সিলেট : ডিসি যায় ডিসি আসে, রেখে যায় স্মৃতি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭
নজরুল ইসলাম বাসন:
সিলেটকে এক সময় বলা হত কাঞ্চনকন্যা, সুন্দরী শ্রীভুমি সিলেটে পদার্পন করেছিলেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল, আরো কত কত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে সিলেটের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য নাড়া দিয়েছিল সে কথা বলা বাহুল্য, কিন্তু সিলেটের এখন সে রূপ আর নেই। শহর সিলেট এখন এক ইট সিমেন্টের বস্তি। ঘর থেকে পা বাড়ালেই দোকান পাট আর মার্কেট এ যেন মার্কেটের নগর, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে সিলেটের তদানীন্তন ডেপুটি কমিশনার হাসান চৌধুরী গোবিন্দ পার্কে নির্মাণ করেন হাসান মার্কেট। তারপর এই ধারা এখনও চলছে। হাসান সাহেব চলে গেলেও তার দেখানো পথ অনুসরণ করছেন নব্য পুজিপতিরা ও ডিসি সাহেবরা। এক ডিসি সাহেব দোকান পাট ও নির্মাণ করেছেন এই লেখায় আমি পরবর্তীতে উল্লেখ করেছি। সত্তর দশকের শেষ দিকে আরেক (প্রয়াত) ডিসি ফয়েজ উল্লা, তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। সিলেট শহরের রাস্তাঘাট বড় করার জন্যে উদ্যেগ নেন। ওভারসিজ সেন্টার তার উদ্যেগেই নির্মাণ করা হয় (এই লেখকের পারিবারিক ৩টি দোকানও নেয়া হয়েছিল, নেভার মাই)। পলিটিক্যাল চাপে বিদায় না নিলে ডিসি ফয়েজ উল্লা আরো অনেক কাজ করতে পারতেন। তারমত কেউ থাকলে সিলেটে এখন এনআরবি সেন্টারও করা যেত।
ডিসি ফয়েজ উল্লার পরে আরো অনেক ডিসি এসেছেন গেছেন কিন্তু নগরবাসির স্মৃতিতে তারা স্থান করে নিতে পারেননি। রাজা যায় রাজা আসে, ডিসি আসেন, ডিসি যান, কিন্তু নগর সিলেটের রাস্তা আর বড় হয় না। নগর সিলেটের বিনোদনের জন্যে দৃস্টিনন্দন কিছু কোনো ডিসি করেননি। তবে এক্ষেত্রে সিলেটের বর্তমান ডেপুটি কমিশনার জনাব রাহাত আনোয়ার বোধহয় একটু ব্যতিক্রম। তিনি তার কার্যালয়ের চত্বর সাজিয়েছেন মনোরম ও দৃস্টিনন্দন করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তার একটি সৃজনশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অটিস্টিক শিশুদের জন্য পরিচালিত সিলেট আর্ট এন্ড অটিস্টিক স্কুলের দুই শিক্ষক চিত্রশিল্পী ইসমাইল গনি হিমন ও আলী দেলওয়ারের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে নয়নাভিরাম এক শৈল্পিক উদ্যান। এতে রয়েছে ‘সৌরভ’ ‘গৌরব’ আর প্রকৃতি কন্যা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথা নিয়ে হৃদয়ে ৭১, সিলেটের নাগরি লিপির উপর মুর্যাল। জেলা প্রশাসনের তোরন দিয়ে প্রবেশ করলেই ডানে যে ৩০ শতক জায়গা ছিল সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে ছোট্ট সিলেটকে। চা বাগানের ছোট ছোট টিলা, আলী আমজদের ঘড়ির পাশে ঐতিহ্যবাহি কীনব্রীজ। শিল্পীরা ড্রাইওয়াল পেইন্টিং এর মাধ্যমে চা বাগান আর টিলার চিত্র অংকন করেছেন। পর্যটন নগরীর চিন্তা মাথায় রেখে থিম পার্কের আদলে এই শৈল্পিক উদ্যানটি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সন্দেহ নেই। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার কলেক্টরেট লাইব্র্রেরিকেও সমৃদ্ধ করার উদ্যেগ নিয়েছেন। তরুণ প্রজন্ম যাতে পড়তে আগ্রহী হয় সেদিকেই তার নজর। তিনি নাগরি লিপির প্রতিও দেখিয়েছেন যথেষ্ট আগ্রহ তার কার্যালয়ের নিচ তলায় রয়েছে নাগরী লিপির ম্যুরাল। ফয়েজ উল্লা সাহেব এর যাওয়ার প্রায় ৪ দশক পরে রাহাত আনোয়ার সাহেব সিলেটের ডিসি হয়ে এসেছেন এই রুচিশীল মানুষটি সিলেটের অপরূপ রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে ট্যুরিজমের জন্যে সিলেটকে ব্রান্ডিং করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তার এই চিন্তা ভাবনা যদি নীতি নির্ধারকদের চোখে পড়ত তাহলে তিনি অনেক কাজ করে দেখিয়ে যেতে পারতেন।
সিলেট নগরবাসির দুর্ভাগ্য যে, উন্নয়ন বলতে তারা বোঝেন শুধু রাস্তাঘাট আর ব্রীজ, চিত্ত বিনোদনের জন্যে যে কিছু করতে হবে এটা তাদের মাথায় নেই। চিত্ত বিনোদনের জন্যে যে বিত্তের প্রয়োজন সেটা বিত্তশালিদের থাকলেও তারা বিনোদনের জন্যে বিনিয়োগ করবেন না, নেই নগরপিতাদেরও । যদি নান্দনিক মানসিকতা থাকতো তাহলে তাদের নান্দনিক মনের পরিচয় পেতাম ডিসি সাহেবের মত। শুনেছি ৫০ বা ষাটের দশকে সিলেট টকিজ বা দিলশাদ ছিল, ছিল রংমহল। এখন সিলেটে সিনেপ্লেক্স থাকা উচিত ছিল, কিন্তু নেই। সিলেটে বিনোদনের কোনো পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেই বল্লেই চলে, যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকান।
এখানে একটা কথা বলতে হচ্ছে, আমাদের নগর পিতারা কি ভুলে গেছেন কোর্ট প্রাঙ্গনের ৬ খুটির ঘর, রাস্তার দুই ধারে বকুল ফুলের গাছ। আমরা যে সিলেট শহরে বড় হয়েছি সেখানে বড় বড় দিঘী ছিল। তালতলারদিঘী ভর্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়েছে। গোবিন্দ পার্কের উপর মার্কেট আর জেলা পরিষদ অফিস হয়েছে। কোর্ট পয়েন্টে তথাকথিত দৃষ্টিকটু লোহার জঞ্জালযুক্ত ওভারব্রীজ। খুব দরকার ছিল কি এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গনকে নস্ট করার। ডিসি অফিসের জায়গায় দোকানপাট নির্মাণকে হালাল করার জন্যে বানানো হয়েছে দোকানপাট। এই দোকানগুলোর সালামী কাদের পকেটে গেছে তা ভাবতেও লজ্জা লাগে। এই ফাঁকে বলে নেই আমার জন্ম সিলেটের ছড়ারপারে মাতুলালয়ে, যেখানে সাবেক মেয়র কামরান সাহেবের বসত বাড়ি। লেখাপড়া করেছি সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে।তাই সিলেট শহর আমার জন্ম ও প্রাণের শহর। চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল জাফলং চা বাগানে। সেখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য দেখতে হাই কমিশনারসহ অনেক বিদেশী যেতেন। আমি লন্ডন থেকেও অনেক অতিথিদের নিয়ে গেছি সিলেটে। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী কিথ ভাজ ও সাবেক এমপি ফ্রাংক ডবসনও রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে আরো দেশি বিদেশী অতিথিদের নিয়ে সিলেট গিয়েছি। সবাই সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে প্রশংসা করলেও অপরিকল্পিত নগরীর মন্দ দিকটাও তাদের নজর এড়ায়নি বলে আমাকে জানিয়েছেন।
এবার আসি অন্য প্রসংগে। সিলেট নগরীতে এক সময় প্রচুর দিঘী ছিল। এখন আর দিঘী বা উন্মুক্ত প্রাঙ্গন নেই। উন্মুক্ত প্রাঙ্গনগুলোতে হয়েছে ভবন আর ভবন। আর জলাশয়গুলোতে হয়েছে উপশহর আর হাউজিং এস্টেট, প্রাইভেটর প্রপার্টিতো গড়ে উঠেছে যত্রতত্র। তাই সিলেটকে গালভরা নাম পর্যটন নগরী দিলেও এই সিলেট নগরীকে সত্যিকার অর্থে পর্যটন হিসেবে নগরী গড়ে তুলতে হলে রাতারগুল, বিছনাকান্দি, জাফলং, মাধবকুন্ড এবং চা বাগানগুলোকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। এগুলোকে প্রাকৃতিক প্রাণীদের জন্যে অভয়ারন্য হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্যে খুব বড় কিছু করার দরকার হবে না। সিলেটের মাননীয় জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার সাহেব যে দৃষ্টান্ত সৃস্টি করেছেন এটাই যথেষ্ট। এই ধরনের আরো অনেক সৃজনশীল মডেল নিয়ে অনেকে সিলেট সাজাতে পারবেন, যেসব ফরেনার সিলেটে আসেন তারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন প্রকৃতি-কন্যা সিলেটের রূপের দিকে। প্রতিবছর ইউরোপ আমেরিকা থেকে যে সংখ্যক বাংলাদেশি সিলেটে বেড়াতে যান এবং অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের দিয়েই সিলেট পর্যটন নগরী হিসাবে সফল হয়ে উঠতে পারে। শুধু সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকলে কিছুই হবে না, তবে সরকারের কর্মকর্তারা চাইলে অনেক কিছুই হতে পারে আর এই জন্যে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
নজরুল ইসলাম বাসন : সাবেক কমিউনিকেশন্স এ্যাডভাইজার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল।