবাদপত্র পড়বে কারা? বাংলা রেডিও শুনবে কে? নিশ্চয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। আমাদের সন্তানেরা। কিন্তু তারা কি ঘরে বাংলায় কথা বলতে পারে। জ্বি এবং জ্বি-না ছাড়া অধিকাংশই বেশ কিছু বলতে পারে না। অনেকে জ্বি, জি-না বলতে জানলেও বলে না। তাদের কাছে বাংলা ভাষার তেমন গুরুত্ব নেই। বরং তাদের কাছে কদর রয়েছে ফ্রেঞ্চ, জার্মান প্রভৃতি বিদেশী ভাষার। ওইসব বিদেশী ভাষা শিখতে এবং কথা বলতে তারা গর্ববোধ করে। অভিভাবকেরা চান তাঁর সন্তানেরা তার মতোই বাংলায় কথা বলুক। বাংলা শেখাতে চেষ্টারও কমতি করেন না। ঘরে বাংলার শিক্ষক রেখে শেখাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বাংলার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। সুতরাং যারা বাংলায় কথা বলতে পারেনা, তারা বাংলা টিভি দেখার তো প্রশ্নই আসে না।
অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা বাংলা টেলিভিশন দেখে থাকে। তবে স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে নয়, নিরুপায় হয়েই। যেমন রাত দশটার আগে ঘরে ফিরতে পারলে বাংলা টেলিভিশনে রাতের সংবাদটি দেখে নেওয়া আমার একটি নিয়মিত রুটিন। আর সংবাদ দেখার জন্য বেছে নিতে হয় চ্যানেল এস। কারণ চ্যানেল এস-এ একটি সুসংগঠিত নিউজ টিম আছে। সপ্তাহের সাতদিনই তাঁরা সংবাদ প্রচার করেন। কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী চ্যানেল এস পর্দায় উঠে আসে। অনেকটা ‘মিরর অব দ্যা কমিউনিটি’র মতোই। আয়নায় তাকালে যেমন মুখ দেখা যায়, তেমনি চ্যানেল এস এর সংবাদ দেখলে কমিউনিটির মোটামুটি একটি চিত্র চোখের সামনে ভেসে আসে। যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। দশটার আগে ঘরে ফিরলে বড়দের মতো আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলেটিও বুঝতে পারে- বাবা চলে এসেছেন, তিনি এখন রাতের সংবাদ দেখবেন। অন্তত আধঘণ্টার জন্য আমাদেরকে টেলিভিশনটি ছেড়ে দিতে হবে। তাই ঘড়ির কাটা রাত ১০টায় পৌঁছার আগেই স্কাই নাম্বার যেনো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন হয়ে ‘চ্যানেল এস’ হয়ে যায়। অর্থাৎ ছেলেকে (মিকাইল মাহমুদ) বলতে হয় না, আমি চ্যানেল এস দেখবো। স্কাই নাম্বার পরিবর্তন করো। সে তার শিশু মন থেকেই উপলব্ধি করতে পারে এবং পরিবর্তন করে দেয়।
অনেকটা নিরুপায় হয়েই ছেলে মেয়েরা টিভিসেটের সামনে বসে। বাংলা সংবাদ দেখে। বাংলা বুঝেনা, কিন্তু বিভিন্ন ফুটেজ দেখে জানতে চায় এটা কী, ওটা কী। তবে বিজ্ঞাপন বিরতিটা তাদের জন্য কিছুটা উপভোগ্য। কারণ অভিনয়ধর্মী কিছু বিজ্ঞাপন থাকে, যার ভাষা বুঝতে না পরলেও অভিনয়ের ভঙ্গিমা তাদেরকে কিছুটা আনন্দ দেয়।
ছেলে-মেয়েদের এই যে টেলিভিশন দেখা। এটাতো বাধ্য হয়ে। বাবা দেখেন তাই তাকে সম্মান করে তারা দেখছে। আধঘণ্টা সময় টিভিটি বাবার জন্য উৎসর্গ করে দিচ্ছে। কিন্তু বাবা যখন ঘরে নেই তখন তো তাদেরকে বাংলা টেলিভিশন দেখতে হচ্ছে না। আমি, আমরা যখন বেঁচে থাকবো না, তখন তো তাদেরকে বাংলা টেলিভিশন দেখতে হবে না। তাহলে তখন বাংলা টেলিভিশনের দর্শক থাকবে কারা? কে দেখবে টেলিভিশন? এটা একটি বড় প্রশ্ন।
আমরা নতুন প্রজন্মকে যদি বাংলা শেখাতে না পারি, তাহলে আজ থেকে ৩৫-৪০ বছর পর টেলিভিশনগুলো দর্শকশূন্য হয়েপড়ার আশংকা মোটেও অহেতুক নয়। আর দর্শকশুন্য হলে কি কোনো টেলিভিশন টিকে থাকার সুযোগ আছে।
চ্যানেল এস নতুন প্রজন্মের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান তৈরি করে থাকে। তাদের আকৃষ্ট করতে কর্তৃপক্ষের চেষ্টা এবং আন্তরিকতাও আছে। কিন্তু কেন যেনো সেই চেষ্টায় সফলতা আসছে না। কীভাবে সেই চেষ্টা ফলপ্রসু করা যায়, তার একটি পথ খুঁজে বের করা দরকার। সকালে ঘুম থেকে জেগে ছেলে মেয়েরা মূলধারার অন্যান্য চ্যানেলে হুমড়ী খেয়ে পড়ে। ওই সব চ্যানেলে যা দেখায় তাদের মতো কি দু’চারটি প্রোগ্রাম শুরু করা যায় না। চ্যানেল এস এই কমিউনিটিকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস- কর্তৃপক্ষ চাইলে নতুন প্রজন্মকে বাংলামুখী করতে একটা কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবেন। শুধু চ্যানেল এসই নয়। বৃটেনে এখন নতুন পুরাতন সবমিলিয়ে প্রায় ৭টি বাংলা টিভি চ্যানেল। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে এলে কিছু করা সম্ভব। তাহলে প্রবাসে বাংলা মিডিয়া বাঁচতে পারে। বাঁচতে পারে আমাদের বাংলা ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আমাদের সন্তানেরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। আমাদের বাঙালিয়ানার ধারাবাহিকতা কয়েক যুগের জন্য হলেও টিকে থাকবে। নতুবা একসময় এখানে বাংলা বলতে কি কিছু থাকবে?
বৃটেনে যে পাঁচ লাখ বাংলাদেশীর বসবাস ছিলো। এখানে একটি শক্তিশালি কমিউনিটি ছিলো। এখানকার বৃটিশ সোসাইটিতে বাংলাদেশীদের অনেক অবদান ছিলো। তা কি কেউ মনে রাখবে? মনে রাখার কেউ কি থাকবে। নদীগর্ভে যেমন বিলীন হয়ে যায় জনবহুলবসতি, তেমনি এই বিলেতে আমাদের সরব উপস্থিতি, অর্জন সবকিছুই বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তাইসির মাহমুদ : সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন।