আব্দুর রাজ্জাক : একজন কিংবদন্তির গল্প এবং পরজীবী রাজনীতির প্রকাশিত কথা (শেষ পর্ব)
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭
(পুর্ব প্রকাশের পর..)
ছরওয়ার আহমদ:
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ আসনে অনেক কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় ঘটেছিলো। কিন্তু দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের সমূহ দোষের দোষী বানিয়ে তাঁদেরকে (দুজনই বিয়ানীবাজারের) দল থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। তবে সত্যিই কি তাঁরা এত বড়ো মাপের দোষী ছিলেন? দুটি উপজেলার মানুষের উপর কিংবা দলের নেতাকর্মীর উপর সত্যিই কি তাঁদের এতো প্রভাব ছিলো? গোলাপগঞ্জেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন, তবে গোলাপগঞ্জের কাউকে কি বহিস্কার করা হলো? এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ে প্রার্থীর নিজের ব্যর্থতা ছিলো কি? নির্বাচনের পূর্বে দুটি উপজেলায় দলের মধ্যকার কোন্দল নিরসনে তাঁর আন্তরিকতা কতটুকু ছিলো? কেন এসব কোন্দল সৃষ্টি হয়েছিলো? সর্বোপরি কেন তিনি পরাজিত হয়েছিলেন? আরো অনেক প্রশ্ন তৃণমূল নেতাদের মুখে মুখে এখন উচ্চারিত হচ্ছে? আজ যখন তৎকালীন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ও দলের একজন একনিষ্ট সমর্থক ও নগন্য কর্মী হিসাবে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি, তখন মনে হয় নির্বাচনে পরাজয়ে সমূহ দোষের দোষী হিসাবে এ দুজন নেতাকে দল থেকে নিষ্ঠুরভাবে বিতাড়িত করা ছিলো একটি দীর্ঘ মেয়াদী ষড়যন্ত্রের অংশ । ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে সিলেট ৬ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় সে ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারীর সম্মূখে একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহারে এ কৃতী নেতাদ্বয়কে দল থেকে নিষ্ঠুরভাবে বহিস্কার করে ষোলকলা পূর্ন করা হয়েছিলো।
১৯৯৬’র সাধারণ নির্বাচনের একজন একনিষ্ট কর্মী ও ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের একজন একনিষ্ট সহযোগী হওয়ার সুবাদে আমি নিজেই অনেক ঘটনার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। শুধুমাত্র একটি মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত একটি পরিবারের সন্তান হিসেবে নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগ্রামে সংগঠনের পতাকাকে সমুড্ডীন রাখতে নিজেও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। তাই ২০০১ সালের নির্বাচনে সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ে আমাদের ব্যথা-বেদনাও কারো চেয়ে কম ছিলো না। কারণ এ সংগঠনের মাধ্যমেই তো বিয়ানীবাজারের মাটি ও মানুষের সাথে আমার ও আমার পরিবারের সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীর বিএনপির পাঁতানো নির্বাচনকে প্রতিহত করতে গিয়ে চারখাই পল্লী শাসন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের মেধাবী ছাত্র, ছাত্রলীগ নেতা শহীদ হুমায়ুন কবির চৌধুরী নাহিদের নির্মম মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাঁর রক্তস্নাত শপথে বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ গোটা আওয়ামী পরিবার যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো, তাতে পরবর্তীতে ১২ই জুনের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মাঠের প্রতিটি কর্মীকে মনে হয়েছিলো যুদ্ধের একেকজন সৈনিক। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী লড়াইয়ের যে যুদ্ধে মূলতঃ নেতৃত্ব দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। বিশেষতঃ কালের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছাত্রনেতা, বিয়ানীবাজার উপজেলা ছাত্রলীগের সংগ্রামী আহ্বায়ক আব্দুল বারীর সুদৃঢ় নেতৃত্বে কাঙ্খিত লক্ষপানে ছাত্রলীগ ছিলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত এবং শহীদ নাহিদের রক্তের প্রতিশোধের স্পৃহায় অবিরাম ছুটেচলা সূর্য সৈনিকের দল। গোটা সংগঠনের কার্যক্রমে ছিলো যথাযত সমন্নয়। তাই দলের মাঝে নানান সমস্যা থাকার পরও আমরা নির্বাচনে জয়লাভ করি। যা স্পষ্টতই, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জনপ্রিয়তার কারণে হয়নি। সম্ভব হয়েছিলো গোটা সংগঠনের ঐক্যের ফলে। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে লড়াইয়ের সে দৃশ্য ছিলো বিরল।
কিন্তু, কেন? সংক্ষেপে বলতে পারি এজন্য যে, ৯৬’র নির্বাচনে জয় লাভ করার পর নানান কারণে স্থানীয় এমপি’র সাথে তৃণমূলের ত্যাগী আওয়ামী লীগ পরিবারের (আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য সংগঠনের) দুরত্ব সৃষ্টি হয়। দেখা দেয় অনেক প্রশ্ন। যার ফলে ২০০১সালের নির্বাচনে দলীয় কার্যক্রমে সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান ছিলো। ৯৬’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী ১০জন কর্মীর সমান কাজ করেছিলো বলেই , নানাবিদ সমস্যা থাকা সত্বেও সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ব্যক্তিকে আমরা বিজয়ী করে ’নেতা’র আসনে বসিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০১সালের নির্বাচনে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের ১০জন কর্মীও একজনের কাজ করেনি। আরো কিছু প্রশ্নের পুরো উত্তর সে নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজেই ভালো দিতে পারবেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করতে অন্য সকল রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের চারদলীয় জোটমুখি অবস্থান দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের খ্যাতিমান নেতৃবৃন্দকেও শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছে। উক্ত নির্বাচনে জননেতা জিল্লুর রহমান, সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ, আমির হোসেন আমু, আবুল মাল আং মুহিত, মোঃ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর প্রমূখ নেতৃবৃন্দের মতো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কালজয়ী বাঘা নেতারাও পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁদের পরাজয়েও নানান ফেক্টর কাজ করেছিলো।
কিন্তু সিলেট ৬, বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ে সমগ্র দোষের দোষী সাব্যস্ত হলেন দুই কিংবদন্তী আওয়ামী লীগ নেতা, হাজারো কর্মী গড়ার কারিগর, স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক জননেতা এম এ আজিজ ও আব্দুর রাজ্জাক। আমি স্পষ্টত বলবো, এ সিদ্ধান্ত ছিলো ভূল ও প্রশ্নবিদ্ধ। যা আজও মানুষের কাছে শত প্রশ্নের ধারক। ফলতঃ এর মধ্য দিয়েই বিয়ানীবাজার আওয়ামী লীগে একটি আধিপত্যবাদী রাজনীতির শুরু হয়েছিলো। যা আজকের ন্যাক্ষারজনক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আজ ১৫বছর থেকে বিয়ানীবাজার আওয়ামী লীগে কাউন্সিল নেই, ছাত্রলীগ-যুবলীগের কমিটি নেই ও সাংগঠনিক স্থবিরতা প্রায় এক যুগ থেকে। বর্তমানে ছাত্রলীগ স্পষ্টত পাঁচ ভাগে বিভক্ত। অসংখ্যবার ছাত্রলীগ এর এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে রক্তক্ষয়ী সংগর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এবং একজন কর্মী খুনও হয়েছেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষের অনেক মামলায় অসংখ্য ছাত্রনেতা আত“গোপনে আছেন। আবার অসংখ্য ছাত্রলীগ নেতাদের কারাবরণও করতে হয়েছে এই বিভক্ত রাজনীতির যাতাকলে পড়ে। যা মোটেও কাম্য নয় । এবং এই অসংখ্য ছাত্রলাগী কর্মীরও কোন দোষ দেখছিনা। এটা একটি পরিকল্পিত অপরাজনীতি চর্চার অংশবিশেষ; যার প্রধান লক্ষ্য হলো আওয়ামী পরিবারকে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত করে বিয়ানীবাজারে ব্যক্তি বিশেষের ‘‘একক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব’’ প্রতিষ্টার চেষ্টা ইত্যাদি।
এভাবে বিয়ানীবাজারে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অতীতের সমগ্র রক্তস্নাত সোনালী অর্জনগুলোকে কার্যতঃ বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। এভাবে সংগঠন বছরের পর বছর পরিচালিত হওয়ার ফলে আজ সংগঠনে একটি চরিত্রহীন ’মোসাহেবী’ নেতা ও তদানুসারে কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছে। যাদের ‘অপার মহীমাময় নেতৃত্ব’ ও ’কলুষিত খপ্পর’ থেকে নিজেদের বাঁচাতে আজ দেশে বিদেশে অবস্থানরত ত্যাগী নেতাকর্মীদের করুন আর্তনাদ মূহুর্মূহু ধ্বনি-প্রতিধ্বনীত হচ্ছে দেশে-বিদেশে, চতূর্দিকে। এ অবস্থার শেষ পরিণতি হচ্ছে নেতৃত্ব শূন্যতা। যার আশু নিরসন জরুরী। অন্যথায় এ স্বার্থান্বেষী পরিবেশ, যা সংগঠনে চরিত্রহীন রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টি করার পথকে উৎসাহিত করবে এবং এই অপরাজনীতি প্রকৃত নেতৃত্বগুন সম্পন্ন নেতা সৃষ্টির অন্তরায়। যা দীর্ঘ মেয়াদে সংগঠনের জন্য ক্যান্সার ব্যাধির মতো ক্ষতিকর ।
আজ দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে চাই, দলমত নির্বিশেষে মানুষ জনাব আব্দুল আজিজ ও আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আওয়ামী লীগ কর্তৃক এ দুজন মানুষ ও তাঁদের পরিবারের প্রতি অন্যায়ভাবে সাংগঠনিক অবিচার ও নিষ্ঠুর মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে মনে করে। বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছিলেন “ বিশ্ব বিচার ব্যবস্থায় একটি মিথ প্রচলিত আছে যে, আদালত রায় দেওয়ার পরে অধিকাংশ জনগন যদি মনে করে এটি ন্যায় বিচার হয়েছে, সেটিই ন্যায় বিচার বলে স্বীকৃত। আর আদালত রায় দেওয়ার পরে অধিকাংশ জনগণ যদি মনে করে এটি অন্যায় রায় হয়েছে তবে আদালত রায় দিলেও এটি অন্যায় ও অবিচার বলে প্রতিয়মান হয়।” আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জনাব এম এ আজিজ ও আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের গৃহিত সিদ্ধান্ত ছিলো অন্যায় ও অবিচার এবং ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা প্ররোচিত। দীর্ঘদিন পর এ ব্যক্তিদ্বয়ের প্রতি গণমানুষের হৃদয়ের আকুতি দেখে নিজেকেও অপরাধী মনে করে বিবেকের তাড়নায় আজ অনেক সত্যকে স্বীকার করতে প্রবৃত্ত হলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়ও পড়েছিলাম “ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃনা তারে যেন তৃণসম দহে”। হ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক এই দুই কালজয়ী ও কিংবদন্তী নেতার প্রতি একটি অন্যায়কে মুখ বুজে সহ্য করা বা দুর্বল চিত্তে মেনে নেওয়ার অপরাধে আমরাও অপরাধী।
বিশ্বাস করি, ক্ষমা চাওয়ার মাঝে লজ্জার কিছু নেই। অবশেষে হৃদয়ের তাড়নায় আজ চিত্ত বিগলিত। তাই আজ উম্মুক্ত হৃদয়ে অপরাধীর কাঁতর কণ্ঠে আবেদন করছি, আমাদের ক্ষমা করুন জনাব এম এ আজিজ ও আব্দুর রাজ্জাক । আপনাদের সাজানো বাগানে আমরাও ফুটেছিলাম শতদল হয়ে। কিন্তু সুযোগ্য সময়ে অনাহুত ভয় ও হীনমন্যতাকে জয় করতে পারিনি। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছিলাম অন্যায় ও অবিচারকে রুখতে। তাই আজ হৃদয়খুলে আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। ভবিষ্যতে আর কারো জীবনে এমন না হোক-বিধাতার কাছে প্রার্থনা।
জননেতা আব্দুর রাজ্জাক সাহেব কর্মীবান্ধব- সৎ- নির্লোভ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জিং সাহসি দ্বায়িত্ব পালন করেছেন- প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী যোগ্যতা দিয়েই। অগণিত কর্মীরা এখনও সমানে তাঁকে ভালোবাসে। কারণটাও সহজভাবে বুঝা য়ায়- আব্দুর রাজ্জাক একজন তৃণমূল বান্ধব সৎ,পরোপকারী ভালোমনের রাজনৈতিক মানুষ। সমাজের প্রতি এই নির্লোভ ব্যক্তির কীর্তি, মানুষের প্রতি অপার দান, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভালবাসা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্ত কাল। আব্দুর রাজ্জাক, আপনি কিংবদন্তী। সব সময় ভাল থাকুন।
ছরওয়ার আহমদ : সাবেক ভিপি, ছাত্র সংসদ (১৯৯৫-৯৬), বিয়ানীবাজার সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, বিয়ানীবাজার, সিলেট । বর্তমানে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা।